ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রচ্ছদ » ফিচার » বিস্তারিত

দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা হযরতের জীবনযুদ্ধের গল্প

২০২৩ মার্চ ০৯ ১৯:৩৮:৫৪
দরিদ্র কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা হযরতের জীবনযুদ্ধের গল্প

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার আগরদাঁড়ি ইউনিয়নের বাবুলিয়া গ্রামের দরিদ্র কৃষক আবু তালেব সরদারের ছেলে হযরত আলী প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সফলতা অর্জণ করায় সে আজ এলাকার মানুষের অনুপ্রেরণা। তার এ জীবনযুদ্ধকে নিজেদের শিক্ষাজীবনে ও কর্মজীবনে পাথেয় করতে চায় উঠতি বয়সের তরুণরা।

১৯৯২ সালের পহেলা জানুয়ারি বাবুলিয়া গ্রামে জন্ম হযরত আলীর। সাড়ে তিন বিঘা জমি চাষাবাদ করে চার মেয়ে ও দুই ছেলেকে পড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছেন আবু তালেব সরদার। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও যথেষ্ঠ বাহ্যিক জ্ঞান ছিলো তার। তবে মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে তিনি নিরুৎসাহিত করতেন। এরপরও মেয়ে সাদিয়া খাতুন ইতিহাসে অনার্স মাস্টার্স করেছেন। ছোট মেয়ে আছিয়া খাতুন উচ্চ মাধ্যমিক পস করেছেন। চার মেয়েকেই বিয়ে দিয়েছেন।

দু’ ছেলের মধ্যে হযরত আলী নেবাখালি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে প্রাথমিকের গণ্ডি পার হয়ে ২০০০ সালে বাবুলিয়া জেএস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাবা বই কিনে দিতে না পারায় সেখানে তার আর পড়া হয়নি। একপর্যায়ে পরের বছর মাদ্রাসায় বই ফ্রিতে দেওয়া হয় এমন পরামর্শ পেয়ে হযরতকে গোদাঘাটা বারাকাতিয়া দাখিল মাদ্রাসায় ভর্তি করান আবু তালেব সরদার। ২০০৬ সালে এ প্লাস পেয়ে দাখিল পাস করেন হযরত। এ সাফল্যের জন্য মাদ্রাসা সুপার আলতাফ হোসেনের সহযোগিতা ও অনুপ্রেরণা হযরতকে পড়াশোনার প্রতি আরো আগ্রহী করে তোলে। ২০০৮ সালে সীমান্ত আদর্শ ডিগ্রী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে মানবিক বিভাগে এ প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হন হযরত। ২০০৯ ও ২০১০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও পরবর্তীতে এলএলএম পাস করেন।

২০১৯ সালে সোনালী ব্যাংক লিমিটেড এর পিরোজপুর জেলার ইন্দুরকানি শাখায় যোগদান করেন হযরত। চাকুরি করাকালিন সময়ে বিসিএস ক্যাডারে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য দিবা রাত্র পড়াশুনা করেছেন। আড়াই বছর সোনালী ব্যাংকে কাজ করার পর ২০২১ সাল থেকে রুপালী ব্যাংক লিমিটেড এর ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে আইন বিভাগে আইন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ শুরু করার কয়েক মাস পর তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের (মতিঝিল) ডির্প্টামেন্ট অফ পেটেন্ট ডিজাইন এণ্ড ট্রেড মার্কস শাখায় পরীক্ষক হিসেবে যোগদান করে বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন।

হযরত আলী জানান, জীবনের উদ্দেশ্য পূরণ করতে তিনি ১৫তম বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিসে অংশ নেন। গত ২৪ জানুয়ারি প্রকাশিত ফলাফলে তিনি সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন শেষে আগামি ছয় থেকে সাত মাসের মধ্যে তিনি বিচার বিভাগে যোগদান করতে পারবেন বলে আশাবাদী।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেখানে চাকুরি পাওয়া সোনার হরিণের মতো সেখানে কিভাবে আপনি একের পর এক চাকুরি সংগ্রহ করছেন ও পরে ছেড়ে দিচ্ছেন এমন প্রশ্নের জবাবে হযরত বলেন, মানুষের অদম্য ইচ্ছশক্তি নিদ্দিষ্ট গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দিতে পারে । সংসারে প্রচণ্ড অভাব থাকার পরও পড়াশুনার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। শীতকালে বাবার সঙ্গে সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন খেজুর গাছ পাড়তে হতো। রস জ্বালাতে মায়ের সঙ্গে গাছের পাতাও কুড়াতে গেছেন তিনি। ইংরাজীতে ব্যাসিক ভাল ফল ছিল তার। উচ্চ মাধ্যমিকে বাংলা বাদে ১০ বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছেন তিনি। সাত বছর আগে বিয়ে করেছেন ।

বর্তমানে পাঁচ বছরের এক সন্তানের জনক তিনি। সবকিছুর মধ্য দিয়ে মা ও স্ত্রীর অন্রুপ্রেরণায় তিনি চাকুরি জীবনের প্লাটফর্ম বার বার পরিবর্তণ করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে বিচারক হিসেবে যোগদানের পর তিনি ঢাকা শহরে থাকতে চান না। মা, মাটি ও মানুষের অকৃত্রিম ভালবাসা যেন তার বার বার মফঃস্বলে চাকুরি করার স্পৃহাকে জাগ্রত করে। বিচারপ্রার্থীদের ন্যয় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি নিদ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিচারক হিসেবে কাজ করে যেতে চান।

বাবুলিয়া সেবা সংসদের সভাপতি কাওছার আলী বলেন, হযরত আলী শিক্ষানুরাগী ও শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অনণ্য দৃষ্টান্ত। তার জীবনযুদ্ধ তরুন সমাজের পাথেয় হওয়া উচিত।

সাতক্ষীরা মিনি মার্কেটের ‘রং তুলি’ এর স্বত্বাধিকারী মহিবুল­াহ গাজী জানান, বালিয়াডাঙা থেকে বাবুলিয়া পশ্চিমপাড়া খুব বেশি দূর নয়। হযরতের ইচ্ছাশক্তি তাকে নতুন করে পড়াশুনা করার আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে ও এলাকার উন্নয়নে হযরতকে পাশে পেতে চান তিনি।

একইভাবে বাবুলিয়া সেবা সংসদের অন্যতম সংগঠক ডাঃ ইসরাইল গাজী জানান, সমাজ থেকে অপসংস্কৃতি দূরীকরণ, এলাকার উন্নয়ন, মাদক বিরোধী আন্দোলন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ও ঝরে পড়া শিক্ষার্থী বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হযরত আলী একজন শিক্ষা উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের পাশে থাকবেন।

গোদাঘাটা বারাকাতিয়া দাখিল মাদ্রাসার এক সময়কার সফল সুপারইনটেনডেন্ট আলতাফ হোসেন তার শিক্ষকতা জীবনে হযরত আলীর মত একজন সফল ছাত্রের শিক্ষক হতে পেরে তিনি যার পর নেই আনন্দিত।

(আরকে/এএস/মার্চ ০৯, ২০২৩)