ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলানো কঠিন

২০২৩ জুন ০২ ১৫:৩৭:৩৫
জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলানো কঠিন

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


জীবনের কোনো কোনো সময় মানুষকে বলতে শোনা যায়, আমার সব আশা শেষ, আমার আর কোনো স্বপ্ন নেই! আসলেই কি কারো আশা শেষ হয় কখনও? স্বপ্ন ফুরিয়ে যায় কখনও? স্বপ্ন ও আশা কী? যা আমরা ঘুমিয়ে দেখি তা স্বপ্ন এবং যা জীবনে করতে চাই তাই আসল স্বপ্ন আর একেই আশা বলা হয়।

মানুষ ভিন্ন ভিন্ন সত্তায় গড়া। তাই মানুষের পছন্দ, অপছন্দ, চাহিদার ক্ষেত্রেও ভিন্নতা দেখা যায়। কেউ জীবন যাপন করে আর কেউ জীবন ধারণ করেই জীবনের প্রকৃত স্বাদ নিতে চায়। অর্থাৎ মানুষ স্বপ্ন দেখে ঘুমিয়ে আর আশা করে জেগে থেকে। ঘুম ভেঙ্গে গেলেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় আর আশা আমৃত্যু থাকে। আশা নিজের থেকে অর্জন করতে চাওয়ার নাম আর যখন আমরা অন্যের থেকে অর্জন করতে চাই তখন তাকে বলা হয় প্রত্যাশা।

মাঝে মাঝে জীবনের কাছে চাওয়া পাওয়া নতুনভাবে জন্ম নেয়। আমরা যা চাই তা হয়তো ঠিক সেই মুহুর্তের জন্য প্রযোজ্য নয় তবুও আমরা তার পিছু ছুটি, আর না পেলে ব্যর্থতার গ্লানি বুকে চেপে জীবন থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করি। কিন্তু একবারও কি চাওয়া তালিকাটি খুলে দেখেছেন? তাতে প্রাপ্তি কতখানি? একটু খেয়াল করে দেখুন আপনার পাওয়ার তালিকাও কম না। আপনি জানেন আপনি কী জানেন না :আমরা অনেক কিছু জানি বা দৈনন্দিন জীবনযাপনের জন্য হলেও আমাদের অনেক কিছু জানতে হয়। তবে এই জানার ভিড়েও আমরা অনেকেই এটা জানি না যে আমরা কী চাই? আমাদের কী চাহিদা? আমাদের আসলেই কোনটা লাগবে? যদি আপনি জেনে থাকেন যে আপনার আসলেই কী দরকার আপনি আসলেই ভালো আছেন। এবং আপনি যা ভাবছেন তার থেকেও জীবনে ভালো কিছু করছেন।জীবনের দায়িত্ব

মানব জীবনের আশা কখনও শেষ হয়? না, শেষ হয় না। আশাহীন জীবন মরুভূমির মত। বরং কোনো কারণে কোনো একটা আশা সত্যি না হলে, পূরণ না হলে আমরা হয়ত কিছুদিন ভেঙ্গে পড়ি, হতাশায় ভুগি। হতাশা কাটিয়ে উঠি কিন্তু আশা করা ছেড়ে দিই না। আমরা আবারও আরেকটি স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমাদের মনে আরও আশা জাগতে শুরু করে।

মানুষ স্বপ্ন ছাড়া, আশা ছাড়া বাঁচতে পারে না। পাগলেরও স্বপ্ন থাকে তবে এলোমেলো। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের স্বপ্ন থাকে গোছানো। আমাদের সবার জীবনেই অনেক অনেক স্বপ্ন থাকে, মনে অনেক আশা থাকে। সব স্বপ্ন সত্যি হয় না। তখন আমরা মন খারাপ করি।

সর্বোপরি, টাকাই মানুষের মূল চালিকা শক্তি। সত্তারা মরে গেছে। সত্তাবিহীন অবয়বের দৃশ্যমান হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে সর্বত্র। প্রাকৃতিক শ্রেষ্ঠত্বকে উপেক্ষা করে শ্রেষ্ঠত্বের দাবি নিয়ে বীরদর্পে দাপিয়ে বেড়ানোর অপপ্রয়াস চলছে। এ যেন শত নয়, হাজার বছরের পরিকল্পনা। অথচ অল্পও নয়, স্বল্প সময়ের জন্য এ ধরায় আবির্ভাব।

এমন এক সময় হয়তো এদেশে আসবে যখন কেবল মানুষ, মানুষকে খুঁজে বেড়াবে অর্থকে নয়। কারণ, অর্থ তখন সব মানুষের কাছেই থাকবে। যখন মানুষ সুদ, ঘুষ, দুর্নীতির অন্ধকারে পড়ে অস্তিত্বের ঠিকানায় পৌঁছানোর জন্য আলো খুঁজবে তখনই কেবল আলোর উৎসের সন্ধান করবে।প্রয়োজনীয়তাই মানুষকে অনুসন্ধানের দিকে ধাবিত করে। মানুষ বেঁচে থাকতে চায় অনন্তকাল। দেহের পরিসমাপ্তি হলেও আত্মার কখনো মৃত্যু হয় না। তাই বেঁচে থাকতে হলে মানুষের মাঝেই বেঁচে থাকতে হয়। মানুষই শ্রেষ্ঠ, যদি থাকে মূল্যবোধ।

দুর্বল চিত্তের মানুষ হয়ত মনে মনে ভাবে- 'আর দেখবো না স্বপ্ন। আশা করবো না আর'। স্বপ্ন দেখা কমতে থাকে হয়ত। একেবারে শেষ হয় না কিন্তু। স্বপ্ন দেখা শেষ হবার নয়। আশা শেষ হয় কি কখনও?

কষ্টে ভেঙ্গেচুরে যাওয়া মানুষটিও ভাবে যে, তার কোনো আশা নেই। সত্যটা হলো- কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের কাছে পৌঁছোবার মনের কোনো এক কোণায় একটুখানি আশা তার থেকেই যায়। একজন কঠিন রোগে আক্রান্ত মৃত্যুপথযাত্রী যার দুনিয়াতে সময় প্রায় শেষ, হয়ত একমাস বাঁচবে এরকম, সেই মানুষটির চোখেও আশার আলো দেখতে পাওয়া যায়।

কেন শেষ হয়েও শেষ হয় না আশা? কারণ মানুষ জীবনকে ভালোবাসে। যিনি ফুলের বা সবজি বাগান করেন তিনি ভালোবেসেই করেন। ভালোবাসেন বলেই বাগানের ফুলগাছগুলোর যত্ন করেন এই আশা নিয়ে যে, তার বাগান ফুলের হাসিতে ভরে উঠবে।

স্বপ্নকে সত্যি করতে চাইলে স্বপ্ন পূরণে যত্নবান হতে হয়। নিজের যোগ্যতা, সামর্থ্য ও পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদির সঙ্গে সমন্বয় থাকতে হয়। আমি নিশ্চয়ই এই আশা করবো না যে আমি চাঁদে যাবো বা জেকে রাওলিং এর মত বিখ্যাত লেখিকা হয়ে যাবো। এটা অবাস্তব।

মাধ্যম পর্যায়ের আশা পূরণে সহজ হয়। উচ্চাশা হতাশার কারণ হয়। আশা ভঙ্গের যন্ত্রণা পোহাতে হয় তখন। তাই ব্যক্তির যোগ্যতানুযায়ী স্বপ্ন দেখা উত্তম। যোগ্যতার সঙ্গে প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল, প্রচেষ্টা ও পরিশ্রম। পৃথিবীতে এমন অনেক সফল মানুষ রয়েছেন, এমন অনেক নজির ভুরি ভুরি যারা মাটি থেকে আকাশ ছুঁয়েছেন।

আমি তাদের কথা বলছি না এখানে। তাদেরকে অ্যানালাইসিস করার মত জ্ঞান আমার নেই। আমি বলছি গড়পড়তা মানুষদের কথা। আমার মত সাহস কম মেধা শূন্য মানুষদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ভালোবাসা। স্বপ্নটার প্রতি ভালোবাসা।

এর মানে হচ্ছে নিজের প্রতি ভালোবাসা। নিজেকে ভালোবাসতে পারলেই আশা পূরণে যত্নবান হওয়া যায়। নিজেকে না চিনলে নিজেকে ভালোবাসা যায় না। নিজেকে ভালোবাসতে না পারলে নিজের স্বপ্ন পর্যন্ত পৌঁছানো সহজ হয় না।

যারা সফল, তারা আগে নিজেকে ভালোবেসেছে। এর মানে কিন্তু আত্মকেন্দ্রিক হওয়া নয়। স্বার্থপর হওয়া নয়। যে বয়সেই আমরা আমাদের নিজেকে চিনতে পারবো, হোক সেটা ৩৫ বা ৪০ বছরে।
আমাকে দিয়ে কী হবে উপলব্ধি করতে পারলে, আমাদের শুরু করে দেয়া উচিত নিজেকে ঝালাইয়ের এবং যাচাইয়ের। থেমে যাওয়া যাবে না। থামবো তবে বিশুদ্ধ বাতাস নেয়ার জন্য। আমরা যা পারি তা করতে থাকবো। অন্যের চোখে সেটা যত ছোট কাজই হোক না কেন তা করতে থাকা উচিত।

নিজের স্বপ্ন পূরণে লক্ষ্য রাখতে হবে আমাদের দ্বারা কারো যেন ক্ষতি না হয়ে যায়। আশেপাশের লোক আমাকে বা আপনাকে উৎসাহ দেবে না। নিজেকে নিজে মোটিভেট করা যে কতটা কার্যকর! নিজেকে মোটিভেট করা, নিজেকে ভালোবাসা, স্বচেষ্ট থাকা। আশার কাছে, স্বপ্নের কাছে পৌছতে পারা যাবে ইনশাআল্লাহ। যে উত্তম পন্থায় চেষ্টা করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে সফল হতে সাহায্য করেন।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে- আশা করা উচিত নিজের কাছে। অন্যের কাছে নয়। অন্যের কাছে আমরা যা আশা করি তা প্রত্যাশা ।প্রত্যাশা যত বেশি হবে, কষ্ট পাবার সম্ভাবনাও তত বেশি। প্রত্যাশা কম কষ্টও কম। জীবনের সব ক্ষেত্রে। সংসার জীবনে, কর্মজীবনে ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রেও তাই।
এ জন্যই বলা হয়েছে, "প্রত্যাশাহীন জীবন স্বর্গের মতন"। তাই বলে আমরা আমাদের প্রিয়জনদের কাছে একেবারেই প্রত্যাশা করবো না, এমনটি নয়। পাশের প্রিয় মানুষটির মন, সামর্থ্য, সময় বুঝে প্রত্যাশা করা উচিত। একজন কাছের মানুষের প্রত্যাশা নিয়ে উক্তি- "আমার এখন কোনো প্রত্যাশা নেই। আমি খুব ভালো আছি তাই। যখন অনেক প্রত্যাশা ছিল তখন অসুখি ছিলাম"।

প্রত্যাশা আর ভালোবাসা একে অন্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই ভালোবাসা শব্দটার অর্থ অনেক ব্যাপক। এর সংজ্ঞা আছে শত শত। আমি ওসবে যাবো না। কারণ ভালোবাসার কোনো ডেফিনেশনই আমার মাথায় ধরে না। যেখানে ভালোবাসা সেখানে প্রত্যাশা। আর প্রত্যাশা কোথায় করা হয় যেখানে ভালোবাসা আছে। ভালোবাসা তো অনেক ধরনের। বৃক্ষের প্রতি ভালোবাসা, পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আরও কত শত ভালোবাসার রকম আছে।

প্রণয় থেকে যে ভালোবাসা সেটা আবেগধর্মী। এই ভালোবাসার কারণেই দুটি মানুষ বিয়ে করে এক হয়। একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসে বলে মনে হয়। এক সময় সেই প্রচণ্ড ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়। হারিয়ে যায়। কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়?

ভালোবাসায় থাকে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, সম্মান, আস্থা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা, অনুভব। ভালোবাসা হারায় না। কখনই হারায় না। সময়ের ব্যবধানে ধুলো পড়তে পড়তে ভালোবাসা চাপা পড়ে থাকে। মনের মধ্যে, বুকের মধ্যে ভালোবাসা ঠিকই থাকে।

যদি সত্যিই হারিয়ে যেত তবে চারপাশে এত ভালোবাসার গল্প শোনা যেত না। যারা বলে ভালোবাসা শেষ হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে, তারা ভালোবাসতে পারেনি। তারা ভালোবাসা পায়নি। আমরা বলে থাকি একসময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, ভাই-বোনের মধ্যে, আরও নানান সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসা থাকে না। থাকে কিন্তু আমরা উপলব্ধি করতে পারি না।

কখন থাকে না বা শেষ হয়ে যায় বলে মনে হয়? পরস্পরের প্রতি প্রত্যাশা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায় যখন। প্রত্যাশা বাড়তে বাড়তে এক সময় লোভ, স্বার্থপরতা, আত্নকেন্দ্রিকতা চলে আসে। প্রত্যাশা পূরণ না হলে সন্দেহ আর অবিশ্বাস চলে আসে মনে। আর এই সন্দেহকে বাড়তে দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় মোটেই।

বিশ্বাস করতে থাকা উচিত। বিশ্বাস করে কেউ কোনোদিন ঠকে না। আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় ঠকে যাচ্ছি। কিন্তু একটা সময় সঙ্গী বা সঙ্গিনীর উপলব্ধি হবেই। যাচাই না করে কারো প্রতি অবিশ্বাস আনা উচিত নয়। সন্দেহ যেখানে আসবে সম্পর্কে ফাটল ধরবেই। তাই সন্দেহকে যে কোনো ভাবেই দুর করা উচিত।

তাই সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করা। ইতিবাচক চিন্তাভাবনা জীবনকে সহজ করে দেয়। জীবনে জটিলতা সৃষ্টি হয় না। আস্থা রাখা প্রিয়জনের প্রতি। সন্দেহ আর অবিশ্বাসের কারণেই পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে যাই আমরা।

যে কোনো সম্পর্কের ক্ষেত্রেই হোক সেটা স্বামী-স্ত্রী বা অন্য যে কোনো। নিজের দোষ আগে দেখা একটা বিশেষ গুন। পাশের মানুষটির গুন খোঁজা, এটা উত্তম বৈশিষ্ট্য। অন্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ না করা, অল্প ভালোবাসাকে বিরাট করে দেখা, অল্পে সন্তুষ্ট থাকা, কৃতজ্ঞ থাকা, শোকর করা, ধৈর্য ধরা এবং মোস্ট ইম্পরট্যান্ট হচ্ছে ক্ষমা করতে পারা।

পৃথিবীতে ভালোবাসা আছে, থাকবে। স্বপ্ন, আশা, প্রত্যাশা সব থাকবে জীবনে। এসব মানবীয় বৈশিষ্ট্য। শুধুমাত্র আমাদেরকে আমাদের জ্ঞান, বিচার-বিবেচনা, বিবেক-বুদ্ধি, মেধা সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে সঠিক পরিবেশে কাজে লাগানো খুব জরুরি।জীবনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মিলানো জরুরী নয়।কারণ এদুটো কখনো সমান্তরালে চলেনা।

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।