প্রচ্ছদ » মুক্তিযুদ্ধ » বিস্তারিত
আমার মেজ দাদার মুক্তিযুদ্ধের কথা
২০২৩ জুন ১০ ১৬:১৫:৪৫দেবেশ চন্দ্র সান্যাল
১৯৭১ মহান মুক্তিযুদ্ধের সাল। ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের জ্বালাও পোড়াও, হত্যা ও অন্যান্য মানবতা বিরাধী বিশ্বের নৃশংসতম ধবংস যজ্ঞ শুরুর পর শুরু হলো মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমি বাড়ির কাউকে না বলে ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলাম। তথাকথিত পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আমার চিন্তায় আমার বাবা-মা পাগল প্রায় হয়ে গেলেন। মা সব সময় কান্নাকাটি করতেন। আমার বাবা ও দাদাদের কাছে আমার মায়ের দাবী আমাকে যুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তখন সারা দেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের দোসর পীচ কমিটির পাকিস্তানের দালাল, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় জ্বালাও পোড়াও, হত্যা, গণহত্যা, নারী ধর্ষন, নির্যাতন, নিপীড়ন, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য মানবতা বিরোধী কাজ চলছিল।
শাহজাদপুর রাজাকার ক্যাম্পের মো: জয়নাল আবেদিন নামক এক রাজাকার আমাদের বাড়িতে এসে বাবা কে শাসিয়ে বলে গেল-“ আপনার ছেলে দেবেশ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে, তাকে ৭ দিনের মধ্যে হাজির করে দিতে হবে। অন্যথায় পাকিস্তানি সৈন্য ও আমরা এসে আপনার বাড়িঘর লুটতরাজ করে সব আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হবে এবং পরিবারের সবাইকে এক লাইনে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হবে”। দিশে হারা হয়ে পড়লেন বাবা-মা সহ পরিবারের সবাই। আমাদের গ্রামের মুলসমানেরা খুব ভাল। কিছু দিন বাবা-মা সহ পরিবারের সবাই প্রতিবেশী মুসলমানদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকলেন। দেশ ছেড়ে তখন ভারতে শরণার্থী শিবিরে যাওয়া ছিল বিশেষ ঝুঁকি পূর্ণ। শেষ পর্যন্ত গ্রামের মুসলমানদের সহযোগীতায় বাড়িঘর গ্রামের মো: হোসেন আলীর জিম্মায় রেখে ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করলেন। খেয়ে না খেয়ে অনেক ঝুঁকির মধ্যে আসামের মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিলেন।
বাবা-মা প্রায় পাগলের মত হয়ে গিয়ে ছিলেন। প্রায় প্রতিদিন সকালে মানিকার চর শরণার্থী ক্যাম্প থেকে খাওয়া দাওয়া করে মানিকারচর রৌমারী মাঝ পথ দিয়ে প্রবাহিত নদীর ঘাটে বসে থাকতেন। ঐ নদী পথ দিয়েই মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা যাতায়াত করতো। কোন মুক্তিযোদ্ধার নৌকা দেখলেই আমার বাবা আমার নাম ধরে ধরে ডাকতেন। বলতেন- দেবেশ এসেছিস বাবা...। একদিন বাবা-মা দু’জন রৌমারি মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। এক ডাক্তার এর কাছে গিয়ে বলে ছিলেন- আমার ছেলের নাম দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। সে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। মুক্তিযুদ্ধে যাবার আগে নৌকায় পরে গিয়ে তার বাম হাতের কনুইয়ের উপরে কেঁটে গিয়েছিল সে কী আপনার কাছে চিকিৎসা হয়েছে। ডাক্তার সাহেব ছিলেন খুব ভাল মানুষ। তিনি আমার বাবা মায়ের মনের- কথা বুঝতে পেরে ছিলেন। তিনি বলেছিলেন-হ্যা আমি আপনাদের ছেলের চিকিৎসা করেছি। তার হাত কাটা সেরে গেছে। সে মুক্তিযুদ্ধে গেছে। অল্প দিনের মধ্যেই দেশ স্বাধীন হবে। আপনাদের ছেলে আপনাদের কাছে ফিরে আসবে।
গোলা বরুদ রেশানিং এ্যালাউন্স ও পকেট মানি আনার জন্য সিরাজগঞ্জের এম.পি.এ জনাব মো: মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা আমাদের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা ঝাঐল গ্রাম নিবাসী মো: আব্দুল হামিদ তালুকদার কে ৭ নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার তরঙ্গপুর পাঠাবেন। আমি আমার বাবা- মা ও পরিবারের অন্যান্য সকলের নাম তাঁর কাছে লিখে দিলাম। মানিকার চর শরণার্থী শিবিরে এক রাতে আমার মেজো দাদা স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠে বললো- মা, ধরো ধরো ভাই এসেছে। তার চিৎকারে মাতৃদেবীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। বললো- কী হয়েছে। মেজোদা বললো- স্বপ্নে দেখলাম-দেবেশ এসেছে, সে আমার কাছে খেতে চাইলো। মায়ের মন আরো ভেঙ্গে গেল- তাহলে দেবেশ হয়তো যুদ্ধে মারা গেছে। ভাই বার অশরী আত্মা খেতে চাইতে এসে ছিল। মানিকারচর শরণার্থী ক্যাম্পে আমার মাতৃদেবী প্রায়ই আমার জন্য কান্না কাটি করতেন। তারপর মেজদাদা দুঃস্বপ্ন দেখার পর আরো বেশী চিন্তিত হয়ে পড়ে ছিলেন। ভেবে ছিলেন হয়তো মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের আমি মারা গেছি।
আমার মাতৃদেবীর কান্নাতে মানিকারচরে স্থায়ীবাসিন্দা বিদ্যারতন সাহার স্ত্রী এক দিন বললেন- আমার গৃহে ভগবান আসে। আমার ভগবান কথা বলে। আপনার ছেলে কেমন আছে আমি ভগবানের কাছে শুনে দিচ্ছি। আমার মাতৃদেবী তার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ যুগোল অর্চা বিগ্রহের কাছে নিয়ে গেলেন আমার মাতৃদেবী সাথে বিগ্রহের কাছে করযোগে জিজ্ঞেস করলেন হে রাধা কৃষ্ণ বলো। ওনার ছেলে দেবেশ কেমন আছে তার জিজ্ঞাসার পর পর বিগ্রহরে পিছনে ঘরের বেড়াতে অবস্থিত কয়েকটি টিক টিকি ডেকে উঠলো তখন ওনা আমার মাকে বললেন শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ বলছে আপনার ছেলে ভালো আছে। মাতৃদেবী বিশ্বাস করলেন। শ্রী শ্রী রাধা কৃষ্ণ যুগোলে প্রনাম জানিয়ে শরণার্থী ক্যাম্পে চলে এলেন। কদিন পর আমাদের সহযোদ্ধা মো: আব্দুল হামিদ তালুকদার খুঁজতে খুঁজতে আমার বাবা- মা ও পরিবারের সবার সাথে সাক্ষাৎ করলেন।
তিনি আমার মাকে বললেন- দেবেশ আমাদের গ্রুপের এক জন মুক্তিযোদ্ধা। সে ভাল আছে। সে বর্তমানে সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার বিভিন্ন এলাকায় থাকে। আমি আমাদের ৭ নম্বর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে তরঙ্গপুর যাচ্ছি। আমি ফেরার পথে আবার আপনাদের সাথে দেখা করে যাব। তিনি তরঙ্গপুর থেকে গোলাবারুদ বকেয়া রেশনিং ও পকেট মানি নিয়ে কদিন পর আবার দেখা করলেন আমার বাবা-মা ও অন্যান্যদের সাথে। আমার অংশের প্রাপ্য রেশনিং এ্যাল্যাউন্স ও পকেট মানি আমার বাবার হাতে দিলেন। আমাকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আমার বাবা-মা মেজো দাদাকে মো: আব্দুল হামিদ তালুবদারের সাথে পাঠিয়ে দিলেন। ৪ নভেম্বর’৭১ রাতে। আমরা যখন কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশনের পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যাচ্ছি তখন হামিদ সাহেব বললেন- তোমার এক ভাই ভারত থেকে আমার সাথে এসেছে। তাকে শমেসপুর এক বাড়িতে রেখে এসেছি। তোমার বাবা-মা সহ সবাই ভাল আছে।
আমরা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ষ্টেশন অপারেশন ও বেলকুচি উপজেলার কল্যানপুর যুদ্ধ শেষে দৌলতপুর গ্রামে আমাদের সহযোদ্ধা মো: শামসুল হক এর বাড়িতে এসে শেল্টার নিলাম। ১৪ নভেম্বর’৭১ আমার মেজোদা খুঁজতে খুঁজতে আমাদের শেল্টারে যোগ দিল। সে তখন আমার কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচীকে বললো আমার ভাই দেবেশের জন্য আমার বাবা- মা প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। আমি ভাইকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এসেছি। দয়া করে আপনারা আমার ভাইকে ছেড়ে দিন আমি ভাইকে নিয়ে ভারতের মানিকার চর শরনার্থী ক্যাম্পে বাবা- মায়ের কাছে যাব। কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী আমার দাদার কথায় রাজী হলেন না। তিনি বললেন- দেবেশের নামে অস্ত্র ইস্যু আছে। দেশের অবস্থা ভাল না। তাকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। অল্প দিনের মধ্যে দেশ স্বাধীন হবে। বরং আপনিও আমাদের সাথে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করুন। অন্য কোন উপায় না থাকায় আমার মেজদাদাও আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলেন। কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী সহ সবাই- তাকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানো, ক্রলিংকরা, হ্যান্ডগেনেড ছোড়া ও অন্যান্য কৌশল শিখালেন।
আমরা দুই ভাই এক সাথে শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক স্থানের পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। এক দিন স্কুলের ছাত্র- ছাত্রীদের সম্মুখে আমার মেজোদাদা তার মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের কথা যে ভাবে বলেছেন তা হলো- “সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল, পিতা- দ্বিজেন্দ্র নাথ সান্যাল, মাতা-নীলিমা রাণী সান্যাল, গ্রাম ও ডাকঘর: রতনকান্দি, ইউপি-হাবিবুল্লাহ নগর, উপজেলা: শাহজাদপুর, জেলা: সিরাজগঞ্জ। আমার লাল মুক্তিবার্তা নং-০৩১২০৪০২১২, গেজেট নং-সিরাজগঞ্জ-১৬২৬ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিস্বাক্ষরিত সনদ নং-২৯৮১১, তাং-০৮/০৭/২০০০, এনআইডি নং-৭৬২৫৫০৩১২৯৮১৯।
আমার ভাই দেবেশ চন্দ্র সান্যাল শাহজাদপুরের এম.পি.এ এ্যাড. মোঃ আব্দুর রহমানের সাথে ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমার ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সংবাদ শাহজাদপুর ও পোরজনা রাজাকার ক্যাম্প সহ সর্বত্র জানা জানি হয়ে যায়। মসুলিমলীগ নেতা মাও: ছাইফুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ পাকিস্তানি সৈন্যদের পক্ষে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে থেকে শাহজাদপুর থানা নিয়ন্ত্রন করেন। শাহজাদপুর রাজাকার ক্যাম্প থেকে রাজাকাররা এসে আমাদের পরিবারকে আলটিমেটাম দিয়ে যায় “দেবেশ’কে ৭ দিনের মধ্যে হাজির করে দিতে হবে। অন্যথায় আপনাদের সবাইকে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হবে এবং বাড়ি-ঘর লুট করে সব পুড়িয়ে দেওয়া হবে”। রাজাকারদের আলটিমেটামে আমরা সবাই দিশেহারা হয়ে পড়ি। কয়েক দিন আগে চরকৈজুরী রাজাকার ক্যাম্প নিয়ন্ত্রক ব্যরিষ্টার কোরবান আলীর নির্দেশে তাঁর ভাই মোঃ ছগির উদ্দিন ও অন্যান্য রাজাকারেরা পুঠিয়া গ্রামের প্রখ্যাত শিক্ষক হিতেন্দ্র চন্দকে রাতে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে বাড়ির পার্শ্বে অত্যাচার করে নৃশংস ভাবে গুলি করে হত্যা করেছে।
পোরজনা রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকার কমান্ডার মোঃ আতাউর রহমান আতার নেতৃত্বে কয়েকজন রাজাকার পোরজনা গ্রামের মনিন্দ্রনাথ ঘোষকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। চরকৈজুরী রাজাকার ক্যাম্পের একদল রাজাকার পাকিস্তানি আর্মিদের নিয়ে এসে বেলতৈল গ্রামে হানা দিয়ে হিন্দুদের বাড়ি-ঘর লুটপাট, অগ্নি সংযোগ করেছে। অনিল ও সুনিল ঘোষ নামক দুই সহোদরকে গুলি করে হত্যা করেছে। চারিদিকে বিভিন্ন অত্যাচার, লুটতরাজ, অগ্নি সংযোগ, ধর্ষন ও গণহত্যা হচ্ছে। ২৫ এপ্রিল’৭১ চরিয়া গ্রামে ১২৯ জন হিন্দু, মুসলমান নারী-পুরুষকে পাকিস্তানি হানাদারেরা গণহত্যা করেছে। দেশের অবস্থা ভয়াবহ। ১৪ মে’৭১ বেড়া থেকে লঞ্চ ভর্তি হয়ে ডেমড়া গ্রামে পাকিহানাদারেরা গ্রাম ঘিরে নিয়ে আমার চার দাদু সহ সাত শতাধিক মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। বেড়া থেকে পাকিস্তানি মিলিটারীদের নিয়ে গিয়েছিল আসাদ নামক একজন স্বাধীনতা বিরোধী।
কয়েক দিন আগে রতনকান্দি হাটের মধ্যে থেকে ধরে নিয়ে ভৈরব পাড়া গ্রামের নারায়ন চন্দ্র সরকারকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছে। তাঁর লাশ দরগার চর রেখে গিয়াছিল। চার পাশের অবস্থা দেখে শুনে দেশে থাকা নিরাপদ মনে হচ্ছিল না। আমাদের গ্রামের মুসলমানেরা খুব ভাল। তারা অসাম্প্রদায়িক। তারা আমাদের বাড়ি-ঘর পাহাড়া দিচ্ছে এবং আমাদের কোন ক্ষতি হবে না বলে আশ্বস্ত করছেন। কিন্তু শাহজাদপুর, পোরজনা ও কৈজুরী থেকে রাজাকারেরা এসে আমাদের ক্ষতি করিতে পারে। তাই আমার পিতৃদেব, মাতৃদেবী ও বড় দাদাসহ সবাই পরামর্শ করলেন। ০৪ সেপ্টেম্ব’৭১ আমাদের পরিবারের সবাই বাড়ি-ঘর সব ফেলে নৌকা পথে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন। বাড়ি থেকে বেলকুচি যাওয়ার পথে ধুকুরিয়া বেড়া বাজার থেকে কয়েক জন যুবক ছেলে এসে আমার বড় দাদার কাছ থেকে জোর করে তার সাইকেলটা নিয়ে গেল। বানিয়াগাতি গ্রামে বাসা ভাড়া করে কয়েক দিন থাকলাম।
এক দালালের মাধ্যমে ভারতে যাওয়ার জন্য ঠিক করলাম। যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদী পথে যেতে হবে । অনেক কষ্টে খেয়ে না খেয়ে নৌকা ভাড়া করে মুকুন্দগাতি ও বানিয়াগাতি হয়ে সিরাজগঞ্জের কাছে পোড়াবাড়ি গেলাম। পোড়াবাড়ি থেকে দালালের মাধ্যমে ভারত যাওয়ার জন্য আর একটা নৌকা ভাড়া করলাম। সেই নৌকায় কাজীপুর হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটের সামনে দিয়ে রৌমারী হয়ে ভারতের আসামের মানিকার চর পৌছালাম। যাত্রাপথে প্রতিটি মুহুর্ত ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। পাকিস্তানি সৈন্য বা রাজাকারদের হাতে ধরা পড়লে নিশ্চিত মৃত্যু। আমরা প্রথমে সবাই মানিকার চর শরনার্থী ক্যাম্পে ভর্তি হলাম। আমি এবং বড় দাদা দেবেন্দ্র নাথ সান্যাল কয়েক দিন শরনার্থী ক্যাম্পে রেশন বিতরণ কাজে সহযোগিতা করলাম। ভারতে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করতে থাকলাম। শুনলাম ভারত অল্প দিনের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ দেওয়া বন্ধ করে দিবে।
একদিন দেবেশের গ্রুপের জনাব মোঃ আব্দুল হামিদ তালুকদার আমাদের মানিকার চড়ের শরনার্থী ক্যাম্পে হাজির হলেন। ওনার মুখে দেবেশের সকল সংবাদ পেলাম। ওনাকে বললাম দেবেশের জন্য বাবা-মা প্রায় পাগল হয়েগেছেন। আমিও আপনাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যাবো। জনাব মোঃ আব্দুল হামিদ তালুকদার বললেন- “আমি ৭ নম্বর সেক্টরের হেড কোয়ার্টার তরঙ্গপুর যাচ্ছি। তরঙ্গপুর থেকে গোলা বারুদ নিয়ে এসে আপনাকে সাথে করে নিয়ো যাবো। ৪ দিন পর গোলা বারুদ নিয়ে ওনা আরো দুইজনকে সাথে নিয়ে মানিকার চর এলেন। আমি পিতৃদেব, মাতৃদেবী ও বড় দাদাসহ সবাইকে বলে ঝাঐল গ্রামের জনাব মোঃ আব্দুল হামিদ তালুকদারের সাথে নদী পথে বাহাদুরাবাদ ঘাট, কাজিপুর ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দিয়ে সিরাজগঞ্জ এলাম।
ঝাঐল এর জনাব আব্দুল হামিদ তালুকদার আমাকে বেলকুচি উপজেলার সমেশপুর নামক গ্রামের এক বাড়িতে রেখে জনাব এম.এ, মান্নান স্যারের গ্রুপের অবস্থান খুঁজতে গেলেন। তারপর ৩ দিন পর এসে জানালেন জনাব এমএ মান্নান স্যার তাঁর গ্রুপটি বড় হয়ে পড়ায় ভাগ করে ডেপুটি কমান্ডার বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচীকে কমান্ডার করে ১১ জনের আর একটি গ্রুপ করে দিয়েছেন, আপনার ভাই দেবেশ রবীন্দ্র নাথ বাগচীর গ্রুপে আছে। ঐ গ্রুপ দৌলতপুর বা আশেপাশের গ্রামে আছে, খুঁজে খুঁজে বের করে নিতে হবে। আমি একাকী শমেসপুর গ্রাম থেকে দৌলতপুর গ্রামে এলাম। বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচীর গ্রুপটি ছিল দৌলতপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মোঃ সামছুল হকের বাড়িতে।সে তখন আমার কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচীকে বললো আমার ভাই দেবেশের জন্য আমার বাবা- মা প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। আমি ভাইকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এসেছি।
দয়া করে আপনারা আমার ভাইকে ছেড়ে দিন আমি ভাইকে নিয়ে ভারতের মানিকার চর শরনার্থী ক্যাম্পে বাবা- মায়ের কাছে যাব। কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী আমার দাদার কথায় রাজী হলেন না। তিনি বললেন- দেবেশের নামে অস্ত্র ইস্যু আছে। দেশের অবস্থা ভাল না। তাকে এভাবে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। অল্প দিনের মধ্যে দেশ স্বাধীন হবে। বরং আপনিও আমাদের সাথে থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করুন। অন্য কোন উপায় না থাকায় আমার মেজদাদাও আমাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করলেন। কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী সহ সবাই- তাকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল চালানো, ক্রলিংকরা, হ্যান্ডগেনেড ছোড়া ও অন্যান্য যুদ্ধ কৌশল শিখালেন। আমরা দুই ভাই এক সাথে শাহজাদপুর উপজেলার ধীতপুর নামক স্থানে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি।
আমি ১৪ নভেম্বর’৭১ বেলকুচি উপজেলার দৌলতপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মোঃ শামসুল হকের বাড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলাম। আমাকে কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী গ্রুপের সাথে রেখে প্রশিক্ষণ দিলেন। আমার প্রধান প্রশিক্ষক কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী। তিনি আমাকে থ্রিনট থ্রি রাইফেল চালানো, ফুল থ্রু মারা, পরিষ্কার করা, ম্যাগজিনে গুলি ভরা, বেওনেট লাগানো, হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়া, ক্রোলিং করা ও অন্যান্য যুদ্ধ কৌশল শিখালেন। গ্রুপের অন্যান্যরাও অবসর সময়ে পিটি প্যারেট ও নিয়ম কানুন শিখালেন। গ্রুপ কমান্ডারসহ সবাই আমাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিলেন। আমি রবীন্দ্র নাথ বাগচীর কমান্ডাধীন হয়ে সকলের সাথে, দৌলতপুর, তেঞাশিয়া, খুকনী, বাজিয়ারপাড়া গ্রমে থাকতে থাকলাম। দিনের বেলায় আমরা আত্মগোপন করে থাকি।
দিনের বেলা বিভিন্ন রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করার জন্য ছদ্মবেশে রেকি করি। রাতে সেল্টার পরিবর্তন করি। প্রতি রাতে কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগ্চী আমাদেরকে পাসওয়ার্ড দিয়ে থাকেন। আমরা দিনে - রাতে আমাদের সেল্টার সেন্ট্রি দেই। পর্যায়ক্রমে সবাই দু’ঘন্টা করে করে সেন্ট্রি দেই। আমাদের গ্রুপে জামিরতা গ্রামের রবীন্দ্র নাথ বাগ্চী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অন্যান্যদের মধ্যে আমার ভাই দেবেশ চন্দ্র সান্যাল, দৌলতপুরের মোঃ শামসুল হক, কাদাই বাদলার মোঃ নজরুল ইসলাম, পুকুর পাড়ের রতন কুমার দাস, মিরকুটিয়ার চরের মোঃ নজরুল ইসলাম ও আরো কয়েকজন সহ ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমরা ছিলাম ৭ নম্বর সেক্টরাধীন। কমান্ডার বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী ও অন্যান্যদের কাছে শুনলাম আমাদের সেক্টর কমান্ডার লে: কর্ণেল কাজী নুরুজ্জামান, সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী। ২৩ নভেম্বর আমাদের গ্রুপ শেল্টার নিল শাহজাদপুর উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের কালা চক্রবর্তীর বাড়িতে।
২৫ নভেম্বর’৭১ টাঙ্গাইল থেকে একদল পাকিহানাদার যমুনা পাড় হয়ে মালিপাড়া হয়ে ঢাকায় পালিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের গ্রুপও এলাকায় বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ তাদের আক্রমণ করার জন্য পিছু ধাওয়া করলাম। পাকি হানাদার দল চরকৈজুরী হয়ে ওয়াপদা বাধ দিয়ে মার্চ করতে থাকলো। হানাদারেরা ছিল ক্ষুধার্থ। ওরা খুব ক্রোধি। ধীতপুর বাধে গিয়ে ওরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করলো। আমরা জাম্প করে ওয়াপদা বাধের পশ্চিম পার্শ্বে পজিশন নিলাম। পাকি হানাদারেরাও ওয়াপদার পূর্ব পার্শ্বে পজিশন নিয়ে আমাদের উপর গুলি চালালো। কমান্ডারের নির্দেশে আমরা গুলি চালাতে থাকলাম। আমি থ্রিনট থ্রি রাইফেল দিয়ে হানাদারদের উপর গুলি চালাতে থাকলাম।
আমার বামপার্শ্বে থ্রিনট থ্রি রাইফেল চালাতে লাগলো আমার ভাই দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী তার বাম পার্শ্বে এল.এম.জি নিয়ে গুলি চালালেন। আমার ডান পাশে ছিল মোঃ নজরুল ইসলাম, রতন কুমার দাস, মোঃ শামছুল হক ও অন্যান্যরা। শাহজাদপুর ও বেড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা দল আমাদেরকে সহযোগীতার আমাদের সাথে যুদ্ধে যোগ দিলেন। আমার গ্রুপের সবাই আমাদের দু’দিকে পজিশন নিয়ে এল.এম.জি, থ্রিনট থ্রি রাইফেল, স্টেনগান ফায়ার করছিলেন। তুমুল সম্মুখ যুদ্ধ চলতে থাকলো। ঘন্টা দুয়েক পর সন্ধ্যা হয়ে গেল। অন্ধকার নেমে এলো। তখন পাকিস্তানি হানাদারেরা গুলি করা বন্ধ করল।
গোলা গুলি কিছুটা কমে গেল। আমরা ওয়াপদা বাধের পশ্চিম পার্শ্বে পজিশন অবস্থায় থাকলাম। রাতে ধীতপুর সারগুদাম থেকে মাঝে মাঝে দু একটা করে গুলি আসছিল। আমরা ভেবে ছিলাম পাকি হানাদারেরা ধীতপুর সার গুদামে অবস্থান নিয়েছে। আমরা সারা রাত না খেয়ে পজিশন অবস্থায় থেকে মাঝে মাঝে দুই একটা করে গুলি করতে ছিলাম। সকাল হলে আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্র নাথ বাগচী ও বেড়ার এক গ্রুপ কমান্ডার জনাব মো: আমির হোসেন ও আরো কয়েক জন পজিশন অবস্থায় ক্রোলিং করতে করতে ধীতপুর সার গুদামে গেলেন। তিনি গিয়ে দেখলেন সার গুদামে দুই জন রাজাকারকে কভারিং ফায়ার করার নির্দেশ দিয়ে পাকি হানাদার মিলিটারীরা পালিয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল পাকি মিলিটারীরা ক্রোলিং করে নিরাপদ দূরত্বে এসে হেঁটে বেড়া খেয়াঘাট পর্যন্ত গেছে এবং বেড়া নদীতে রাখা ভেড়াকোলার জেলেদের নৌকায় নদী পার হয়ে বেড়া গেছে। সেখান থেকে নগরবাড়ি হয়ে ঢাকা যাবে। এই যুদ্ধে বেড়ার আমির হোসেনের গ্রুপের বৃশালিখা গ্রামের মোঃ আব্দুল বাতেনের ভাই আব্দুল খালেক নামক একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন এবং দু’জন পথচারী মারা গিয়েছিলেন। এই যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাই স্কুলে ক্যাম্প করলাম।
১৪ ডিসেম্বর’৭১ শাহজাদপুর উপজেলা হানাদার মুক্ত হলো। ১৬ ডিসেম্বর’৭১ নিয়াজী ৯১ হাজারাধিক পাকি সৈন্যের পক্ষে প্রতিকী হিসাবে ১০০ জন পাকিস্তানী আর্মি মাথানত করে যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করলো। জাতীয় ভাবে বিজয় অর্জিত হলো। শাহজাদপুর থানা চালাতে থাকলেন মুক্তিযোদ্ধা প্রশাসন। জনাব মোঃ আব্দুল বাকী মির্জা শাহজাদপুর থানার মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত হলেন। জনাব আব্দুল খালেক খান এর দল শাহজাদপুর থানায় অবস্থান নিলেন, অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ, দিলরুবা সিনেমাহল, রবীন্দ্র কাছারী বাড়ি, ডাক বাংলো ও অন্যান্য জায়গা অবস্থান নিলেন। ১০ জানুয়ারী’৭২ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে এসে ১২ জানুয়ারী রাষ্ট্রের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ গড়া শুরু করলেন। কয়কদিন পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদেরকে অস্ত্র জমা দিতে বললেন এবং ভারতীয় সৈন্যদেরকে এদেশ থেকে চলে যেতে বললেন।
আমরা ২৪ জানুয়ারী’৭২ রবিবার সিরাজগঞ্জস্থ অস্থায়ী অস্ত্র জমা ক্যাম্প ইব্রাহিম বিহারীর বাসায় সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী এর সম্মুখে লে: সাইফুল্লাহর কাছে অস্ত্র জমা দিলাম। তিনি অস্ত্র জমা নিয়ে আমাকে একটা করে অস্ত্র জমার রশিদ দিলেন। সিরাজগঞ্জে এস,ডি,ও অফিসের পশ্চিম পাশে ন্যাশনাল মিলেশিয়া ক্যাম্প স্থাপন করা হলো। আগ্রহী মুক্তিযোদ্ধাদের ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিলেন। আমরা দু ভাই মিলেশিয়ায় ভর্তি হলাম না। বাড়িতে চলে এলাম। কয়েক দিন পর সংবাদ পেয়ে এসডিও অফিস, সিরাজগঞ্জ গেলাম। আমার রাইফেল জমা দেওয়ার রশিদ ফেরত নিয়ে ১০০ টাকা, একটি সাদা কম্বল ও মুক্তিযুদ্ধের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী স্বাক্ষরিত ১২৭২১১ নম্বর সার্টিফিকেট দিলেন। আমি বাড়ি এসে লেখাপড়া শুরু করলাম। ১২ মার্চ’৭২ ভারতীয় সৈন্যদের বিদায়ী কুচ কাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। তাঁরা কুজ কাওয়াজে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্যালুট দিলেন। এই দিন ভারতীয় সকল সৈন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন।”
লেখক : বীরমুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক ব্যাংকার।