ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » সম্পাদকীয় » বিস্তারিত

আমায় ক্ষমা কর পিতা : পর্ব ১০

তোমার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম যে ব্যক্তিটি খুনি মোশতাককে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তিনি মাওলানা হামিদ খান ভাসানী, যাকে তুমি পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে

২০২৩ আগস্ট ১০ ০০:১১:০১
তোমার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম যে ব্যক্তিটি খুনি মোশতাককে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তিনি মাওলানা হামিদ খান ভাসানী, যাকে তুমি পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে

প্রবীর সিকদার

মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে ভারতে বেশ জামাই আদরেই ছিলেন মাওলানা হামিদ খান ভাসানী। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেশ শত্রুমুক্ত হলেও ভাসানী দেশে ফেরেন ২২ জানুয়ারি ১৯৭২। আগের দিন ২১ জানুয়ারি দেশে ফেরার পথে আসামের ফকিরগঞ্জে এক জনসভায় মাওলানা ভাসানী বলেন, 'মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর মতো দয়ালু মহিলা হয় না। ভারতের জনগণের সহানুভূতির কথা কোনও দিন ভুলবো না। স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।' আমার যতদূর মনে পড়ে বঙ্গবন্ধু মুজিবও তাকে পিতার মতোই শ্রদ্ধা করতেন। সম্ভবত ইত্তেফাকের প্রথম পাতাতেই একটি ছবি দেখেছিলাম। অসুস্থ ভাসানীকে দেখতে গিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে বলছেন, 'মুজিব আমার ছেলের মতো।'

দুর্ভাগ্য আমাদের, সেই মাওলানা ভাসানীই এক সময় স্বাধীন বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গোড়াপত্তন ঘটান! সেই ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির তথাকথিত প্রবক্তা ভাসানী এক সময় বলে ওঠেন, 'মুসলিম বাংলার জন্য যারা কাজ করছে তাদের আমি দোয়া করছি। আল্লাহর রহমতে তারা জয়যুক্ত হবে।' অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, 'মুসলিম বাংলা' প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনাটি জুলফিকার আলী ভুট্টোর। এই জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর বলেছিলেন, 'এই অবস্থা চিরস্থায়ী নয়। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য অঙ্গ।' পূর্ব পাকিস্তানকে আবার ফিরে পেতেই ভুট্টো 'মুসলিম বাংলা'র ফাঁদ পাতেন। আর মুজিবনগর সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা মাওলানা হামিদ খান ভাসানী হয়ে যান সেই 'মুসলিম বাংলার' প্রবক্তা ! রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি সম্বলিত ১৯৭২এর সংবিধান বাতিল করবার দাবি জানিয়ে ভাসানী বলেন, 'বাংলাদেশের সংবিধান অবশ্যই কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে প্রনীত হবে।' কী বিচিত্র ভাসানীর রাজনৈতিক অবস্থান !

পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির নামে সিরাজ সিকদারের নৃশংস খুনের রাজনীতি, ছাত্রলীগে বিভাজনের সূত্র ধরে জাসদের জন্ম, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের জাসদ শিবিরে ঠাই, কর্নেল তাহেরের গণবাহিনীর রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতা, নানা মুখি ষড়যন্ত্রের কুশীলবদের সঙ্গে ধুরন্ধর জিয়া-মোশতাকের সংযোগ আর ভাসানীর অবিশ্রাম বক্তৃতা-বিবৃতি এক সময় একাকার হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তা ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয়।

পিতা! তোমার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম যে ব্যক্তিটি খুনি মোশতাককে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, তিনি মাওলানা হামিদ খান ভাসানী, যাকে তুমি পিতৃজ্ঞানে শ্রদ্ধা করতে! একাত্তরের ইন্দিরা ও ভারত ভক্ত ভাসানী কোনও এক রহস্যের হাতছানিতে দ্রুতই শুধু ভারত বিদ্বেষী নয়, বাংলাদেশ চেতনা বিদ্বেষী হয়ে তোমার খুনিদের সাথে হাত মেলালেন! নাকি তোমার খুনের অন্যতম মদদদাতাও তোমারই পিতৃতুল্য ভাসানী! তারপরও ওই খোল পাল্টানো ভাসানীর প্রতি তীব্র ঘৃণা ছুড়ে দেওয়ার কোনও চেষ্টাই আমি করিনি ! কী অকৃতজ্ঞ, কী কৃতঘ্ন সন্তান আমি !

পিতা, আমায় ক্ষমা কর তুমি, ক্ষমা কর।