ঢাকা, রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

২০২৩ সেপ্টেম্বর ০২ ১৭:৪৬:৩৪
কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ ইতিমধ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে এবং সেসব দেশ দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, যে দেশে কারিগরি শিক্ষার হার যত বেশি সে দেশের মাথাপিছু আয়ও তত অধিক। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে অধিকসংখ্যক দক্ষ জনশক্তি থাকায় সেখানকার মানুষের বাৎসরিক মাথাপিছু আয় অনেক বেশি। অথচ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির সহায়ক শক্তি হিসেবে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার বিকাশ জরুরি হলেও তা অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে আছে।

শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বের কথা বারবার উচ্চারিত হলেও কার্যত সরকারি উদ্যোগ সেভাবে পর্যাপ্ত নয়। এমনকি সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষা গ্রহণরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক কম। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে স্বল্প সময়ে বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব।

বাংলাদেশের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি জড়িত। সেবামূলক জরুরি কাজেও তাদের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বর্তমান সময়ে প্রযুক্তির সান্নিধ্যে থেকে বাস্তবধর্মী ও হাতেকলমে শিক্ষাই হলো কারিগরি শিক্ষা। যে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে তথ্যপ্রযুক্তি, শিল্প, কৃষি ও কলকারখানার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মতভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অর্থাৎ আমাদের শ্রমবাজারকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে দক্ষ শ্রমিকে রূপান্তর ও দেশের শিল্পায়নের পথে কারিগরি শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বর্তমান ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে আমাদের দেশে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব এতটাই বেশি যে শতভাগ কর্মসংস্থাই তার প্রমাণ। আমাদের প্রয়োজন দক্ষ কারিগর ও দক্ষ অপারেটর সবাইকে বিএ, এমএ পাস করার দরকার নেই। কারণ এসব সার্টিফিকেটধারীকে চাকরি দেয়ার সুযোগ আমাদের এই দেশে নেই এবং বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত না হলে বিদেশেও চাকরির সুযোগ নেই বললেই চলে।

বর্তমান বিশ্বে চাকরির বাজারে উৎপাদনশীল খাতই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করে থাকে। বর্তমানে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিল্পায়নের ফলে নতুন নতুন শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠছে আর তাতে বিনিয়োগ করছে পৃথিবীর তাবত বড় বড় পণ্য ও সেবা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। এসব কারণেই আমাদের দেশে বর্তমানে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় উন্নত দেশগুলো কারিগরি শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দেশের উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও উপকরণ ব্যবহার ও কৌশল প্রয়োগ করে শিল্প ও কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কারিগরি শিক্ষা একটি উৎপাদনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা, যা দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। কারিগরি শিক্ষা শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে, এতে করে শ্রমিক সহজেই দেশীয় ও আন্তর্জতিক শ্রম বাজারে প্রবেশ করে দক্ষ জনশক্তি ও বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ বৃদ্ধি করে। কারিগরি শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়, প্রয়োজনীয় মূলধন অর্জন করে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন করা সম্ভব হয়।

কারিগরি দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চীন তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদে রূপান্তর করে শিল্পায়নে ইউরোপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনে, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে, আত্মকর্মসংস্থান, উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।কারিগরি শিক্ষা নানাভাবে শিক্ষার্থীকে কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষ করে তোলে। যেমন:- এক. উৎপাদনশীলতা: বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের একটি উৎপাদনমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত করে সমাজ ও দেশের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে; দুই. স্বনির্ভরতা: বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে স্বনির্ভর হতে সহায়তা করে। এই শিক্ষার ফলে শিক্ষার্থী হয় কোনো চাকরির সুযোগ পায় নয়তো আত্মকর্মসংস্থান ধরনের কাজে যুক্ত হতে পারে; তিন. জাতীয় আয় বৃদ্ধি: বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষা যেহেতু উৎপাদনভিত্তিক শিক্ষা, তাই এটি জাতীয় আয় বৃদ্ধি ও দেশের উন্নয়নে সহায়তা করে; চার. শ্রমের প্রতি মর্যাদা: সর্বশেষে এই শিক্ষার শিক্ষার্থীরা যেহেতু কায়িক শ্রমের মাধ্যমে অর্জন করে থাকে, সেহেতু এর মাধ্যমে তাদের শ্রমের প্রতি এক মর্যাদাবোধ সৃষ্টি হয়; পাঁচ. জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ: বৃত্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের উপায় তৈরি হয় ব্যতিক্রমী শিশুদের জন্য এই ধরনের বৃত্তিমূলক শিক্ষা খুবই প্রয়োজন, যার ফলে তারা কিছু উৎপাদন মূলক কাজে নিজেদের নিয়োগ করতে পারে এবং অর্থ উপার্জনে সক্ষম হয়; ছয়. কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি: পুঁথিগত নীরস একঘেয়েমি থেকে নিজেকে দূর করে ব্যবহারিক ও হাতেকলমে শিক্ষায় তাদের উৎসাহ বৃদ্ধি একপ্রকার ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে; সাত. কর্মের সুযোগ: বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা শিক্ষার্থীদের কর্মের দক্ষতা বৃদ্ধি করে যে চাকরি বা কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করে।

কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয় ও পরিকল্পিত বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমেই কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিহিত। প্রশিক্ষিত মানবসম্পদের জোগান দেয়াই হলো কর্মমুখী ও কারিগরি শিক্ষার মূল লক্ষ্য। সর্বোপরি কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার মাধ্যমেই আমাদের দেশের শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সম্ভব।


লেখক : উপপরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।