প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মকথা ও জন্মাষ্টমী
২০২৩ সেপ্টেম্বর ০৫ ১৫:৫৪:১৩গোপাল নাথ বাবুল
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা, ধর্মীয় আড়ম্বরপূর্ণ উৎসবের মধ্য দিয়ে প্রতিবছরের ন্যায় ৬ সেপ্টেম্বর বুধবার বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে সনাতনী সম্প্রদায়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব জন্মাষ্টমী উদযাপন করা হচ্ছে। জন্মাষ্টমী মানে যুগ পুরুষোত্তম, পরমাত্মা, মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মদিবস। এবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ৫২৪৯তম জন্মদিবস পালন হচ্ছে। এ শুভদিনে সব অকল্যাণ ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে অন্তরাত্মাকে জাগ্রত করার শপথ নেবেন কৃষ্ণপ্রেমীরা।
সনাতন শাস্ত্র মতে, বিশ্ব যখন ঘোর অন্ধকারে এবং মারাত্মক পাপ ও অরাজকতায় পরিপূর্ণ হয়েছিল তখন স্বয়ং পরমেশ্বর শ্রী শ্রী বিষ্ণুর মানবরূপী মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এ ধরাধামে অবতীর্ণ হন। উদ্দেশ্য-দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন ও ধর্ম রক্ষা। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে দুর্বলের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং শান্তিহীন পৃথিবীতে শান্তি ফিরিয়ে আনতেই শান্তিদাতা শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব হয়েছিল। তাঁর শিক্ষা হলো-অন্যায়কে পরাভূত করে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করা।
নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে শ্রীকৃষ্ণ মানবজাতির কাছে জীবন ধারণের অনন্য উদাহরণ রেখে গেছেন। ঈশ্বরতত্ত্বের মহান প্রতীক শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবতগীতায় অবতারকৃষ্ণ ও পুরুষোত্তম কৃষ্ণ, বেদে ঋষিকৃষ্ণ ও দেবতাকৃষ্ণ, মহাভারতে রাজর্ষি কৃষ্ণ, শাসক ও প্রজাপালক কৃষ্ণ, অত্যাচারী দমনে যোদ্ধা কৃষ্ণ, ইতিহাসে তিনি যাদবকৃষ্ণ, দর্শনশাস্ত্রে সচ্চিদানন্দ বা দার্শনিক কৃষ্ণ নামে পরিচিত। তাঁর বাণী সমগ্র বিশ্বকে হাজার হাজার বছর ধরে আলোড়িত করছে। মানবরূপে পৃথিবীতে আবির্ভাবের কারণ হিসেবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় বলেছেন,
“যদা যদা হি ধর্ম্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমর্ধম্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্।
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।
ধর্ম্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।” (জ্ঞানযোগ-৭/৮)
অর্থাৎ যখনই ভারতে ধর্মের গ্লানি হয়, অধার্মিকদের অত্যাচার বেড়ে যায়, তখনই সাধুদের ও ধর্ম রক্ষার জন্য আমি যুগে যুগে অবতীর্ণ হই। তিনি বিভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়ে সাধু ও ধর্ম রক্ষা করে তাঁর কথা রেখেছেন। সেবারও তিনি অত্যাচারী কংসের হাত থেকে ধর্ম ও সাধুদের রক্ষার জন্য বসুদেব ও দেবকির গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কংস, জরাসন্ধসহ অত্যাচারী রাজাদের বধ করে তিনি সাধু ও ধর্মকে রক্ষা করেছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের এ জন্মতিথিই জন্মাষ্টমী নামে পরিচিত।
পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রয়েছে ঐতিহাসিক পটভূমি। ইতিহাসের আলোকে এবং সনাতন ধর্মীয় বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আজ থেকে ৫ হাজার ২৪৯ বছর পূর্বে কয়েকজন অত্যাচারী অসুর বিশ্ব শাসন করতেন। তাঁদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে দেবদেবীগণ ক্ষীর সমুদ্রের তীরে বসে ভগবানের কৃপা প্রার্থনা করতে থাকেন। তাঁদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে শুধুমাত্র ব্রহ্মার অবগতির জন্য দৈববাণী হলো, “হে ব্রহ্মা, আমি খুব তাড়াতাড়ি যদুবংশীয় রাজা উগ্রসেনের মথুরায় সুরসেনের পুত্র বসুদেবের সন্তান রূপে দেবকীর অষ্টম গর্ভে আবির্ভূত হবো। ধরিত্রী দেবীসহ সবাই আমার নির্দেশ অনুসারে দ্বারকা, মথুরা এবং ব্রজের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জন্মগ্রহণ করবেন।”
আবার অন্যদিকে অত্যাচারী কংস কঠোর আরাধনায় বর লাভ করেছিলেন, তাঁর কাকাতো বোন দেবকীর (উগ্রসেনের ভাই দেবকের সাত কন্যার একজন) অষ্টম সন্তান ছাড়া অন্য কোনোভাবেই তাঁর মৃত্যু হবে না। এ কারণেই কংসের অত্যাচারের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
দ্বাপরযুগের শেষদিকে যখন সমগ্র ভারতবর্ষে হানাহানি, রক্তপাত, সংঘর্ষ, রাজ্যলোভে রাজন্যবর্গের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ তথা বিশৃঙ্খলায় পরিণত হয় ঠিক তখনই সৃষ্টি স্থিতি-প্রলয়ের যুগ সন্ধিক্ষণে স্বয়ং বিষ্ণু অবতারের আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়ে। মানবতাবাদী চরিত্রে চিত্রিত যুগ পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে রোহিণী নক্ষত্র যোগে মথুরা ভোজবংশীয় রাজা উগ্রসেনের পুত্র অত্যাচারী কংসের কারাগারে এক বৈরী সমাজে অত্যাচারী ও দুর্জনের বিরুদ্ধে শান্তিপ্রিয় সাধুজনের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালনের লক্ষ্যে বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম সন্তানরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। কারাগারের ঘোর অমানিশার অন্ধকারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলেই শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রং শ্যামল, অন্য অর্থে ধূসর, পীত অথবা কালো। ওই সময় দুরাচারি রাজা কংস রাজধর্ম, কুলাচার, সদাচার ভুলে গিয়ে স্বেচ্ছাচারিতা, অন্যায়, অবিচারে মত্ত হয়ে ওঠেছিলেন। নিজের জন্মদাতা পিতা উগ্রসেনকে কারাগারে নিক্ষেপ করে জোরপূর্বক মথুরার সিংহাসন দখল করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন কংসের শ্বশুর জরাসন্ধ, চেদিরাজ, শিশুপালসহ অনেক রাজা।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মতে, পাশবিক শক্তি যখন ন্যায়নীতি, সত্য ও সুন্দরকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিল, তখন সেই অশুভ শক্তিকে দমন করে মানবজাতির কল্যাণ এবং ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য বিষ্ণুর অষ্টম অবতার রূপে মহাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁর আবির্ভাব বিশ্বের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। নির্যাতীত-নিপীড়িত মানুষকে রক্ষায় তিনি পরিত্রাতার ভূমিকা পালন করেন এবং অন্ধকার সরিয়ে তিনি এ ধরাধামকে আলোয় উদ্ভাসিত করেন।
উল্লেখ্য, কংসের সঙ্গে মগধের অধিপতি অত্যাচারী জরাসন্ধের দুই মেয়ের বিয়ের পূর্বে মথুরার রাজা ছিলেন কংসের পিতা উগ্রসেন। জরাসন্ধ ১৮ বার মথুরা আক্রমণ করেন। কিন্তু ধার্মিক, ন্যায়বান ও পরাক্রমশালী শাসক উগ্রসেনের প্রতিরোধের মুখে প্রতিবারই মথুরা দখলে ব্যর্থ হন। ফলে গ্লানিতে প্রায় অস্থির জরাসন্ধ হীনস্বার্থে কুটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে উগ্রসেনের ক্ষমতালোভী পুত্র কংসকে নিজদলে ভিড়িয়ে নিজের দুই মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ফলে অত্যাচারী জামাই-শ্বশুর অত্যাধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং প্রতিশোধস্পৃহায় মত্ত জরাসন্ধের মন্ত্রণায় কংস নিজের বৃদ্ধ পিতা উগ্রসেনকে কারাগারে নিক্ষেপ করে মথুরার ক্ষমতা দখল করেন। এতে অত্যন্ত দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিশেষ করে যাদবরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন এবং কংসের এমন কর্মে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন।
ফলে কংস তাঁর আত্মীয়-স্বজন ও যাদবকুলকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে কৌশল হিসেবে যাদব বংশের শুরসেনের পুত্র তাঁরই বন্ধু বসুদেবের সঙ্গে প্রিয় কাকাতো বোন দেবকীর বিয়ে দিয়ে নিজে রথের সারথি হয়ে বসুদেবসহ দেবকীকে বিদায় জানাতে যাওয়ার সময় দৈববাণী শুনতে পান, আরে মুর্খ কংস, তুমি জানো এই দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান তোমার মৃত্যুর কারণ হবে ? দৈববাণী শুনে কংস মৃত্যুর আশঙ্কায় উম্মাদ হয়ে চুলের মুঠি ধরে রথ থেকে নামিয়ে দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হলে স্ত্রীকে বাঁচাতে বসুদেব এগিয়ে যান। তিনি কংসকে আশ্বস্ত করলেন যে, তাদের প্রত্যেকটি সন্তান জন্মের পরই তার হাতে তুলে দেবেন। এতে কংস বোনকে হত্যা না করে দু’জনকেই কারাগারে বন্দী করে রাখেন।
অথচ কংস বোন দেবকীকে প্রাণাধিক ভালোবাসতো। কিন্তু স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটতেই নিমিষে সব ভালোবাসা হাওয়া হয়ে গেল। কারণ, যারা অসুর প্রকৃতির তাদের মনোভাব এমনই হয়।
প্রতিশ্রুতিমতো বসুদেব তাঁদের প্রথম সন্তানকে কংসের হাতে তুলে দিলে কংসের একটু মায়া হয়। কারণ, তাঁকে বধ করবে দেবকীর অষ্টম সন্তান। প্রথম সন্তানকে হত্যা করে কী লাভ ? এমন ভাবতেই দেবর্ষি নারদ এসে কুমন্ত্রণা দেন। এরপর একে একে বসুদেব-দেবকী দম্পতির ৬ সন্তানকে কংস পাথরের ওপর আছাড় দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। সপ্তম সন্তান বলরাম যখন দেবকীর গর্ভে আসেন তখন ভগবানের নির্দেশে দেবী যোগমায়া দেবকীর গর্ভ হতে তাঁকে নন্দালয়ে বসুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী রোহিণীর গর্ভে স্থানান্তর করেন। সেখানে বলরামের জন্ম হয়। এদিকে প্রচার করা হয় দেবকীর গর্ভপাত হয়েছে।
এবার অষ্টম গর্ভের সন্তান অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মগ্রহণ করার পালা। মৃত্যুর আশঙ্কায় উৎকণ্ঠিত কংস হয়ে ওঠে দিশেহারা। কারাগারের বাইরে পূর্বের চেয়ে কংস আরও বেশি পাহারার ব্যবস্থা করলেন। উপস্থিত হলো কাঙ্খিত সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথি। ভীষণ দুর্যোগময় রাত। প্রবল ঝড় বৃষ্টিতে প্রকৃতি ধারণ করে এক অন্যরকম মূর্তি। মধ্যরাত্রির নিবিড় অন্ধকারে ভূবন আবৃত। সবাই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। এমন সময়ে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী চতুর্ভূজ মূর্তিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে আবির্ভূত হন। বসুদেব ও দেবকী বিস্ময়-বিস্ফোরিত চোখে প্রত্যক্ষ করেন শ্রী ভগবানের সেই জ্যোতির্ময় আবির্ভাব। অভিভূত দেবকী-বসুদেব নয়নভরে দেখেন অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত মনোহর শিশুটিকে চতুর্ভূজ বর্ণমালা পরিহিত অবস্থায়। বক্ষে শ্রীবৎস চিহ্ন, সারা অঙ্গে মণিমুক্তাখচিত বহু মূল্যবান অলঙ্কারাদি। ভগবানের আবির্ভাবের ক্ষণটিও সর্বসুলক্ষণযুক্ত, ঐশ্বর্যমন্ডিত তাৎপর্যে উদ্ভাসিত। তাঁরা বুঝতে পারলেন, জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণবক্ষ নারায়ণই জন্মগ্রহণ করেছেন তাঁদের ঘরে। বসুদেব কড়জোরে প্রণাম করে বন্দনা শুরু করলেন। দেবকী প্রার্থনা শেষে একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করতে বললেন শ্রীকৃষ্ণকে।
এমন সময় দৈববাণী শোনা যায়, “বসুদেব, তুমি এখনই গোকুলে গিয়ে নন্দের স্ত্রী যশোদার পাশে তোমার ছেলেটিকে রেখে এই মুহূর্তে জন্ম নেওয়া তাঁর কন্যা শিশুটিকে নিয়ে এসে দেবকীর কোলে শুয়ে দাও। আমার মায়ায় পৃথিবীর মানুষ এখন গভীর ঘুমে অচেতন, যার ফলে কেউ কিছুই জানতে পারবে না।”
কারাগারের তালা এমনিতেই খুলে গিয়েছিল। প্রহরীরা গভীর নিদ্রায় মগ্ন। বাইরে প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে বসুদেব তাঁর সন্তানকে নিয়ে বৃন্দাবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। পথে যমুনা নদী। বর্ষাকাল, তাই যমুনা কানায় কানায় পূর্ণ। এ যমুনা পাড়ি দেওয়া অসম্ভব মনে হলো তাঁর। কিন্তু ভরা ভাদ্রের প্রমত্তা যমুনাও কৃষ্ণগমনের পথ সুগম করে দেন। হঠাৎ দেখলেন, একটা শৃগাল যমুনা নদী পার হচ্ছে। বসুদেব তখন ওই রূপধারী শৃগালকে পথ প্রদর্শক মনে করে শৃগালটির পিছন পিছন যমুনা পার হয়ে গেলেন। অঝোর বারিধারার সিঞ্চন থেকে শ্রীকৃষ্ণকে বাঁচাতে নাগরাজ তাঁর বিশাল ফণা বিস্তার করলেন তাঁদের মাথার ওপর। এসবই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অলৌকিক ঐশ্বর্যের প্রকাশ। কিছু সময়ের মধ্যে বসুদেব তাঁর সন্তানকে মা যশোদার কোলে রেখে যশোদার সদ্যজাত কন্যা যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এলেন।
পরদিন ভোরে কংস সেই শিশুটিকে বধ করতে উদ্যত হলে হাত থেকে ফসকে সেই কন্যা সন্তান মা দুর্গার রূপ ধারণ করে বললেন, “ওরে মূর্খ, তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।” এ কথা শুনে কংস মথুরার সকল শিশুদের মারার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু অন্তর্যামী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুরাচারি কংসের এ পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেন।
সনাতন ধর্মীয় শাস্ত্র থেকে জানা যায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এ পৃথিবীতে ১২৫ বছর লীলা বিলাস করেছিলেন। তার মধ্যে ১২ বছর বৃন্দাবনে লীলা করেছিলেন। এ সময় কংস শ্রীকৃষ্ণকে হত্যা করতে বিভিন্নভাবে প্রয়াস চালান। কংসের নির্দেশে শ্রীকৃষ্ণকে বিভিন্ন কৌশলে হত্যা করতে গিয়ে পুতনা রাক্ষসী, কালীয়নাগের মতো বিশাল দৈত্যাকৃতি বিভিন্ন অসুররা প্রাণ হারান।
বৃন্দাবনে ১২ বছরের লীলা শেষ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় গিয়ে কংস, চেদিরাজ, শিশুপাল সহ বিভিন্ন অত্যাচারীদের বিনাশ করেন এবং ভীমকে দিয়ে জরাসন্ধকে হত্যা করেন। এসব দৈত্যাকৃতি অসুরদের বিরুদ্ধে তাঁর একক হামলা এবং তাদের পরাস্ত করার কৌশলাদি যে কোনও চৌকশ মেধাবী সামরিক দুর্ধর্ষতাকেও হার মানায়। এরপর শ্রীকৃষ্ণ পঞ্চপান্ডবদের পক্ষ নিয়ে অস্ত্র ধারণ না করে অর্জুনের রথের সারথি হয়ে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মাধ্যমে অত্যাচারী দুর্যোধন-দুঃশাসন প্রভৃতিকে বিনাশ করেন। এখানেই পরম পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় ১৮টি অধ্যায়ের মাধ্যমে জাগতিক জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি, মুক্তি, মোহ, যশ, খ্যাতি, অর্থ-বিত্তের মায়াজাল, অন্যায়-অবিচার প্রভৃতি সম্পর্কে জ্ঞানদান করেন এবং মানব জীবনের মুক্তির ও পাপমুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেন। তাঁর দিব্য জন্ম মানবতার বিশ্ব গড়ে সুন্দর ও সুখময় জীবনযাপনের নির্দেশনা দেন।
মহাভারতের যুদ্ধ শেষে তিনি অনেক বছর দ্বারকা নগরী শাসন করেন। এ সময় বলরাম গহীন বনে গিয়ে যোগবলে দেহত্যাগ করেন এবং ১২৫ বছর লীলা শেষ করে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তমাল গাছের নিচে এক ব্যাধের শরাঘাতে ইহলীলা সাঙ্গ করে এ ধরাধাম ত্যাগ করেন।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতে, প্রথাগত বৈদিক ধর্ম ও তার দেবদেবীর বিরুদ্ধে কৃষ্ণের এই অবস্থান, আধ্যাত্মিক ভক্তি আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হয়ে উঠেছে। জীবকুলে তিনি সত্যের বাণী স্থাপন করেছেন। ন্যায়ের পক্ষে ভগবদ্ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করে জীবশিক্ষার জন্য বিভিন্ন কর্ম করেছেন। আগামী দিনে সত্যের পথে চলার মত আলোকবর্তিকারূপে বিভিন্ন শিক্ষা দিয়ে গেছেন। আর এই কারণেই সকল সময়ে সর্বত্র তাঁর স্তব হয়। তিনি জগৎশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ বলেই যুগে যুগে উচ্চারিত হবে তাঁর নাম। ‘কৃষ’ মানে সত্তা আর ‘ণ’ এর অর্থ হল আনন্দ। এই দুই মিলিয়েই তিনি কৃষ্ণ। সেই পরমপুরুষ মহাবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথিতে পৃথিবী থেকে দুর হোক সকল অসত্য, অন্যায়, অধর্ম।
তাই আসুন, আমরা এ দিনটির অমর বার্তায় অভিস্নাত হয়ে নিজেদের জীবনকে উজ্জীবিত করে সবাই শুচিস্নাত হই জন্মাষ্টমীর পবিত্র পরশে এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মতিথিতে প্রার্থনা করি যেন, বিশ্বব্যাপি শান্তি বিরাজ করুক, বিভিন্ন দেশে বিরাজমান যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ হোক, আলোকিত হোক মানবসমাজ। খুলে দিক মানবিক চোখ। কারণ, ধর্ম সব সময় সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।