প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিপর্যয়
২০২৩ ডিসেম্বর ০৬ ১৫:৩৯:৩৮গোপাল নাথ বাবুল
সামনে নির্বাচন। স্বভাবত মিছিলের উম্মাদনায় সারাদেশ নিমজ্জিত। পাড়া-মহল্লায়, অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ করে চা স্টলে বিভিন্ন দল ও দলের প্রার্থীদের নিয়ে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কসহ বিপুল আনন্দে মেতে ওঠলেও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনে শান্তি নেই। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে আতঙ্ক বেড়ে যায়। প্রতিটি নির্বাচন ডেকে আনে সংখ্যালঘুদের জন্য বিপর্যয়। যে দলই ক্ষমতায় আসুক না কেন, মার খেতে হয় সংখ্যালঘু মানুষদের। ধর্ষিত হতে হয় তাদের মা-বোনদের। আগুন দেওয়া হয় তাদের বাড়ি-ঘরে। লুঠ হয় তাদের সহায়-সম্পদ। নির্বাচনের আগে ও পরে সমানতালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা চলতে থাকে। তার ওপর এবার বিএনপি-জামাত এখনো পর্যন্ত গাড়িতে আগুন দেওয়া সহ নানা রকম সন্ত্রাসি ঘটনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনী নির্যাতন। প্রথম সারির জাতীয় দৈনিক ‘বাংলা ৭১’ পত্রিকায় খবর হয়েছে, আতঙ্কে গোপালগঞ্জের দুই শতাধিক হিন্দু পরিবার। প্রকাশ্যে দুই হিন্দু পরিবারের ৪টি গরু দুর্বৃত্তরা গোয়াল ঘর থেকে খুলে নিয়ে রওনা হলে পরে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে দুর্বৃত্তদের কাছ থেকে গরুগুলো ফেরত নেন হিন্দু পরিবার দু’টি। সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তরা হিন্দু পরিবারগুলোকে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। অনেকের কাছ থেকে টাকা আদায় করছে। স্থানীয় প্রশাসনকে জানিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না।
একই পত্রিকার রিপোর্টার বরিশাল থেকে ২৮ কিলোমিটার দুরের বানারীপাড়া উপজেলা সরোজমিনে ঘুরে এসে জানান, বিএনপি’র সন্ত্রাসীরা প্রতিবারের মতো এবারও এই উপজেলার চারটি গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হয়রানি শুরু করেছে। রিপোর্টার আরো জানান, যখনই নির্বাচনের ঘোষণা আসে, তখন থেকেই আতংক আর নিরাপত্তাহীনতার বেড়াজালে আটকে যায় বানারীপাড়ার চারটি গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এবারও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। কোনো নির্বাচনেই তারা সহজে ভোট দিতে পারেননি। এরা যেন ভোট দিতে না পারেন সেজন্য থাকে সতর্ক প্রহরা। এখন থেকেই তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। চারটি গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আশঙ্কা করছেন, এবারও বোধহয় তাদের ভোট দেওয়া হবে না। ইতিমধ্যে তাদের নেতৃত্বস্থানীয়দের ওপর হামলা শুরু হয়েছে। অত্যাচার ও নির্যাতনে টিকে থাকতে না পেরে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক মুক্তিযোদ্ধা ও নারী ইউপি সদস্য এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সন্ত্রাসীরা হুমকি-ধামকি দিয়ে বলেছে, ধানের শীষে ভোট না দিলে গ্রামে থাকতে দেবে না। এই ব্যাপারে প্রশাসনকে অবহিত করার পরেও প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
মূলত ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পর থেকেই ধর্মীয় মৌলবাদীরা নতুন পরিস্থিতিতে নিজেদের নতুনরূপে আত্মপ্রকাশ শুরু করে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখলদাররা দ্রুত উপলব্ধি করেছিল যে, এদেশের মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি সঙ্গে রাখা গেলে দখলদারিত্ব বজায় রাখা সহজ হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানি ভাবধারা প্রচলনের রূপকার জিয়াউর রহমান সরকারের সময় থেকে এদেশে খোলাখুলিভাবে রাষ্ট্রীয় মদদে সাম্প্রদায়িক উস্কানিসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটতে থাকে এবং সংখ্যালঘুদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করে। ৫ম সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রহমানীর রহিম’ যুক্ত করার আড়ালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশের বৈধতা দিয়েছিল। ৫ম সংশোধনীর ৯ বছর পর আরেক পাকিস্তানি মনোভাবাপন্ন জেনারেল ১৯৮৮ সালে ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতির পরিপন্থী ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ সংবিধানে সংযুক্ত করেন। তার ধারাবাহিকতায় জিয়া ও এরশাদ সরকারের সামরিক শাসনের অধীনে হওয়া ৭৯, ৮৬, ৮৮ এর নির্বাচনগুলো প্রহসনের নির্বাচনে পরিণত হয়। এরপর প্রথমবারের মতো সর্বপ্রথম সামরিক শাসকদের ইঙ্গিতে ভারতের বাবরি মসজিদ ইস্যুকে কেন্দ্র করে স্বাধীন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয়।
এর মাত্র চার মাস পর ১৯৯১ সালের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সাম্প্রদায়িক ও কালো টাকার প্রভাবে প্রভাম্বিত সিভিল ও মিলিটারি ব্যুরোক্রেসী মিলিয়ে সে নির্বাচনকে অনেকটা পক্ষপাতদুষ্ট করে তোলায় মুক্তবাজার অর্থনীতির কল্যাণে লুঠপাটের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর প্রভাবে এবং জিয়া-এরশাদের ধারাবাহিক সামরিক শাসনের বদৌলতে শক্তিশালী হয়ে ওঠা পাকিস্তানি ভাবধারার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তির নোংরা ধর্মভিত্তিক বিএনপি-জামাত জোটের কাছে অবিশ্বাস্যভাবে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অসম্প্রদায়িক শক্তির ১৫ দলীয় জোট পরাজিত হয়। ফলে সে নির্বাচন লুঠেরা অর্থনীতির প্রভাবে গড়ে ওঠা কালো টাকার মালিকদের ও সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ ধর্মাশ্রয়ী সমাজ-সংস্কৃতি এবং রাজনীতিকে সাংবিধানিকভাবে বৈধতা প্রদান করে। এর ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রীয় মদদে ১৯৯২ সালের ৭ ডিসেম্বর আবারো বাবরি মসজিদকে ইস্যু করে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয়। মনে পড়ে, ওপরের নির্দেশে সে সময় নির্যাতীত হিন্দু সম্প্রদায়ের কোনো মামলা পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। অথচ তখন খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী।
১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত হিন্দু নির্যাতনের ধারাবাহিকতা চলে। তারপর শাহাবুদ্দিন ও লুৎফর রহমান সরকারের কল্যাণে ২০০১ সালে কালো টাকা ও সাম্প্রদায়িক শক্তির মদদে সিভিল এবং মিলিটারী ব্যুরোক্রেসীকে বিভ্রান্তির জালে আবদ্ধ করে আবারো সীমাহীন কারচুপির মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় চলে আসে। এই নির্বাচনের পূর্বে রাষ্ট্রীয় মদদে শুরু হওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নির্বাচনের পরে মারাত্মক আকার ধারণ করে। কয়েক মাস যাবত রাষ্ট্রীয় মদদে লেলিয়ে দেওয়া বিএনপি-জামাতের গুন্ডাদের কর্তৃক ওপেন খুন, গণধর্ষণ, বাড়ি-ঘরে অগ্নি সংযোগ, সম্পদ লুঠপাট সহ ব্যবসা-বাণিজ্য, জায়গা-জমি জোর-জবর দখল চলতে থাকলেও তৎকালীন খালেদা জিয়া সরকার এই ব্যাপারে একেবারে উদাসীন ছিলেন। সরকার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীদের কোনো প্রকার প্রতিরোধের চেষ্ট করেনি, কোনো প্রকার বাধাও দেয়নি। এমন কী কোনো থানায় মামলা পর্যন্ত নিতে দেয়নি। এই সময় অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বরিশালের আগৈলঝারার অনেক লোক রামশীলে এসে খোলা মাঠে আশ্রয় নেন। ৮ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার দেলুয়া গ্রামের অনিল শীলের কিশোরী কন্যা পূর্ণিমা শীল বিএনপি-জামাত জোট সরকারের লেলিয়ে দেওয়া গুন্ডাদের কর্তৃক ধর্ষিত হলে এর ৩/৪ দিন পর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি পূর্ণিমাকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করলে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার জন্ম দেয় এবং সারাবিশ্ব বিস্মিত হয়ে পড়ে।
বলা যায়, বিএনপি-জামাত জোট সরকার যতবার এসেছে, ততবারই এই দেশের সংখ্যালঘুরা নির্যাতীত হয়েছে, সহায় সম্পদ হারিয়েছে, নারীরা সম্ভ্রম হারিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছে।
তারপরও সংখ্যালঘুরা একটা ভরসা পেতেন যদি আওয়ামীলীগ তার চরিত্র না হারাতো। এক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী প্রতিক্রিয়া শক্তিকে প্রতিরোধের পরিবর্তে ক্ষমতার প্রত্যাশায় ধর্মাশ্রয়ী মূল্যবোধ, রাজনীতি ও লুঠপাটের অর্থনীতির ধারায় নিজেই গা ভাসিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রকে আরো পিছনে চলে যাবার সুযোগ করে দেয় এবং সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিকাশকে বৈধতা প্রদান করে। ফলে গণতন্ত্রের মূল উপাদান ‘অসম্প্রদায়িকতা’ আওয়ামীলীগের কাগুজে শ্লোগানে পরিণত হয়।
২০০১ সালে ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামীলীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় জনগোষ্ঠী ওপর সারাদেশে অসংখ্য হামলা, ধর্ষণ, লুন্ঠন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সংঘটিত হয়। ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠনের পর ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনের পর সহিংসতার ঘটনা তদন্তে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের নির্দেশনা চেয়ে ‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’-এর পক্ষে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে রিট করা হয়।
প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের মে মাসে রুল জারি করেন আদালত। চূড়ান্ত শুনানি শেষে ওই বছরের ৬ মে হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে দুই মাসের মধ্যে তদন্ত কমিশন গঠন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর সাবেক জেলা জজ ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. শাহবুদ্দিন চুপ্পুকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি কঠোর পরিশ্রম এবং বিভিন্নভাবে সুষ্ঠ তদন্তের পর ২০১১ সালের ২৪ এপ্রিল ৫ খন্ডে ১ হাজার ১০০ পৃষ্টার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় সরকারের কাছে। কিন্তু ওই প্রতিবেদন জনসমক্ষে প্রকাশ করার জন্য আবার আদালতের শরণাপন্ন হতে হয়। এরপরও সরকার কারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় ঢাকায় ২৭৬টি, চট্টগ্রামে ৪৯৭টি, সিলেটে ১৭টি, খুলনায় ৪৭৮টি, রাজশাহীতে ১৭০টি এবং বৃহত্তর বরিশালে সবচেয়ে বেশি ২ হাজার ২২৭টি সাম্প্রদায়িক সহিংস ঘটনার প্রমাণ মেলে। এরমধ্যে ঢাকায় ১৮৪টি ধর্ষণ এবং গণধর্ষণ, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে সর্বশান্ত করে দেওয়া ও অন্যান্য অপরাধ সংঘটিত হয় এবং ৯২ জনকে হত্যা করা হয়, চট্টগ্রামে গুরুতর সাম্প্রদায়িক অপরাধ সংঘটিত হয় ৩৫০টি এবং ৯৭ জনকে হত্যা করা হয়, রাজশাহীতে হত্যা করা হয় ৫০ জনকে এবং গরুতর অপরাধ হয় ১১৭টি, খুলনাতে হত্যা করা হয় ৭৩ জনকে এবং গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হয় ৪০৫টি।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো যে, ২০০১ সাল থেকে এমন নৃসংশভাবে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আজ পর্যন্ত একটি ঘটনারও বিচার হয়নি। এর আগে জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়ার প্রথম আমলে অর্থাৎ ৭৫ এর পর থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সময়ে সংঘটিত কোনো ঘটনারও কোনো বিচার হয়নি। এমনকি, ২০১২ সাল থেকে কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লা, রংপুর, ভোলাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে বিএনপি-জামাত, হেফাজত ইসলাম ও আওয়ামীলীগের বিভিন্ন নেতা-কর্মীদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও তাদের বিচারের আওতায় আনা হলো না। উপরন্ত নাসিরনগরের ঘটনায় জড়িত আওয়ামীলীগের দুই নেতাকে পুরষ্কার হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া হয়। পরে তীব্র সমালোচনার মুখে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। যার কারণে বারবার সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক ঘটনার জন্ম দিতে উৎসাহি হয়েছে এবং আমাদের ভয়ও সমানে বেড়ে যায়। তাছাড়া, গত ১১ বছরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যাপর্ণের কাজটি সময়মতো শেষ হলো না। ফলে এখনো হিন্দু সম্প্রদায় কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে আদালতের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
কারণ ধর্মনিরপেক্ষতা কেবল কেতাবি বিষয় হয়েই আছে বাংলাদেশে। ফলে হিন্দুদের বিরুদ্ধে ওয়াজ মহফিলের প্রকাশ্য উষ্কানি আমরা প্রতিনিয়ত দেখি ফেসবুক, এক্স হ্যান্ডেল (টুইটার) ও ইউটিউব চ্যানেলসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ অসহিষ্ণুতা ও সরকারের উদাসীনতার সুযোগে দেশে ক্রমান্বয়ে ধর্মীয় মৌলবাদের বিকাশ ঘটতে থাকে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে কোনো অজুহাতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে। রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় প্রথম ও প্রধান শিকার হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। নিরাপত্তা নির্ধারিত হয় রজনৈতিক হিসাব-নিকাশে। রাজনীতির হিসাব-নিকাশে মুখ্য হয়ে ওঠে ভোটের হিসাব। কারা তাদের ভোট দেবেন আর কারা দেবেন না অথবা কাদের ভোটের পাল্লা ভারী। ৯০, ৯২, ২০০১ সালসহ ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও হামলায় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনা প্রতিরোধে নির্বাচিত সরকার বা দল কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, শত্রু সম্পত্তি এবং পরবর্তীতে অর্পিত সম্পত্তি আইনসহ নানাবিধ কারণে কীভাবে সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। তিনি এ গবেষণায় দেখিয়েছেন, ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু দেশ ত্যাগে বাধ্য হয়েছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের ২০% সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এখন ৮% এরও কম। মাঝখানের এতগুলো লোক কোথায় গেলো বা কেন গেলো, তা কোনো সরকারই তলিয়ে দেখেনি। অথচ প্রত্যেক দল এবং সরকারই দাবি করে, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এ দেশে কখনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। একেবারে অকাট্য সত্যি কথা। কারণ, দাঙ্গা তো হয় সমানে সমানে। এদেশে যা হয়েছে তা হলো সাম্প্রদায়িক সহিংসতা।
পরিশেষে বলবো, এদেশের সকল ধর্মের মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছেন আজকের এমন দৃশ্য দেখার জন্য নয়। একটি অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে দেশের প্রতিটি মাটির কণার জন্য যুদ্ধ করে স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মৌলবাদের এমন উলঙ্গ নৃত্য দেখার জন্য নয়। ২০০৮ সালের নির্বাচন বাদ দিলে ৭৫ এর পরের প্রতিটি নির্বাচন এদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য বয়ে এনেছে মারাত্মক বিপর্যয়। এমন বিপর্যয় আর দেখতে চাই না। তাই নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনার মহোদয়ের কাছে নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দানের ব্যবস্থা করার দাবি জানাচ্ছি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।