ঢাকা, রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

ভারতের লোকসভা নির্বাচন প্রাক্কালে এনআরসি ইস্যু!

২০২৪ মার্চ ৩১ ১৬:১৬:৩৭
ভারতের লোকসভা নির্বাচন প্রাক্কালে এনআরসি ইস্যু!

রহিম আব্দুর রহিম


ইউএনএফপিএর 'দ্যা স্টেট অব ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিপোর্ট -২০২৩ সমীক্ষার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ভারতের মোট জনসংখ্যা ১৪২ কোটি ৮৬ লাখ। অপরদিকে বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্টদের দাবী দেশের জনসংখ্যা ১৩৮ কোটি। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী মুসলিম জনসংখ্যা ১৯.০৭ কোটি। বেসরকারি হিসেব অনুযায়ী যার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ২০ কোটির উপরে। দেশটির মোট জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দু ধর্মালম্বী ৭৯ দশমিক ৮ শতাংশ, ইসলাম ধর্মালম্বী ১৪.২ শতাংশ, খ্রিস্ট ধর্মালম্বী ২ দশমিক ৩ শতাংশ, শিখ ধর্মালম্বী ১ দশমিক ৭ শতাংশ, বৌদ্ধ ধর্মালম্বী শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ, আদিবাসী (সর্নামিজম,বন, এনিমিজ, কিরাত, মুন্ধুম, ডনি-পোলো) শুণ্য দশমিক ৫০ শতাংশ, জৈন ধর্মালম্বী- শূণ্য দশমিক ৪০ শতাংশ, ধর্মহীন (নাস্তিক, অজ্ঞাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষ এবং উত্তরহীন) জনগোষ্ঠীর সংখ্যা শূণ্য দশমিক ২৫ শতাংশ মাত্র।

হিন্দু অধ্যুষিত ভারতবর্ষে মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থান দ্বিতীয় স্থানে। দেশটি এশিয়ার অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে পরিচিত। দেশটি সম্প্রীতির দেশ হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক এমনটি কামনা করে বিশ্ব বিবেক। ২০১৫ সাল থেকে মাঝে মাঝে ভারতের এনআরসি এবং সিএএ বিষয় সামনে আসে। এই নিয়ে শুধু ভারত নয়, দেশ বিদেশের কূটনৈতিক মহলে চলে তর্কবিতর্ক। রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হয় পরস্পরের প্রতি বিষোদগারে। জবাব-পাল্টা জবাবের বন্যা বয়ে যায় বিভিন্ন মিডিয়ায়। ২০১৯ সালে ভারেতর পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে এই নিয়ে তোলপাড় কম হয় নি। ওই সময় ভারতের বিভিন্ন মিডিয়া প্রকাশিত সংবাদে বিশ্বমহল জানতে পেরেছে এনআরসিতে নাম না থাকায় আত্মহত্যা কিংবা হার্টঅ্যাটাকের মত ঘটনায় অনেকের মৃত্যুর খবর। এই এনআরসিতে কি আছে, এতে কারও ক্ষতি হবে, কি হবে না তা স্পষ্ট হওয়া দরকার।

এনআরসি (ন্যাশনাল রেজিস্ট্রার অব সিটিজেন) হলো সকল ভারতীয় নাগরিকদের জন্য একটি সংবিবদ্ধ তালিকা। যে আইনটি ১৯৫৫ সালে করা হয়, পরবর্তীত ২০০৩-২০০৪ সালে যে আইনটি সংশোধিত আইন হিসেবে চালু রয়েছে। এই আইনটি ভারতের ২৮টি রাজ্যের মধ্যে শুধুমাত্র অসমে কার্যকর, অন্যকোন রাজ্যে প্রচলিত নয়। কারণ অসমকে ভারত সরকার অবৈধ অভিবাসন অনন্য সমস্যাযুক্ত একটি সীমান্ত রাজ্য হিসেবে চিহৃিত করেছে। সেই অনুযায়ী ১৯৫১ সালে আদমশুমারির তথ্যের ভিত্তিতে অসম রাজ্যের জন্য একটি এনআরসি তৈরি করা হয়, যা যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। ১৯৮৩ সালে অসমে অবৈধ অভিবাসীদের চিহৃিত করার জন্য অবৈধ অভিবাসী (ট্রাইব্যুনাল দ্বারা নির্ধারণ) আইন পাস করে, সংসদে একটি পৃথক ট্রাইব্যুনাল প্রক্রিয়া তৈরি করে। ২০০৫ সালে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট এটিকে অসাংবিধানিক বলে প্রত্যাখান করে। এরপর ভারত সরকার অসম এনআরসি হালনাগাদ করতে সম্মত হোন। প্রায় দশ বছর ধরে হালনাগাদ প্রক্রিয়াতে সন্তোষজনক অগ্রগতি না হওয়ায় ২০১৩ সালে সুপ্রীমকোর্ট প্রক্রিয়াটির পরিচালনা ও পর্যবেক্ষণ শুরু করে।

চূড়ান্ত হালনাগাদ হওয়া এনআরসি ২০১৯ সালে ৩১ আগস্ট প্রকাশ হয়, যেখানে তিন কোটি ১০ লক্ষ মানুষের নাম তালিকাভূক্ত হয়। বাদ পড়ে যায় ১৯ লাখ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম। (তথ্যসূত্র-ওয়েব্যাক মেশিন আর্কাইভকৃত ৭ মার্চ ২০২১) ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএএ) হচ্ছে, ২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর ভারতের সংসদে পাস হওয়া একটি আইন। এটি ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের মাধ্যমে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান থেকে আগত নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিষ্টান ধর্মালম্বী অভিবাসীদেন ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ প্রদান করে। বিলটির মূল উদ্দেশ্য হল ভারতে বসবাসকারী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিম অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেয়া।

আইনটির নাম নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ ৷ কি ছিলো আইনটিতে? যারা নিজের দেশে ধর্মীয় কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে পালিয়ে এসেছে, তারা যদি ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করে থাকে, তবে তারা এই আইনের আওতায় ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার উপযুক্ত। এসব সম্প্রদায়ের মানুষজন ভারতে ছয় বছর বসবাসের পর সেখানকার নাগরিকত্ব পাবেন। যা আগে ছিলো এগারো বছর।তাদের কোন কাগজপত্র না থাকলেও চলবে। ওই সময় এই আইনটি নিম্নকক্ষ লোকসভায় অনুমোদনের পরই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রদেশগুলোতে বিশেষ করে অসমে সংহিস বিক্ষোভ হয়েছিল। বিক্ষোভকারীদের বক্তব্য ছিলো, 'এই আইন মুসলিম প্রধান দেশ থেকে আসা সংখ্যালঘুদের প্রতি 'পক্ষপাতমূলক।' অনেকে মনে করেন আইনটি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সাথে সাংঘর্ষিক। তবে এই আইনের কোথাও উল্লেখ নেই, জন্মসূত্রে ভারতের কোন মুসলিমকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না বা দেওয়া যাবে না। তবে কেনো এই ইস্যুটি সামনে আসে।

এবার ভারতে পার্লমেন্ট নির্বাচন শুরু হতে যাচ্ছে ১৯ এপ্রিল, সাতধাপে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচন শেষ হবে ১ জুন, ফলাফল ঘোষণা হবে ৪ জুন। দেশটির এই নির্বাচনে প্রায় ১০০টি দল অংশ গ্রহণ করবে, এরমধ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন ১৫টি, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ১০টিদল, বাকী ৭৫টি দল আঞ্চলিক, ভোট প্রয়োগ করবে প্রায় ৯০ কোটির অধিক ভোটাররা।বিশ্লেষকদের ধারণা এবারের ১৮তম লোকসভা নির্বাচন হবে দীর্ঘ ৪৪ দিন ব্যাপী। ফলে এই নির্বাচন ২০১৯ সালের নির্বাচনকে অতিক্রম করা ঐতিহাসিক দীর্ঘ মেয়াদী একটা নির্বাচন। মোট ৫৪৩টি আসনের মধ্যে যে দল বা যারা ২৭২ আসন পাবে তারাই সরকার গঠন করবে। নির্বাচনের আগে এনআরসি বির্তক, আশ্চর্য! সারাবছর চুপচাপ, নির্বাচনের আগে ইস্যুটিকে সামনে আনার কারণ কি তাহলে সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা নেবার চেষ্টা, নাকি ওই দেশটির আঞ্চলিক জন চাহিদা বা জনআঙ্খাকাকে আড়াল করার প্রয়াস?

এনআরসি ইস্যুটি ভারতের অসম রাজ্য ছাড়া অন্য কোন রাজ্যের নাগরিকরা তেমনটা জানেই না। অসম অপার সম্ভাবনার রাজ্য। যে রাজ্যে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার মত যেমন রয়েছে ভূসম্পত্তি : তেমনি রয়েছে খনিজ সম্পদ (তৈল)। অথচ এই অসমের মানুষরা এখন শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর,অভাবের তাড়না যাদের নিত্যসঙ্গী। এদের মূল দৃষ্টির প্রতিবন্ধকতা হিসেবে ভোটের আগে ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী দলীয়রা এনআরসি ইস্যুটাকে ইচ্ছাকৃতভাবেই সামনে টেনে আনছে। আসলে এনআরসি বিষয়টি আদৌ ভারতে জন্মসূত্রে নাগরিক এবং বসবাসকারী মুসলিম ধর্মালম্বী জনমানুষের জন্য কোন প্রকার আতংক বা হুমকির কারণ নয়। নির্বাচন প্রাক্কালে এই নিয়ে হৈ চৈ করার মূল কারণ সবাই বুঝলেও বুঝে না শুধু ভারতে অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত খেঁটে খাওয়া ভুক্তভোগী মহল। ফলে এই সাধারণ মানুষরা আনন্দঘণ নির্বাচনকালে মহাআতংক, ভয় এবং অহেতুক মানসিক চিন্তার মধ্য দিয়ে সময় পার করে।যা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জন্য দুঃখজনক। কারণ, ভুলে গেলে চলবে না, সকল রাজনীতিই মানুষের কল্যাণে। রাজনীতি হোক মানুষের জন্য, মানুষ নিয়ে রাজনীতি নয়।

লেখক : শিক্ষক, আন্তর্জাতিক পদকে ভূষিত নাট্যকার ও বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য।