ঢাকা, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বাংলা নববর্ষের প্রবর্তক কে

২০২৪ এপ্রিল ১৫ ১৬:৫১:০৮
বাংলা নববর্ষের প্রবর্তক কে

গোপাল নাথ বাবুল


বাংলা নববর্ষ সুদীর্ঘকাল ধরে প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বাঙালি সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। সাধারণত গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে প্রতি বছর ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ পালিত হয়ে আসছে। এদিন বাঙালি পুরুষরা পায়জামা-পাঞ্জাবি এবং মহিলারা বাঙালির ঐতিহ্যবাহী পোষাক শাড়িতে ও খোপায় নানা রকম ফুল গুজিয়ে সেজে থাকেন। তাই লোকসংস্কৃতি গবেষকরা বাংলা নববর্ষকে এক অনন্য বৈশিষ্ট্যময় উৎসব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। কারণ, পৃথিবীতে প্রচলিত বেশিরভাগ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনও না কোনও ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু বাংলা নববর্ষের সঙ্গে কোনও ধর্মের যোগ নেই। মূলত কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের ব্যবস্থাকে ঘিরে এর প্রচলন হয়। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসা-বাণিজ্যের দেনা-পাওনার হিসেব মেটানো। সেকালের মানুষ ছিলেন সহজ-সরল। এখনকার মত দিনক্ষণ নিয়ে তারা মাথা ঘামাতেন না। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এ পরম্পরা আজও বহমান। বর্তমানে পহেলা বৈশাখ, বাঙালির সর্বজনীন উৎসব হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। যা কিছু জীর্ণ-পুরনো, অশুভ ও অসুন্দর-তা পেছনে ফেলে নতুনের কেতন ওড়ানোর দিন, বাঙালির উৎসবের দিন, আনন্দের দিন, সম্প্রীতির দিন, সৌহার্দ্যরে দিন, একে-অপরের শুভেচ্ছা বিনিময়ের দিন এবং নতুন স্বপ্ন দেখার দিন।

বাংলা ক্যালেন্ডার বা বঙ্গাব্দ কবে থেকে চালু হয়েছিল তা নিয়ে বিভিন্ন গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকে বলেন, বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়েছিল মুঘল সমাট জালাল উদ্দিন মোহাম্মদ আকবরের আমলে। খাজনা আদায়ের সুষ্ঠতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। সম্রাটের আদেশে রাজকীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সন ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ এবং ৯৯২ হিজরিতে প্রবর্তন করেন। তবে এ গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয়েছিল আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় ৫ নভেম্বর ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে। নতুন সনটি ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে বাংলা সন বা বঙ্গাব্দ নামে পরিচিত হয়।

তবে অনেকের মতে, হিন্দু সৌরপঞ্জিকা অনুসারে বাংলা বারোমাসের প্রচলন অনেক আগে থেকেই ছিল। কারণ, গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের আমলে অর্থাৎ সপ্তম শতকেই বাংলা ক্যালেন্ডার চালু থাকার কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়। গৌড়ের একচ্ছত্র অধিপতি এবং শিব পূজারী রাজা শশাঙ্ক তাঁর রাজ্যাভিষেককে স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রবর্তন করেন বলে দাবি করা হয়।

এ বিষয়ে চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, তখনকার রাজারা নিজেদের রাজ্যাভিষেককে স্মরণীয় করে রাখতে বিশেষ কিছু উৎসবের আয়োজন করতেন। গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেকের সময় ৫৯৩ খৃষ্টাব্দে তাম্র মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন এবং শশাঙ্কের রাজত্বকালে গৌড় তথা বাংলার কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ইত্যাদিতে যথেষ্ট উন্নত ছিল। তাঁর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ পূর্ব ভারতে সমৃদ্ধির কেন্দ্রবিন্দু ছিল-বঙ্গাব্দের ও প্রচলন এই প্রেক্ষিতেই।

এমনই তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে অনেক বছর থেকেই। এখন আমরা একটু হিসেব করে দেখি, কার আমলে বাংলা বঙ্গাব্দ চালু হয়েছিল। এ বছর ১৪৩১ তম বাংলা নববর্ষ পালিত হয়েছে। আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন ১৫৫৬ সালে। সে হিসেবে বঙ্গাব্দ হবে (২০২৪ - ১৫৫৬) সাল = ৪৬৮ বঙ্গাব্দ। তাহলে আকবর বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হন কোন যুক্তিতে? আবার অনেকে দাবি করেন, আকবর বঙ্গাব্দের প্রচলন করেন হযরত (স.) এর মদিনায় হিজরতের বছর থেকেই। এমন যুক্তি হিসেবে হযরত (স.) মদিনায় হিজরত করেন ৬২২ খৃষ্টাব্দে। সে হিসেবে এখন বঙ্গাব্দ হবে (২০২৪ - ৬২২) সাল = ১৪০২ বঙ্গাব্দ। এ যুক্তিতেও মিলে না। কারণ, এবার ১৪৩১ তম নববর্ষ পালিত হয়েছে। যার পার্থক্য প্রায় ২৯ বছর।

তাছাড়া, হিজরত দিয়েই যদি বঙ্গাব্দ চালু হত, তাহলে গণনা পদ্ধতির সঙ্গে ইসলামী হিজরী বর্ষপঞ্জির কিছু সঙ্গতি থাকত। হিন্দু পদ্ধতিতে বর্ষপঞ্জি গণনা করা হত না। বাংলা মাস ও সপ্তাহের বারের নামগুলোও রাজা শশাঙ্কের দেওয়া নামই রয়ে যায়। কারণ বাংলা বারোমাসের নামকরণ করা হয় জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ থেকেই। নক্ষত্রের নামের ওপর ভিত্তি করেই এ নামকরণ। যেমন-বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, উত্তর ও পূর্ব আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, উত্তর ও পূর্ব ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশি^নী থেকে আশি^ন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা থেকে মার্গশীষ বা অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, উত্তর ও পূর্ব ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন, চিত্রা থেকে চৈত্র।

বাংলা সনের সপ্তাহের সাতদিনের নামকরণ হয় গ্রহ ও দেবতাদের নামের আশ্রয়ে। যেমন- সোম বা শিব দেবতা থেকে সোমবার, মঙ্গল গ্রহ থেকে মঙ্গলবার, বুধ গ্রহ থেকে বুধবার, বৃহস্পতি গ্রহ থেকে বৃহস্পতিবার, শুক্র গ্রহ থেকে শুক্রবার, শনি গ্রহ থেকে শনিবার, রবি বা সূর্য দেবতা থেকে রবিবার।
আবার অনেকে যুক্তি দেন, ৯৬৩ হিজরিতে তথা ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে স¤্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। তারা যুক্তি দেন, ৯৬৩ হিজরিকে বাংলা সনের বয়স ৯৬৩ বছর ধরে নিয়ে তারপর প্রতি সৌর বছর অন্তর ৯৬৪, ৯৬৫, ৯৬৬- এভাবেই গণনা করে আসছে। সে হিসেবে তারা বর্তমান নতুন বছর ১৪৩১ সাল বুঝিয়ে দেন। এ যুক্তি ও ধোপে টিকে না। কেননা, তাহলে হিজরি সালও ১৪৩১ হিজরি হত। অথচ বর্তমানে হিজরি সাল চলছে ১৪৪৫ হিজরি। যার পার্থক্য ১৪ বছর।

এখন আমরা যদি রাজা শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেক বা সিংহাসন আরোহণের সময় হিসেব করি তাহলে বরাবর বর্তমান বঙ্গাব্দ মিলে যায়। যেমন- (২০২৪ - ১৪৩১) সাল = ৫৯৩ সাল। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং-এর বিবরণ থেকে জানা যায়, ৫৯৩ খৃষ্টাব্দে গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল। এ উদাহরণ থেকেই প্রমাণিত হয়, বাংলা সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবর নন, গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক। অর্থাৎ আকবরের সময়কালের বহুবছর পূর্বে রাজা শশাঙ্কের হাত ধরেই বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।

তাছাড়া, আকবরই যদি বাংলা সনের প্রবর্তক হতেন, তাহলে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলা বঙ্গাব্দের একই নামকরণ হত। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন রকম নববর্ষের নামকরণ হত না। অর্থাৎ আমরা যখন বাংলা নববর্ষ পালন করি, ঠিক তখনই ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ভিন্ন ভিন্ন নামে এ উৎসব পালিত হয়। যেমন- পাঞ্জাবে বৈশাখী, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, কেরালায় বিশু, আসামে বিহু, উড়িষ্যায় পানা সংক্রান্তি ইত্যাদি নামে এ উৎসব পালিত হয়।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, আকবর ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ নামক এক বর্ষপঞ্জি চালু করেছিলেন। যার স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে তাঁর ‘আইন ই আকবরী’ নামক গ্রন্থে। ‘আইন ই আকবরী’তে ভারত-সহ বিশ্বের বিভিন্ন বর্ষপঞ্জির বিবরণের সবশেষে রয়েছে ‘তারিখ-ই-ইলাহী’র নাম। এ গ্রন্থে কোনও বঙ্গাব্দের নামের উল্লেখ নেই। যদি আকবরই বাংলা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হতেন তাহলে নিশ্চয়ই ‘আইন ই আকবরী’তে অবশ্যই বঙ্গাব্দের উল্লেখ থাকত।

আবার কোনও কোনও ঐতিহাসিক মনে করেন, সৌরপঞ্জিকা অনুসারে বহুকাল আগে থেকেই সৌরবছরের প্রথম দিন বাংলা, আসাম, কেরালা, মণিপুর ইত্যাদি বিভিন্ন ভারতীয় প্রদেশে মূলত ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালিত হত। আবার অনেকের মতে, বাংলা নববর্ষের শুভারম্ভ সম্পর্কে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে প্রায় ২ হাজার ৮১ বছর পূর্বে। জানা যায়, খৃষ্টপূর্ব ৫৭ অব্দে পুরো ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা এমনকি ইউরোপের কিছু অংশেও যার রাজত্ব বিস্তার লাভ করেছিল, বিশে^র সেই পরাক্রমশালী রাজা বিক্রমাদিত্য তাঁর সম্পূর্ণ রাজত্বের জন্য ‘বিক্রম সম্বত’ নামে একটি বর্ষপঞ্জিই চালু করেছিলেন। এ পঞ্জিকা অনুসারে ভারতের পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও নেপালের বিভিন্ন অংশে বসবাসরত গ্রামীণ বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে নিছক একটি ঋতু উৎসব হিসেবে প্রচলিত ছিল পহেলা বৈশাখ। তবে তা বাংলা অবধি পৌঁছাতে সময় লেগেছিল ৫৯৩ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত। সপ্তম শতকে বাংলা বছরের প্রমাণ সময়ের বেশ পরিবর্তন এনে বাংলার বুকে বাংলা দিনপঞ্জির উদ্ভব ঘটান বাংলার প্রথম স্বাধীন নৃপতি গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক। আবার কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মণ তাঁর পুরো রাজত্বের জন্য ‘ভাস্করাব্দ’ নামে বর্ষপঞ্জি চালু করেছিলেন। এছাড়া আকবরই যদি বাংলা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক হতেন তাহলে আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বহু বছর আগে নির্মিত মন্দিরের দেওয়াল ও তাম্রলিপিতে বঙ্গাব্দের উল্লেখ থাকত না।

সুতরাং আমরা আশা করি, বাংলাদেশ ও ভারতের গবেষকবৃন্দ গবেষণা করে একদিন সত্য উদঘাটন করবেন বাংলা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক কে ? রাজা শশাঙ্ক নাকি সম্রাট আকবর ? বিভিন্ন উদাহরণ থেকে আপাতত এ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, রাজা শশাঙ্কই হলেন বাংলা বঙ্গাব্দের প্রবর্তক।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।