প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত
শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ, কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতি
২০২৪ মে ২৪ ১৮:১১:১৯আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল : ফরচুন সুজ লিমিটেডে বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর আনসার সদস্যদের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে নগরীতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল জেলা শাখার আয়োজনে আজ শুক্রবার বেলা ১১টায় নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হলের সামনে ঘন্টাব্যাপী মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুজয় শুভ।
জেলা সংগঠক হুজাইফা রহমানের সঞ্চালনায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের জেলা সভাপতি একে আজাদ, করাতকল শ্রমিক ইউনিয়নের জেলা সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান, ছাত্র কাউন্সিলের ববি শাখার আহবায়ক সিফাত আহমেদ প্রমুখ।
বক্তারা শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের বিচার ও শ্রম আইনের শতভাগ প্রয়োগের দাবি করেন। পাশাপাশি অনতিবিলম্বে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবি করেন। নতুবা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও হুমকি প্রদর্শন করেন।
শ্রমিক ফ্রন্টের আন্দোলনের ডাক
অপরদিকে বকেয়া বেতনের দাবিতে ফরচুন সুজের আন্দোলনরত শ্রমিকের ওপর গুলি বর্ষণের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল বাসদ ও সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের জেলা শাখার নেতৃবৃন্দরা। শ্রমিক ফ্রন্টের জেলা শাখার দপ্তর সম্পাদক শহিদ হাওলাদারের পাঠানো বার্তায় শুক্রবার সকালে জানা গেছে, এক যুক্ত বিবৃতিতে বাসদের জেলা শাখার সমন্বয়ক ডাঃ মনীষা চক্রবর্তী ও শ্রমিক ফ্রন্টের জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দুলাল মল্লিক আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের ঘটনায় তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে অবিলম্ভে বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবি করেন। একই দাবিতে আজ শনিবার (২৫ মে) বেলা ১১টায় নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হল চত্বরে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ সফল করার জন্য আহবান করেন।
শ্রমিক অসন্তোষের কারণ
আন্দোলনরত শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শুধু বকেয়া বেতনের দাবিতেই নয়; কারখানার মধ্যে আরও অনেক কর্মকান্ড ঘটে, যা শ্রমিক আইনের পরিপন্থি। এগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কারখানার মধ্যে শ্রমিকরা মালিক পক্ষের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছেন। কিন্তু ফরচুন সুজ কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের কথা এড়িয়ে গেছেন। এমনকি যারা শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছেন তাদের কারণ দর্শানো ছাড়াই চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
চার বছর ধরে চাকরি করা জেসমিন আক্তার বলেন, আমাদের ওভারটাইম করানো হলেও কোম্পানী বিগত ৪/৫ বছর ধরে ওভারটাইমের টাকা পরিশোধ করেন না। তাছাড়া যে টাকা বেতন পাই তা থেকে শ্রমিক ফান্ডের নামে প্রতিমাসে চারশ’ টাকা করে কেটে রাখে কোম্পানীর ম্যানেজমেন্ট। অথচ চাকরি ছাড়লে বা চাকরিচ্যুত করা হলে সেই টাকা পরিশোধ করে না ফরচুন কর্তৃপক্ষ।
সোনিয়া আক্তার নামের আরেক শ্রমিক বলেন, আমাদের সাপ্তাহিক কোনো ছুটি নেই। অন্য কারখানায় আট ঘণ্টা কাজ করানো হলেও ফরচুনে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়। মাসের পর মাস বেতন বকেয়া থাকে। বিভিন্ন অজুহাতে কারখানার মধ্যে আটক করে শ্রমিকদের মারধর করা হয়। অপর শ্রমিক ইব্রাহিম হোসেন বলেন, নির্ধারিত সময়ের এক মিনিট পরে কারখানায় প্রবেশ করলে বা সময় শেষ হওয়ার আগে বের হলেও ৪০ টাকা করে কেটে নেওয়া হয়। কারখানার ভেতরে শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়না। কুকুর-বেড়ালের মতো আচরণ করা হয়। এসব কারণে শ্রমিকদের মধ্যে দিনে দিনে অসন্তোষ বাড়ে
গুলিবিদ্ধ শ্রমিকদের ঢাকায় প্রেরণ
বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর ১০ রাউন্ড গুলি বর্ষণের কথা স্বীকার করেছে আনসার সদস্যরা। আনসার সদস্য ইউসুফ আলী বলেন, আমরা গুলি করতে বাধ্য হয়েছি। শ্রমিকরা আমাদের ব্যারাকে হামলা চালিয়ে ৬/৭ জন আনসার সদস্যকে মারধর করে। তারা আমাদের ম্যাগাজিন রুমে হামলা চালালে উপরের নির্দেশে গুলি করা হয়। আনসার সদস্যদের গুলিতে আহত পাঁচজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শেবাচিম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওয়ার্ড মাস্টার আবুল কালাম জানান, হাসপাতালে ভর্তি শ্রমিক উজিরপুর উপজেলার নারায়নপুরের হানিফ সরদারের ছেলে মেহেদী সরদার, বাবুগঞ্জের রহমতপুরের গোলাম মোস্তফার ছেলে রাজিব, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার ছারছিনা এলাকার শামসুদ্দোহার ছেলে তামিম হোসেন, গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের আব্দুল খালেক প্রমাণিকের ছেলে মিজানুর রহমান, ঝালকাঠির নলছিটির বাসিন্দা খোকনের ছেলে রাফসানকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বৃহস্পতিবার (২৩ মে) রাতে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, বরিশাল শিল্প নগরীতে (বিসিক) জুতা তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান ফরচুন সু কোম্পানি লিমিটেডে বকেয়া বেতনের দাবিতে ২৩ মে বিকেলে শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন। এসময় কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের লাঠিপেটা ও শটগানের গুলিতে পাঁচজন শ্রমিক আহত হন। এসময় পরিস্থিতি উত্যপ্ত হয়ে উঠলে শ্রমিকদের নিক্ষিপ্ত ইটের আঘাতে আহত হয়েছে কাউনিয়া থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোস্তাফিজুর রহমান ও পাঁচজন আনসার সদস্য। ভাঙচুর করা হয় কারখানার গ্লাসসহ পার্কিং করে রাখা অসংখ্য যানবাহন।
খবর পেয়ে জেলা প্রশাসক মোঃ শহীদুল ইসলামসহ পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সাথে কথা বলেন। পরবর্তীতে শ্রমিকদের মধ্য থেকে ছয় সদস্যর প্রতিনিধি নিয়ে ফরচুনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের সাথে সমঝোতা বৈঠকে বসা হয়। দীর্ঘসময় বৈঠক শেষে জেলা প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ফরচুনের চেয়ারম্যান কারখানার সামনে অবস্থান নেওয়া শ্রমিকদের ঘরে ফেরার আহবান জানিয়ে বলেন, শ্রমিকদের সকল দাবি মেনে নেওয়া হবে। পাশাপাশি শ্রমিকদের ওপর যে আনসার সদস্যরা গুলিবর্ষণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আহতদের তিনি নিজ দায়িত্বে চিকিৎসা করাবেন। তবে ফরচুন সুজের চেয়ারম্যানের এই ঘোষণাকে ঘটনার আকস্মিকতা মোকাবেলা দাবি করে আন্দোলনরত শ্রমিক রুবেল বলেন, চেয়ারম্যান নিজেই শ্রমিকদের ওপর গুলি করার জন্য আনসার সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছেন। এখন তিনি পুরো ঘটনা ধামাচাঁপা দেয়ার জন্য নতুন ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন।
(টিবি/এসপি/মে ২৪, ২০২৪)