প্রচ্ছদ » শিল্প-সাহিত্য » বিস্তারিত
উচিৎ জবাব
২০২৪ জুন ১০ ১৩:৫১:৪৫বিশ্বজিৎ বসু
আজ পল্টুর বিয়ে। মালতের সকলকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। পোস্ট অফিসের মাধ্যমে আত্মীয় স্বজনদের চিঠি পাঠানো হয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। দাস পাড়া, সিকদার পাড়া, লাউজানায় বেছে বেছে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে কয়েকটি পরিবারকে।
গতকাল বিকালে বাদ্যকারেরা আসার পর থেকে গ্রামের বাতাসে বয়ে চলেছে বিয়ের আমেজ। মাঝে মাঝেই শোনা যাচ্ছে উলুধ্বনী, ঢাক কাসর আর সানাইয়ের বাজনা। কোন আত্মীয় বা বিয়ের বাজার বাড়িতে আসার সাথে সাথে বেজে উঠছে সেই বাজনা। এবাজনা যেন বার বার বলে উঠছে, স্বাগতম! স্বাগতম! পল্টুর বিয়ে! পল্টুর বিয়ে।
পল্টুর দিদা অঞ্জলী রানী এ পরিবারের কর্তা। সকল সিদ্ধান্তের মধ্যমনি। এক সময়ের এলাকার প্রতাপশালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শান্তি ঘোষের বিধবা স্ত্রী। শান্তি ঘোষ খুন হয়ে যাবার পর সেই বিত্ত না থাকলেও গ্রামের লোকেরা এখনও তাকে বেশ সম্মান করে। এলাকার কারো কাছে তিনি বড়মা, কারো কাছে তিনি কাকিমা। বাড়ির সব বিষয়ে চুড়ান্ত সিদ্ধান্তটাও তার কাছ থেকেই আসে। বিয়ের ব্যাপারেও তাই। কাকে নিমন্ত্রণ করা হবে, কাকে করা হবেনা, কি বাজার করা হবে, কি রান্না করা হবে সব কিছু তার সিদ্ধান্তেই চলছে।
ভোর থেকেই চলছে বিয়ে বাড়ির চরম ব্যস্ততা । দধী মঙ্গল, আগত আত্মীয়দের আপ্যায়ন, বিদ্ধি শ্রাদ্ধ, হলুদ কোটা, এটা দরকার, সেটা দরকার সব কিছুতেই অঞ্জলী রানী। দুপুর বেলা হলুদ কোটা শেষে আয়স্তদের গঙ্গা বরণে রওনা করে দিয়ে অঞ্জলী রানী মনে মনে ভাবলেন, এই ফাঁকে আমি স্নানটা সেরে আসি।
কালু সিকদার পাড়ার যুবক। বয়স চল্লিশ এর কোটায়। কিশোর বয়স থেকে চাল চলন আচার আচরণে নেতা নেতা ভাব। তাকে মেনে চলতে সম বয়সীদের উপর ছড়ি ঘোরানোর অভ্যাস সেই কিশোর সময় থেকেই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমাজের উপরও একটি প্রভাব তৈরি করেছে। তাকে কেউ উপেক্ষা করলে সে ক্ষিপ্ত হয়ে দুটি কথা শুনিয়ে দেয়। কিশোর বয়সে মারামারি করলেও এ বয়সে সেটা মানায় না, তাই কথা আর ধমক দিয়ে সম্মান আদায় করতে চায়।
বৈশাখের খরতাপ। হাসন মাতবরের পুকুর। দুপাশে সান বাঁধানো ঘাট। দক্ষিণের ঘাট নারী আর শিশুদের জন্যে আর পুবেরটা পুরুষদের। কালু বসেছিল পুবের ঘাটে সিঁড়ির উপর। দক্ষিণের ঘাটে সিঁড়ি দিয়ে অঞ্জলী রানী নামা দেখে, গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ও কাকিমা বিয়ের বাদ্য বাজে কোন বাড়ি?
- কেন আমাগো বাড়ি। উত্তর দেয় অঞ্জলী রানী।
- কারো বিয়ে নাকি।
-হ পল্টুর বিয়ে।
- দাওয়াত দিলেন না।
- দিবারতো পারলাম না।
- ছলেগো কইেছন শুনলাম।
- হ, কইছি। তাগোতো না কলি অন্যায় হতো।
- আমাগো কইলেন না, সিডা অন্যায় হোল্যো না।
অঞ্জলী রানী মনে মনে ভাবলেন, কালুরে একটা উচিৎ জবাব দিতে হবে। গলা চড়িয়েই বললেন, শোন মনি, কথায় কথা আসে। গেল মাসে তোমার ভাস্ত্যের বিয়ে দিলে, আমাগো নিমন্ত্রণ করছিলে? করো নাই! তার আগে তোমার ছাওয়ালের মোছলমানি দিলে, আমাগো কয়ছিলে? কও নাই। ছলে তাগো বাড়ির সব কিরে কাজে আমাগো কয়, তাই আমরাও তারে নেমন্তন্ন করি। ইডা হলো সম্মান দেয়াদেয়ির ব্যাপার।
কালু কিছু বলতে গিয়ে চুপ করে যায়। মনে মনে ভাবে, না ভুল হয়ে গেল, খোঁচাটা অজায়াগায় হয়ে গেছে। সে আর কোন কথা বাড়ায় না। চুপচাপ পুকুরে নেমে. ঘাবুস ঘুবুস কয়েকটা ডুব মারে তারপর গামছা দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে হন হন করে রওনা হয়ে যায় বাড়ির দিকে।
ছলে কালুদের প্রতিবশী এবং ঠিকা কাজ করে জীবন চালায়। ছলের বৌ দক্ষিণ ঘাটে বসে কাপড় কাঁচছিল আর দুজনের কথাবর্তা শুনছিল। কালু চলে যাবার পর সে একটু আশে পাশে তাকিয়ে দেখে, কান কথা বলে বিপদে ফেলার মতো কেউ আছে কিনা। যখন সে দেখলো সে রকম কেউ নাই, তখন সে বলে উঠে, ঠিকই কইছেন বড়মা, নিজের বাড়ির বিয়ে সাদিতে কাওরে কবিনে, বাছ্যে বাছ্যে দাওয়াত দিবি, কিডা বড় উপহার দিবি তাগো। আর মনে মনে ইচ্ছা উনারে সবাই দাওয়াত দিবি। আমাগো দাওয়াত দিছেন, আর ওগো দেন নাই দেহে কয়দিন ধইরে হিংসেয় জ্বলে পুড়ে মরতেছে। আপনি একেবারে উচিৎ জবাব দিয়েছেন।