ঢাকা, শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

বিষ্ণুপুর পিকেএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুটি পদে নিয়োগ না দেওয়া নিয়ে বিরোধ

২০২৪ জুন ১১ ২০:১১:০০
বিষ্ণুপুর পিকেএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দুটি পদে নিয়োগ না দেওয়া নিয়ে বিরোধ

রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশনা অনুযায়ি সাতক্ষীরা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কালিগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পদকের আহুত বড়সিমলা কারবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককের অফিসকক্ষে আলোচনা সভায় কম্পিউটার অপারেটর পদে মধুসুধন মণ্ডল ও আয়া পদে তাপসী মণ্ডলের নিয়োগপত্রে সাক্ষর করতে বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অজয় কুমার মণ্ডলের উপর চাপসৃষ্টি করা হয়েছে।

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বরেয়া মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুব্রত কুমার বৈদ্য ও বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি দেবদাস মণ্ডল এ চাপ সৃষ্টি করেন। একপর্যায়ে বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মণ্ডলী ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের কঠোর হস্তক্ষেপে সভা অসমাপ্ত অবস্থায় প্রধান শিক্ষকককে নিয়ে চলে যান ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক অজয় কুমার মণ্ডল জানান, তার বিদ্যালয়ে দুটি নিয়োগের জন্য নিয়োগবোর্ডের অপরিপূর্ণতা থাকায় নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। তাছাড়া বিষয়টিচ নিয়ে পাল্টটাপাল্টি মামলা রয়েছে। এ হেন পরিস্থিতিতে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি আব্দুল মোনায়েম, সাধারণ সম্পাদক গাজী মিজানুর রহমান ও ফতেপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজোয়ান হারুণ গত ২৩ মে তার প্রতিষ্ঠানে তদন্তে আসেন। ওই দিন তিনি ছুটিতে ছিলেন।

পরবর্তীতে গত ৮ জুন আব্দুল মোনায়েম ও গাজী মিজানুর রহমান যৌথভাবে এক নোটিশে তাকে মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বড়সিমলা কারবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকতে বলেন। একইভাবে সভাপতি দেবদাম মণ্ডলকে চিঠি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ি তিনি মঙ্গলবার সকাল ১০টায় বড়সিমলা কারবালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে হাজির হন। সেখানে বরেয়া মিলনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুব্রত কুমার বৈদ্যসহ উপজেলার ১০টি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।

এ সময় সুব্রত কুমার বৈদ্য ও তার(অজয়) বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি দেবদাস মণ্ডল তাকে মধুসুধণ মণ্ডল ও তাপসী সরদারের নিয়োগপত্রে সাক্ষর করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। বিষয়টি নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টির একপর্যায়ে দাতা সদস্য গোবিন্দ লাল সরদার ভিতরে ঢুকে নিয়োগপত্রে সাক্ষর না করলে শিক্ষকদের বেতন বিলে সভাপতি সাক্ষর করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। একপর্যায়ে বিদ্যোৎসাহী সদস্য সমীর কুমার মণ্ডল তাকে ডেকে নিয়ে সভা থেকে চলে আসেন। এ সময় বাইরে দাাঁড়িয়ে থাকা তার বিদ্যালয়ের করণিক রাধেশ্যাম সরদার রাতের মধ্যে তাকে (অজয়) থানা হাজতে ঢোকানোর হুমকি দেয়।

এ ব্যাপারে কালিগঞ্জের বরেয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বহুল আলোচিত প্রধান শিক্ষক সুব্রত কুমার বৈদ্য তার বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষক অজয় মণ্ডলের কাছ থেকে জোরপূর্বক নিয়োগপত্রে সাক্ষর করিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টির অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বিষয়টি তারা মীমাংসা করে দিতে চেয়েছিলেন।
তবে বিষ্ণুপুর পিকেএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি দেবদাস মণ্ডলের সঙ্গে তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তাকে পাওয়া যায়নি।

মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির কালিগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি আব্দুল মোনায়েম ও সাধারণ সম্পাদক গাজী মিজানুর রহমান বলেন, সাংসদ এসএম আতাউল হক দোলনের নির্দেশনা অনুযাযী তারা সভাপতি ও প্রধান শিক্ষককে ডেকে এনে আলোচনার মাধ্যমে বিষ্ণুপুর প্রাণকৃষ্ণ স্মারক বহুমুখী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে গঠনমূলক আলোচনা করা হয়েছে। তবে প্রধান শিক্ষক অজয় মÐল বলেছেন বিষয়টি তার একার এক্তিয়ার নয়। এ নিয়ে দুটি মামলা রয়েছে আদালতে। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির অধিকাংশ সদস্যের সিদ্ধান্ত তাদেরকে ১৫ দিনের মধ্যে জানানো হবে। তবে সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের মধ্যে বিরোধ থাকলেও শিক্ষককদের বেতন বিলে সভাপতির সাক্ষর না করায় সাধারণ শিক্ষকরা সমস্যায় পড়েছেন বলে জানান তারা।

তবে সাতক্ষীরা জেলার অবসরপ্রাপ্ত এক মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গত ২৩ নভেম্বর তরিখের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির এর পর থেকে ২৩ মে পর্যন্ত ছয় মাসে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়ায় এখন আর নিয়োগের কোন সুযোগ নাই। এখন নতুন বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৩ নভেম্বর পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি একজন ল্যাব এসিসট্যান্ট কাম কম্পিউটর অপারেটর এবং একজন আয়া নিয়োগ দেওয়ার জন্য বিষ্ণুপুর পিকিএম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বোর্ড বসানো হয়।বোর্ডে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বাকী বিল্লাহর পক্ষে তার প্রতিনিধি একাডেমকি সুপারভাইজার সাইফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।

যদিও পরীক্ষা শেষে তাৎক্ষণিক বাছাইয়ে ল্যাব এসিসট্যান্ট কাম কম্পিউটর অপারেটর পদে শ্যামনগরের পুর্ব দুর্গাবাটি গ্রামের মধুসুধন মণ্ডল ও আয়াপদে তাপসী সরদারকে মনোনীত করে সাইফুল ইসলাম বাদে অপর চারজন শীটে সাক্ষর করে চলে যান। শিক্ষা অফিসারের নিয়োগ বোর্ডে না থাকায় তার সাক্ষর পরে নেওয়ার চেষ্টার ঘটনায় ১১ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে বিরোধ তৈরি হয়। মধুসধন মণ্ডলকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না মর্মে অভিযোগ পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর কুমার দাশ ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকতা বাকী বিল্লাহ গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সকালে বিদ্যালয়ে তদন্তে আসেন। এরপরই দাতা সদস্য গোবিন্দ লাল সরদারের ভাই বিদ্যালয়ের করণিক কাম লাইব্রেরিয়ান রাধ্যেশ্যাম সরদার রেজুলেশন খাতাসহ বিভিন্ন কাগজপত্র প্রধান শিক্ষকের কাছে না দিয়ে সভাপতির কথামত নিজের জিম্মায় রেখে দেন।

বিষয়টি জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে অবহিত করে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করা হয়। এরপর থেকে ওই নিয়োগ বৈধ করতে সভাপতি খুলনার একটি কলেজের শিক্ষক ও খুলনায় বসবাসকারি দেবদাস মণ্ডল, গোবিন্দ লাল সরদার তার ভাই র‌্যাধেশ্যামকে নিয়ে রেজুলেশন খাতাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন।

নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত না থাকার পরও পরবর্তীতে ফলাফল শীটে সাক্ষর করা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বাকী বিল্লাহ, প্রাথী মধুসুধন মণ্ডল, সভাপতি দেবদাস মণ্ডল, দাতা সদস্য গোবিন্দ লাল সরদার প্রধান শিক্ষককে বিভিন্নভাবে চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। দাতা সদস্য গোবিন্দ লাল সরদার সাবেক এক সভাপতির নাম ভাঙিয়ে কম্পিউটার অপারেটর পদে মধুসুধন মণ্ডল এর কাছ থেকে আট লাখ ও স্থানীয় বাসিন্দা এক প্রার্থীর কাছ থেকে নয় লাখ ও আয়া পদে তাপসী সরদারের কাছ থেকে আট লাখ টাকা নিয়ে পরে সভাপতি দেবদাস মণ্ডলের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারার মাধ্যমে নিয়োগ বোর্ড বৈধ করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন মর্মে বহু পত্রিকায় প্রচারিত হয়।

গত ১১ মে সকাল সোয়া ১০টায় বিদ্যালয়ের করণিক রাধেশ্যাম সরদার প্রধান শিক্ষককে ৭ মে তারিখ সভাপতি সাক্ষরিত একটি চিঠি ধরিয়ে দেন। তাতে চিঠিতে সাক্ষর করা দিন থেকে সাত দিনের মধ্যে নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে পরিচালনা পরিষদের সভা ডাকতে বলা হয়। বিষয়টি নিয়ে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের পাঠানো এক চিঠিতে ১৬ মে বৃহষ্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টায় তাকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে হাজির থাকতে বলা হয়।

একপর্যায়ে ১৫ মে রাতে তিনি কালিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান প্রকৌশলী শেখ মেহেদী হাসান সুমনের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি ফেরার সময় মধুসুধন মণ্ডল, সভাপতি দেবদাস মণ্ডল, গোবিন্দ লাল সরদারসহ কয়েকজনের হাতে লাঞ্ছিত হন। শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ অবস্থায় তাকে ১৬ মে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। মধুসুধন ও তাপসীর চাকরি না হলে নিয়োগ বোর্ডের তিন সদস্য এর জন্য ঘুষ বাবদ খরচ ১০ লাখ টাকাসহ গোবিন্দ লাল সরদারের তিন প্রার্থীর কাছ থেকে নেওয়া ২৫ লাখ টাকা তার (অজয়) কাছ থেকে আদায় করার হুমকি দেওয়া হয়।

একপর্যায়ে ২৩ মে তারিখের মধ্যে ১১ সদেস্যর ৬জনকে নিজেদের পক্ষে করিয়ে নিয়োগ চুড়ান্ত করতে দাতা সদস্য গোবিন্দ লাল সরদার সোমবার সদস্য হীরা রানী রায় এর বাড়িতে এসে মধুসুধন ও তাপসীকে নিয়োগ দেওয়া সংক্রান্ত এক রেজুলেশন খাতায় সাক্ষর করাতে এসে তাকে নগদ চার হাজার টাকা ও বিকাশের মধ্যেমে সভাপতি দেবদাস মণ্ডল পাঁচ হাজার টাকা পাঠিয়ে দেন।

নিয়োগ বন্ধে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির বিদ্যোৎসাহী সদস্য সমীর কুমার মণ্ডল গত ৫ মে ও নিয়োগ পাওয়ার দাবিতে শ্যামনগরের পূর্ব দুর্গাবাটি গ্রামের মধুসুধন মণ্ডল ও বিষ্ণুপুরের তাপসী সরদার যৌথভাবে গত ১৯ মে কালিগঞ্জ সহকারি জজ আদালতে যথাক্রমে এসব মামলা দায়ের করেন। নিয়োগ পেতে আদালতের শরণাপন্ন হলেও মুকুন্দ মধুসুধনপুর চৌমুহুনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আকবর আলীকে নিয়ে রেজুলেশন খাতাসহ এক বা একাধিক সদস্যকে ম্যানেজ করতে বাড়ি বাড়ি ছোটেন মধুসুধন ও তাপসী। তারা সাংসদকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভুল বুঝিয়ে তাদেরকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

(আরকে/এএস/জুন ১১, ২০২৪)