ঢাকা, রবিবার, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

এনবিআরের মতিউরকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক বানালো কারা ?

২০২৪ জুলাই ১৭ ১৭:২২:৫৫
এনবিআরের মতিউরকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালক বানালো কারা ?

চৌধুরী আবদুল হান্নান


কিছুদিন আগে এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন পরিচালক ও সংসদ সদস্য মো. শহিদুল ইসলাম পাপুল মানব পাচার ও অবৈধ মুদ্রা পাচারের অভিযোগে কুয়েতে আটক হয়েছিলেন এবং কারাগারেও পাঠানো হয়েছিল। এ ঘটনা কিছু কিছু ব্যাংক পরিচালকদের অপকর্মের একটি নমুনা মাত্র।

প্রায়ই ব্যাংক পরিচালক বা তথা কথিত ব্যাংক মালিকদের কুকীর্তি পত্রিকার খবর হয়। কোনো কোনো পরিচালক যখন ছলচাতুরির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎ করেন; অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করেন এবং বিপদ আঁচ করতে পেরে দেশ ত্যাগ করেন, এমন খবরে এখন আমরা আর তেমন বিস্মিত হই না। কারণ, এ জাতীয় ঘটনা একটি দুটি নয়, অসংখ্য এবং চলমান। ব্যাংক খাত ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী এমন খবরও আমাদের গা সহা হয়ে যাচ্ছে।

এমন গুণধর ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকলে ব্যাংক ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ কী হবে ? পেশাগত অভিজ্ঞতা বা ব্যাংকিং জ্ঞান বিবেচনা না করে কেবল রাজনৈতিক বিবেচনা আর মুখ চিনে চিনে ব্যাংক পরিচালক নিয়োগ হলে অবস্থার উন্নতি হতে পারে না।

বছর দুয়েক আগে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ব্যাংক পরিচালক নিয়োগের একটি নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছিল কিন্ত বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। ব্যাংক পর্ষদকে অধিক কার্যকর করতে দক্ষ ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি সম্পন্ন ব্যক্তিদের আগমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।

প্রশ্ন হলো, দুর্নীতির শিরোমণি ছাগলকান্ডের মতিউর যিনি অনেক বার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, কীভাবে এবং কোন যাদুবলে তিনি একটি রাষ্ট্রাষত্ত ব্যাংকের পরিচালক পদে নিয়োগ পেলেন ?

এক সময় তার বিরুদ্ধে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছিল, অবশ্য অভিযোগ প্রমান করা যায়নি।বিদেশে পাচার করা টাকা প্রবাসী কোনো এক আত্মীয়র মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে এনে তা রেমিট্যান্স হিসেবে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এভাবে তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ উঠেছিল সবই ম্যানেজ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্ত অবশেষে ধরা খেয়েছেন একটি ছাগলের কাছে, ম্যানেজ করতে পারেননি।কথায় আছে না, বাড়বাড়ন্ত যখন সীমা ছাড়ায় পতন তখন আসন্ন।

তবে দেখার বিষয়, এতো কড়া নিয়মনীতি, টাইট সিকিউরিটি বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও দুর্ভেদ্য বেড়া ডিঙিয়ে কীভাবে একটি ছাগল সোনালী ব্যাংকে ঢুকে পড়লো ?

সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে মূল ভূমিকা পালন করে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। বিগত কিছুদিনের পত্রপত্রিকা বিশ্লেষণ করলে সকলের ধারনা জন্মাবে যে, এই সুচতুর মতিউর সোনালী ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের আনুকূল্য পেয়েছিলেন। এক পর্যায়ে তাদের ঘনিষ্ঠ যুগল ছবি পত্রিকায় এলে মানুষ বুঝতে পারে তাদের পারস্পরিক অন্তরঙ্গতা কত গভীর ?

হজ, ওমরাহর মূল পোষাক এহরাম পরিহিত এক সাথের ছবি আর গভর্নরকে ফুলের তোড়া উপহার দেওয়ার ছবি বলে দেয় তাদের সম্পর্ক অতিশয় ঘনিষ্ঠ। এ প্রেক্ষিতে মানুষ যদি মনে করে যে, তিনিই তাকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নিয়োগ দিয়েছেন, তাতে তাদের কি দোষ দেওয়া যাবে?

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার যদি মতিউরের মত এমন একজন ধুরন্ধর, দুর্বৃত্তকে ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগ প্রক্রিয়া আটকে দিতেন, তিনি জীবনে অন্তত একটি ভালো কাজের রেকর্ড করতেন। কারণ এ ক্ষমতা তাঁর ছিল।

জনমনে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন দীর্ঘদিনের যার প্রধান কারণ রাজনৈতিক চাপ এবং বাইরে থেকে বিভিন্ন মহলের অযাচিত হস্তক্ষেপ।

এ অজুহাতে সাধ্যের মধ্যে থাকা গুরুত্বপূর্ণ কাজ না করে হাতগুটিয়ে বসে থাকা কেন ? ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুরবস্থার দায়ভার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে না।

রাজস্ব কর্মকর্তা ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক হওয়ার সুবাদে পুঁজিবাজারসহ বিভিন্ন ব্যবসায় সুযোগ সুবিধা নিয়ে মতিউর নামে-বেনামে ও স্ত্রী সন্তানদের নামে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছেন এবং এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত চলমান।

অপরদিকে “দক্ষ কারিগর” মতিউর সোনালী ব্যাংকের পরিচালক থাকাকালীন সময়ে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে আমদানি-রফতানি বানিজ্যের আড়ালে ওভার ইনভয়েস- আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন কিনা, তাও তদন্তের আওতায় আসা জরুরী। কারণ এটা তার পুরানো স্বভাব; ইতিপূর্বে তিনি অর্থ পাচারের অভিযেগে অভিযুক্ত ছিলেন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।