ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ৪ মাঘ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক ও নেতাদের হত্যা এবং হত্যাচেষ্টা

২০২৪ জুলাই ৩০ ১৬:৪৩:৫০
বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক ও নেতাদের হত্যা এবং হত্যাচেষ্টা

গোপাল নাথ বাবুল


প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং বর্তমানে রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়েছে। গত ১৩ জুলাই পেনসিলভানিয়ার বাটলারে এক নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় মাত্র ৫০ মিটার দূরের এক বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে টমাস ম্যাথিউ ক্রুকস্ নামক ২০ বছরের এক যুবক এই হামলা চালায়। গুলি ট্রাম্পের কান ঘেঁষে চলে গেলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু প্রাণ হারান এক রিপাবলিকান সমর্থক এবং আহত হন আরো কয়েকজন। মাত্র হাফ ইঞ্চি এদিক-সেদিক হলেই ট্রাম্পকে হয়তো আর বাঁচানো যেত না। ট্রাম্পকে হত্যাচেষ্টা নতুন কিছু নয়। আমেরিকা-সহ সারাবিশ্বে ভোটের প্রচারে, রাজনীতিকদের জনসংযোগের সময় এবং কোনো কোনো দেশের স্বার্থ রক্ষার্থে গুলি চলেছে আগেও। হত্যা করা হয়েছে বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক ও জনদরদী নেতাদের। বিশ্বে ঘটে যাওয়া এমন কিছু হত্যাকান্ড ও হত্যাচেষ্টার ঘটনাগুলো আলোকপাত করার চেষ্টা করছি।

আব্রাহাম লিঙ্কন: ১৭৭৬ সালে বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর আমেরিকাকে সুন্দর ও সুষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দেওয়া শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্টের মধ্যে একজন, আমেরিকার ১৬তম এবং রিপাবলিকান পার্টির ১ম প্রেসিডেন্ট ছিলেন আব্রাহাম লিঙ্কন। তিনি দাসপ্রথা অবলুপ্তি এবং ১৮৬১ থেকে ১৮৬৫ সালের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া আমেরিকার গৃহযুদ্ধে উত্তরাঞ্চলীয় ইউনিয়ন বাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়ে দক্ষিণের কনফেডারেট জোটকে পরাজিত করে গৃহযুদ্ধ অবসানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কৃষ্ণাঙ্গ অধিকারের প্রতি তাঁর সমর্থন থাকায় ১৮৬৫ সালের ১৪ এপ্রিল ওয়াশিংটন ডিসি-র ফোর্ডস থিয়েটারে ‘আওয়ার আমেরিকান কাজিন’ নাটকে অংশ নেওয়ার সময় জন উইলকস বোথ নামে এক ব্যক্তি তাঁকে মাথার পিছনে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় চিকিৎসার জন্য থিয়েটার থেকে দ্রুত স্থানীয় একটি বাড়িতে নিয়ে গেলে পরদিন সকালেই লিঙ্কন মৃত্যুবরণ করেন।

জেমস গারফিল্ড: আমেরিকার ২০তম প্রেসিডেন্ট গারফিল্ড হত্যাকান্ডের শিকার হওয়া দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার ৬ মাসের মাথায় ২ জুলাই, ১৮৮১ সালে ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইংল্যান্ড যাওয়ার জন্য রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকাবস্থায় চার্লস গুইটো নামক এক আততায়ী গারফিল্ডকে গুলি করে। এরপর হোয়াইট হাউসে কয়েক সপ্তাহ চিকিৎসা নেওয়ার পর সেপ্টেম্বরে নিউ জার্সিতে নিয়ে গেলে গারফিল্ড মৃত্যুবরণ করেন।

উইলিয়াম ম্যাককিনলে: আমেরিকার ২৫তম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম ম্যাককিনলে ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯০১ সালে নিউইয়র্কের বাফেলোতে বক্তব্য দেওয়ার পর স্থানীয়দের সঙ্গে করমর্দন করা অবস্থায় লিয়ন এফ সলগোস নামক এক আততায়ী তাঁর বুকে গুলি করে। এরপর ১৪ সেপ্টেম্বর ডাক্তারদের সমস্ত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ম্যাককিনলে মৃত্যুবরণ করেন।

জন এফ কেনেডি: আমেরিকার ৩৫তম প্রেসিডেন্ট ৪৬ বছর বয়সী ও অত্যন্ত সুদর্শন জন এফ কেনেডি হত্যাকান্ড ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অমীমাংসিত রহস্যগুলোর এবং গত শতকের সবচেয়ে নাটকীয় এবং চাঞ্চল্যকর রাজনৈতিক হত্যাকান্ডগুলোর একটি। পুরো বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল ওই ঘটনা। ২২ নভেম্বর, ১৯৬৩ সালে ছাদখোলা গাড়িতে স্ত্রী জ্যাকুলিনকে নিয়ে টেক্সাসের ডালাস অঙ্গরাজ্য ভ্রমণের সময় দুপুর সাড়ে ১২টায় টেক্সাস স্কুল বিল্ডিংয়ের সামনে তাঁর হাজার হাজার অনুগামীর উপস্থিতিতেই লি হার্ভে অসওয়াল্ড নামক এক আততায়ী জন এফ কেনেডির ঘাড় ও মাথার পিছনে গুলি করে। এর আধ ঘন্টা পর ডালাস পার্কল্যান্ড হসপিটালে চিকিৎসকরা কেনেডিকে মৃত ঘোষণা করেন।

রবার্ট এফ কেনেডি: জন এফ কেনেডির ভাই রবার্ট এফ কেনেডি ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার দৌঁড়ে ছিলেন। ১৯৬৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়া প্রাইমারি ভোটে জেতার পর ভাষণ দিয়ে লস এঞ্জেলসের হোটেলে ফিরছিলেন। সেখানেই তাঁকে গুলি করে খুন করা হয়।

এছাড়া, আমেরিকার ২৬তম প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্টকে ১৯১২ সালে নির্বাচনী প্রচারকালে এক সেলুন কর্মী হত্যা করার চেষ্টা চালায়। ৩২তম প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে ১৯৩৩ সালে মিয়ামিতে হত্যার চেষ্টা চালায় গুইসেপ্পে জাঙ্গারা নামক এক আততায়ী। বন্দুকধারীর হামলায় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও শিকাগো’র মেয়র আন্তন সেরমাক মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৫০ সালে পুয়ের্তোরিকান এক জাতীয়তাবাদী বন্দুকধারী ৩৩তম প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানকে হোয়াইট হাউসের কাছে ব্লেয়ার হাউসে মেরে ফেলার চেষ্টা চালায়। এসময় ট্রুম্যান প্রাণে বেঁচে গেলেও আততায়ী ও হোয়াইট হাউসের এক রক্ষী নিহত হন। ৩৮তম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড ১৯৭৫ সালে ক্যালিফোনিয়ার স্যাক্রামেণ্টোতে একবার এবং সান ফ্রান্সিসকোতে একবার, মোট দু’বার হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছিলেন। ৪০তম আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ১৯৮১ সালে ওয়াশিংটন ডিসিতে হিলটনের বাইরে বক্তব্য রাখার সময় তাঁকে গুলি করা হয়। ২০০৫ সালে জর্জিয়ার প্রেসিডেন্ট সাকাশভিলির সঙ্গে তিবিলিসিতে এক সমাবেশে যোগদান করেছিলেন আমেরিকার ৪৩তম প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ। সে সময় ভ্লাদিমির আরুটিউনিয়ান নামক এক ব্যক্তি বুশকে লক্ষ্য করে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। কিন্তু গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত না হওয়ায় তিনি বেঁচে যান। ২০১১ সালে হোয়াইট হাউসে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও হত্যার চেষ্টা চালায় এক আততায়ী। উল্লেখ্য, এরা সবাই ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান।

মার্টিন লুথার কিং: আমেরিকার বিখ্যাত ও কিংবদন্তি মানবাধিকার নেতা, সারাজীবন বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও কৃষ্ণাঙ্গদের সম-অধিকার আদায়ে লড়াই করা ৩৯ বছর বয়সী মার্টিন লুথার কিং ৩ এপ্রিল, ১৯৬৮ সালে মেম্ফিসে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি পরিচালিত মোটেল লরেনের তৃতীয় তলার ৩০৬ নম্বর কক্ষটি সহযোগী রালফ অ্যাবারন্যাথির সঙ্গে ভাড়া নেন। ৪ এপ্রিল, ১৯৬৮ সালে তিনি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিচতলায় থাকা গাড়িচালক সলোমোন জোন্সের সাথে কথা বলা অবস্থায় লরেন মোটেলের পাশে একটি বোর্ডিং হাউসের ৫ নম্বর কক্ষ থেকে জেমস্ আর্ল রে নামক এক আততায়ী গুলি করে তাঁকে হত্যা করে।

প্যাট্রিক লুলুম্বা: আফ্রিকান জাতীয়তাবাদী নেতা ও কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী প্যাত্রিস এমরি লুমুম্বা কঙ্গোকে বেলজিয়ামের উপনিবেশ থেকে স্বাধীন করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতার কিছুদিন পর মোয়াজ তশোম্বের নেতৃত্বাধীন এবং বেলজিয়ামের মদদপুষ্ট কাতাঙান বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনের বিষয় নিয়ে রাষ্ট্রপতি জোসেফ কাসা-ভুবু ও সেনাপ্রধান মোবতু সেসে সেকো’র সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে সেনাপ্রধান মোবতু সেসে সেকো সামরিক অভ্যূত্থান ঘটান এবং স্তানলেভিলে পালানোর সময় লুমুম্বাকে গ্রেফতার করে কাতাঙ্গান কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। এরপর কাতাঙ্গান ও বেলজিয়াম কর্মকর্তাদের সম্মুখে লুমুম্বাকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করে হত্যা করা হয়।
মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীঃ অহিংস আন্দোলন ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী, ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী। অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করা মহাত্মা গান্ধীকে ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি দিল্লীতে রাত্রিকালীন পথসভা করা অবস্থায় নাথুরাম গডসে নামক এক হিন্দু চরমপন্থী গুলি করে হত্যা করে।

ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধী: ভারতের তৃতীয় ও প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর একমাত্র কন্যা। ৩১ অক্টোবর, ১৯৮৪ সালের সকালে বাসভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর রাষ্ট্রীয় অফিসে যাওয়ার সময় অনেকদিনের বিশ্বস্থ শিখ দেহরক্ষী বিয়ন্ত সিং ও সতবন্ত সিং যথাক্রমে রিভলবার ও টমসন অটোমেটিক কার্বাইন দিয়ে গুলি করে শরীর ঝাঁঝরা করে দেয়। এরপর দ্রুত তাঁকে অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট ফর মেডিকেল সায়েন্স হসপিটালে নেওয়া হলে চিকিৎসকের শত চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিয়ে ভারতের কোটি কোটি মানুষকে কাঁদিয়ে দুপুর ২ টা ২৩ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন। ইন্দিরা গান্ধী ১৯৮৪ সালে ভারত বিরোধী শিখ চরমপন্থীদের দমনের জন্য শিখদের পবিত্র তীর্থস্থান স্বর্ণমন্দিরে সেনা অভিযান চালান। এর প্রতিশোধ নিতেই দুই শিখ দেহরক্ষী বিয়ন্ত সিং ও সতবন্ত শিং এ হত্যাকান্ড চালায়।

রাজীব গান্ধী: ভারতের চেন্নাই শহর থেকে ৩০ মাইল দুরে শ্রীপেরামবুদুর লোকসভা আসনের কংগ্রেস প্রার্থী শ্রীমতি মারাগতাম চন্দ্রশেখরের সমর্থনে ২১ মে, ১৯৯১ সালে ওই শহরের জনসভায় উপস্থিত ছিলেন ইন্দিরা-ফিরোজ গান্ধী দম্পতির জ্যৈষ্ঠ পুত্র এবং ভারতের ৭ম প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। এসময় শ্রীলঙ্কার দুর্ধর্ষ এলটিটিই-এর মহিলা সদস্য তেনমোজি রাজারত্ম ধানু(গায়ত্রী) আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। ধানু রাজীব গান্ধীকে পর্দস্পর্শ করে অভিভাদন জানানোর ভঙ্গিতে কৌশলে পোশাকের নিচে বাঁধা আরডিএক্স ভর্তি বেল্টটি ফাটিয়ে দেয়। ফলে সঙ্গে সঙ্গে রাজীব গান্ধী-সহ আরো কয়েকজন সমর্থকের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় এবং রাত ১০টা ১০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই-দের দমনের উদ্দেশ্যে রাজীব গান্ধী শ্রীলঙ্কার অনুরোধে ভারতীয় শান্তিরক্ষী পাঠানোর ঘটনার প্রতিবাদে এ আত্মঘাতি হামলা চালানো হয়।

সৌদি বাদশাহ ফয়সাল: সৌদি আরবের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আধুনিক নীতি প্রণয়ন-সহ বিভিন্ন সংস্কারের কারণে জনপ্রিয়তা লাভ করা সৌদি বাদশা ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ ২৫ মার্চ, ১৯৭৫ সালে রাজপ্রাসাদে কুয়েতি এক প্রতিনিধি দলকে স্বাগত জানাতে গেলে প্রতিনিধি দলের সঙ্গে প্রাসাদে প্রবেশ করেন বাদশার ভাইপো ফয়সাল বিন মুসাঈদ। বাদশা ফয়সাল একটু ঝুঁকে ভাইপোকে চুমু খেয়ে অভ্যর্থনা জানাতে গেলে তখনই পকেট থেকে রিভলবার বের করে মুসাঈদ সৌদি বাদশাকে গুলি করে হত্যা করে।

আনোয়ার সাদত: ৬ অক্টোবর, ১৯৮১ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোতে সামরিক কুচকাওয়াজ চলাকালে কয়েকজন সেনাসদস্য প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত্কে গুলি করে হত্যা করে। ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে ইসরাইল কর্তৃক দখল করে নেওয়া সিনাই উপদ্বীপ ফিরে পেতে আনোয়ার সাদত ইসরাইলের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তি করে। এটাই তাঁর হত্যাকান্ডের অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা হয়।

আইজ্যাক রবিন: ৪ নভেম্বর, ১৯৯৫ সালে ইগল আমির নামক এক উগ্রপন্থী ইহুদি ইসরাইলের সবচেয়ে ভদ্র ও নম্র প্রধানমন্ত্রী আইজ্যাক রবিনকে হত্যা করে। তিনি ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৩ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সঙ্গে অসলো চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তি স্বাক্ষরের কারণেই ইসরাইলের রক্ষণশীলদের হাতে রবিনকে জীবন দিতে হয় বলে অনুমান করা হয়।

রফিক হারিরি: লেবাননের উন্নতির রূপকার প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরি ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫ সালে এক গাড়ি বিস্ফোরণে নিহত হন। এখন পর্যন্ত এ দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর কারণ জানা না গেলেও সিরিয়ার শিয়া সরকার ও লেবাননের শিয়া বিদ্রোহী সংগঠন হিজবুল্লাহকে তাঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয়।

বেনিনো অ্যাকু্‌ইনো: ২৩ আগস্ট, ১৯৮৩ সালে চিকিৎসা শেষে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসে ম্যানিলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ থেকে নামামাত্র এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন ফিলিপাইনের বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদ বেনিনো অ্যাকুইনো। মাত্র ১৭ বছর বয়সে দ্য ম্যানিলা টাইমস্ পত্রিকার জন্য কোরীয় যুদ্ধে সর্বকনিষ্ঠ যুদ্ধ সংবাদদাতা হিসেবে সংবাদ সংগ্রহ করা এবং ফিলিপাইন লিজিওন অব অনার পুরস্কারে ভূষিত ফিলিপাইনের দুঃসাহসি এই রাজনীতিবিদ প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্ড মার্কোসের স্বৈরাচারী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেছিলেন এবং জনগণকে মার্কোসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। এটাই বেনিনো অ্যাকুইনোকে হত্যার কারণ বলে প্রতীয়মান হয়।

লিয়াকত আলী খান: ১৬ অক্টোবর, ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগের জনসমাবেশে বক্তৃতা করা অবস্থায় সৈয়দ আকবর নামের এক আততায়ী গুলি করে হত্যা করে। যুক্তরাষ্ট্রের শর্তানুযায়ী গোপনে ঠিক করে রাখা অপর ২ জন আততায়ী সৈয়দ আকবরকে হত্যা করলে সমাবেশে থাকা জনগণ ২ জন আততায়ীকেই পিটিয়ে হত্যা করে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলে লিয়াকত আলী খান হত্যার সমস্ত প্রমাণ মুছে ফেলে। ইরানের তেলক্ষেত্র নিয়ে তেহরানের সঙ্গে চুক্তির ব্যাপারে সহযোগীতা করতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের প্রস্তাব লিয়াকত আলী খান প্রত্যাখান করায় এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় বলে পরবর্তীতে প্রকাশিত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নথি থেকে প্রকাশ পায়।

বেনজির ভুট্টো:বিশ্বে: ‘ডটার অব দ্য ইস্ট’ নামে খ্যাত, সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো’র বড় মেয়ে, পাকিস্তানের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো। ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৭ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে তাঁর দল ‘পিপিপি’র এক নির্বাচনী র‍্যালীতে অংশ নিয়ে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ার জন্য বুলেট প্রুফ গাড়ি থেকে মাথা বের করলে তাঁকে লক্ষ্য করে এক আততায়ী গুলি করে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাঁকে রাওয়ালপিন্ডি জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হলে সেখানেই সন্ধ্যা ৬টা ১৬ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: বাংলাদেশের জাতির পিতা, প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সালে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য সপরিবারে হত্যা করে। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর দু’মেয়ে যথাক্রমে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ছোট মেয়ে শেখ রেহানা ভাগ্যক্রমে বিদেশে অবস্থান করায় বেঁচে যান। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পাকিস্তানের একজন ছাত্রনেতা থেকে ধাপে ধাপে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে ক্রমান্বয়ে তিনি আওয়ামীলীগের জাতীয় নেতৃত্বের উচ্চপদে আসীন হন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের পর জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে তিনি পাকিস্তানের গলার কাঁটা ও বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা দাবী পেশ করলে পাক সরকার তাঁকে-সহ মোট ৩৫ জনকে আসামী করে ১৯৬৮ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা দায়ের করে। এই মামলায় ১৯৬৯ সালে তিনি-সহ ৩৫ জনই নির্দোষ প্রমাণিত হন ও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী, নির্যাতক, নিপীড়ক জেনারেল আয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং ক্ষমতায় আসীন হন আরেক স্বৈরাচারী জেনারেল ইয়াহিয়া খান। ১৯৭০’র সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বিপুল জয়লাভ করলেও পাক সরকার আওয়ামীলীগকে সরকার গঠন করতে দেয়নি। উপরন্ত ১৯৭১’র ২৫ মার্চের কালরাতে পাকবাহিনী নির্বিচারে বাঙালি হত্যা শুরু করলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৯ মাস যুদ্ধ করে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং ২ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমেরিকা, চীন, সৌদিআরবের রক্তচক্ষুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাঙালিরা এদেশ স্বাধীন করে। বিশিষ্টজনরা মূলত এটাই বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণ বলে মনে করেন।

চার জাতীয় নেতা হত্যা: ১৯৭৫’র ১৫ আগস্ট সপরিবারে নির্মমভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মন্ত্রীসভার সবচেয়ে ঘৃণিত, বেঈমান, মোনাফেক ও বিশ্বাসঘাতক সদস্য মুশতাক স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি বনে যান। এরপর ৩ নভেম্বর মেজর খালেদ মোশারফ পাল্টা অভ্যূত্থান ঘটিয়ে মুশতাক সরকারকে উৎখাত করলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহচর, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী, চার জাতীয় নেতা যথাক্রমে তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামানকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পূর্বপরিকল্পনা মাফিক নির্মমভাবে খুন করে। যাতে নতুন সরকার গঠন হলেও আওয়ামীলীগের এই নেতারা সেই সরকারে নেতৃত্ব দিতে না পারে, সে উদ্দেশ্যে হত্যাকারীরা চার জাতীয় নেতাদের হত্যা করে।

জিয়াউর রহমান: জিয়াউর রহমান নিজদল বিএনপি’র চট্টগ্রামের স্থানীয় নেতাদের বিরোধ মেটাতে ২ দিনের সফরে ২৯ মে, ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম গিয়েছিলেন। সেখানে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে ৩০ মে রাতে একদল সেনা কর্মকর্তা জিয়াকে গুলি করে হত্যা করেন।

শেখ হাসিনার জনসভায় হামলা: ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামীলীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামীলীগের জনসভায় আর্জেস গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। ওই হামলার মূল লক্ষ্য ছিল জননেতা শেখ হাসিনা-সহ আওয়ামীলীগের প্রথম সারির নেতাদের হত্যা করা। ওই সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামাত জোট সরকার। ওই হামলাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সবচেয়ে বড় ধংসাত্মক হামলা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। দেশের ইতিহাসে অন্যতম ওই ঘৃণ্য হামলায় আওয়ামীলীগ নেতা আইভি রহমান-সহ ২৪ জন নিহত হন এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা-সহ প্রায় ৩০০ জন মারাত্মক আহত হন। যারা এখনো বেঁচে আছেন, তাঁরা শরীরে বোমার স্প্রীন্টার বহন করে দুর্বিসহ জীবন অতিবাহিত করছেন।

এছাড়া, ২৭ অক্টোবর, ২০১৩ সালে বিহারের পাটনায় দলের নির্বাচনী মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দেওয়ার সময় ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং গুজরাটের তৎকালীন মূখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদির ওপরে একাধিক বোমা হামলা হয়। ভাগ্যক্রমে মোদিজী বেঁচে গেলেও ৬ জন সমর্থকের মৃত্যু হয়। তদন্তে জানা যায়, বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জনতার মধ্যে হুড়োহুড়ি পরিস্থিতি তৈরির উদ্দেশ্য ছিল হামলাকারীদের। যাতে ভীড়ের মধ্যে মোদির ওপর প্রাণঘাতী হামলা চালানো যায়। একইভাবে জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের ওপরে হামলা হয়েছে, আক্রান্ত হয়েছে স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো। এবার সেই তালিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামও যুক্ত হলো। বিশ্বজুড়ে এভাবেই জনদরদী রাষ্ট্রনায়ক ও জনপ্রিয় নেতাদের হত্যা করা হয় এবং প্রজন্ম ধরে ওঠে আসা বর্তমান ক্ষমতাশালী নেতাদের শেষ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তারপরে সন্ত্রাসবাদীরা দেশে দেশে পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠা করে নানা দেশে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।