ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৭ জুলাই ২০২৫, ২ শ্রাবণ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

মেঘের আড়ালে চেতনার আলোর দীপ

২০২৪ আগস্ট ২১ ১৬:৫১:৩৪
মেঘের আড়ালে চেতনার আলোর দীপ

আবু মকসুদ


অনেকেই এখন আমাকে লেখালেখি বন্ধ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তারা বিষয় পরিবর্তনেরও পরামর্শ দিচ্ছেন; তাদের মতে, আমার বিষয়গুলো সাংঘর্ষিক এবং একঘেয়েমি হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগ করা হচ্ছে, আমি আজ যা লিখছি, কাল তার পুরোপুরি বিপরীত মতামত দিচ্ছি। কেউ কেউ আবার আমাকে নির্দিষ্ট বিষয় নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, অনেকে চান আমি তাদের মতের পক্ষে লিখি বা ভারসাম্য বজায় রেখে কিছু বলি।

আমার ফেসবুকের এক বন্ধু, একজন বিজ্ঞানী, তার মতে, আমার প্রতিটি লেখা ভালোভাবে শুরু হলেও শেষে তা একঘেয়েমি এবং একপেশে হয়ে যায়। এই ভদ্রলোক একটি আজব চরিত্র; বড়শিতে মাছ ধরার জন্য যেমন টোপ লাগে, তেমনি তার টোপ হলো খাম্বা এবং খালকাটা প্রসঙ্গ। ভদ্রলোক আমার প্রতিটি লেখা পড়েন, প্রতিটি; কিন্তু মন্তব্য করেন সেখানে, যেখানে খাম্বা এবং খালকাটার প্রসঙ্গ আসে। তার মন্তব্যে সবসময় আমার জন্য সুস্থতার দোয়া থাকে। তার মতে, খাম্বা এবং খালকাটা নিয়ে এত বেশি লেখালেখি করতে করতে আমি অসুস্থ হয়ে গেছি। আমি যদি ১০০টি স্ট্যাটাস লিখি, হয়তো তার মধ্যে একটি স্ট্যাটাসে খাম্বা এবং খালকাটার ভয়াবহ প্রভাব সম্পর্কে সবাইকে অবগত করি। অথচ ৯৯টি লেখা ইগনোর করলেও, কেন ভদ্রলোক খাম্বা এবং খালকাটা ইগনোর করতে পারেন না? আসলে এখানে অসুস্থ কে? ভদ্রলোক হয়তো একটা বিষয় বুঝতে পারেন না, তা হলো খাম্বা এবং খালকাটা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অসুখ, যা হাসিনার স্বৈরাচারের চেয়েও লক্ষ-কোটি গুণ ভয়াবহ।

যারা আমাকে লেখালেখি বন্ধের পরামর্শ দিচ্ছেন, তারা আমার বুদ্ধিজীবী মার্কা বিভিন্ন স্ট্যাটাস নিয়ে বিরক্ত। আমার এক বন্ধু ফোনে বললেন, "আপনি কি সব আবোল-তাবোল লিখছেন? আজ যা লিখছেন, কাল তার বিপরীত কিছু লিখছেন। এভাবে লিখে কি বুদ্ধিজীবী খেতাব পাওয়া যাবে?" আমি তাকে বললাম, যদি আমি সত্যিই একজন বুদ্ধিজীবী হতাম, তাহলে হয়তো নির্দিষ্ট মতাদর্শে আটকে থাকতাম এবং শুধু একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকেই লিখতাম। কিন্তু আমি বুদ্ধিজীবী নই, তাই বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করি এবং বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রকাশ করি। আমার লেখায় আমার নিজস্ব চিন্তা-প্রক্রিয়ার বিকাশ ঘটে এবং আমার লেখালেখি আরও বৈচিত্র্যময় হয়। চিন্তার সীমাবদ্ধতার পরিবর্তে মতামতের মুক্তি ও পরিবর্তনই একজন প্রকৃত লেখকের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। বুদ্ধিজীবী কিংবা বুদ্ধির ঢেঁকি হওয়ার কোন খায়েশ আমার নেই। কোনো জীবী না হয়ে আমি বেশ ভালো আছি।

আমার লেখার মাধ্যমে আমি সবসময়ই চাই, সমাজের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারাকে সামনে নিয়ে আসা হোক। আমার লেখার কারণে যদি মানুষ নতুন কিছু ভাবে, সেটাই আমার জন্য বড় প্রাপ্তি। যারা নিজেদের মতামতকে অপরিবর্তনীয় মনে করে, তারা সমাজের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে। লেখক হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো মতামত ও চিন্তাকে অবাধে প্রবাহিত করা এবং অন্যদের উৎসাহিত করা যেন তারা নতুন করে চিন্তা করতে পারে।

স্বৈরাচার হাসিনার পতনের পরে আমরা ভেবেছিলাম মানুষের মধ্যে সহনশীলতা ফিরে আসবে। মানুষের বাকস্বাধীনতা ছিল না, এটাই হাসিনার আমল নিয়ে প্রধান অভিযোগ। এখন যদি মুক্তমতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তাহলে মানুষের মতকে কেন চেপে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে? কেন আমার লেখালেখিকে জোর করে নিজের মতের সাথে মিলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে? আমি কি লিখবো বা না লিখবো, সেটা আমি নিজে ঠিক করলে অন্যদের অসুবিধা কী? আমি কাউকে আমার লেখা পড়তে আমন্ত্রণ জানাই না; প্রাসঙ্গিক না হলে কাউকে ট্যাগও করি না। আপনারা স্বেচ্ছায় আমার লেখা পড়তে আসেন, তাহলে আমাকে উপদেশ না দিয়ে এই উপদেশগুলো নিজেই আমল করুন।

আমার অবস্থান বরাবরই আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল। আমি যেহেতু আওয়ামী লীগের সক্রিয় কোনো সদস্য ছিলাম না, তাই দলের সব সিদ্ধান্ত মানার কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। বাংলাদেশের সবকটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আমি আওয়ামী লীগের সাথে আমার চিন্তার কিছু মিল পেয়েছিলাম। কিন্তু যখনই আওয়ামী লীগ অন্যায় করেছে, আমি তা প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছি। সুন্দরবন নিয়ে প্রতিবাদ করেছি, শহিদুল আলমকে যখন নিগৃহীত করা হয়েছে, আমি প্রতিবাদ করেছি, ভিন্নমতের কারণে আদিলুর রহমানকে যখন নিগৃহীত করা হয়েছে, আমি প্রতিবাদ করেছি। দিগন্ত টিভি ও ইসলাম চ্যানেল বন্ধ করা হলে আমি প্রতিবাদ করেছি, আমার দেশ নিষিদ্ধ হলে আমি প্রতিবাদ করেছি। এমনকি প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিতর্কিত মন্তব্যেরও কড়া প্রতিবাদ করেছি।

কিন্তু যখন শেখ হাসিনা দেশের জন্য কাজ করেছেন, দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছেন, তখন তাকে নিঃশর্ত সমর্থন দিয়েছি। শেখ হাসিনার ওপর অসংখ্যবার অন্যায় হয়েছে—এর কোনো সন্দেহ নেই। তার পুরো পরিবারকে হত্যা করা হয়েছে ৭৫ এর ১৫ আগস্টে। ৮১ সালে দেশে ফিরতে চাইলেও বাধা দেয়া হয়েছে। তাকে হত্যা করার জন্য অসংখ্যবার চেষ্টা করা হয়েছে; কোটালীপাড়ায় কয়েক টন ওজনের বোমা পুঁতে রাখা হয়েছে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তাকে তার পুরো দলসহ নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে। আইভি রহমানসহ প্রায় ২২ জন মানুষ সেই হামলায় নিহত হন। এসব অন্যায় মেনে নেয়া যায় না।

কিন্তু শেখ হাসিনার সাথে অন্যায় হয়েছে বলেই তিনি অন্যায় করবেন, আর আমরা তা বিনা শর্তে মেনে নেব—এটা কোন সুস্থ মাথার চিন্তা হতে পারে না। একজন নেতা হিসেবে তার দায়িত্ব জনগণের জন্য কাজ করা, নিজের স্বার্থে নয়। যখন একজন নেতা নিজের স্বার্থে কাজ করে, তখন তার প্রতি মানুষের আনুগত্য ও বিশ্বাস ক্ষুণ্ণ হয়।

শেখ হাসিনা ছাত্রদের সাথে স্পষ্ট অন্যায় করেছেন। এখানে "যদি" কিংবা "কিন্তু" কোনো সুযোগ নেই। শাহবাগের আন্দোলনের সময় রাজাকার সম্প্রদায় যখন বলতো, "আমরাও বিচারের পক্ষে কিন্তু..." তখন আমরা তাদের মুখে লাথি মেরে নরকের রাস্তা দেখিয়ে দিতাম। শেখ হাসিনার অন্যায় যদি "যদি" "কিন্তু" দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করা হয়, তাহলে রাজাকারদের সাথে আমাদের কোনো পার্থক্য থাকে না।

শেখ হাসিনা যখন নিরস্ত্র, নিরপরাধ ছাত্রদের বুকে নির্বিচারে গুলি চালান, তখন তিনি জাতির পিতার কন্যা হিসেবে তার সমস্ত নৈতিক অধিকার হারান। এমন সিদ্ধান্তে তিনি নিজের আদর্শ ও নীতির সম্পূর্ণ বিপরীতে চলে যান, যা বঙ্গবন্ধুর চেতনার সাথেও বেমানান। এই নির্মমতায় তার প্রতি মানুষের আনুগত্য, মায়া এবং আস্থা কেবল ক্ষুণ্ণ হয় না, বরং সেইসব অনুভূতির অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যায়। ছাত্রদের উপরে গুলি চালানোর সাথে সাথে তার প্রতি যে ন্যূনতম সহানুভূতি ছিল, তা তো ধ্বংস হয়েই গেছে; বরং তার এই আচরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে তাকে একজন স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে চিহ্নিত করবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড কেবল তার রাজনৈতিক অবস্থানকেই দুর্বল করে না, বরং দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে চিরতরে কলুষিত করে।

তিনি বর্তমানে স্বৈরাচারী শাসক হিসেবে পরিচিত হয়েছেন, যার শাসনামলে অন্যায়, দমন-পীড়ন এবং ভয় সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছিল। তার স্বৈরশাসনের কারণে দেশের মানুষের মধ্যে যে ভীতি ও হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে, তার নেতাকর্মীরাও তার থেকে রেহাই পায়নি। প্রত্যেকেই নিজেকে অরক্ষিত ও অসহায় বোধ করছে, এমনকি যারা একসময় তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিল তারাও এখন প্রচণ্ড ভয়ের মধ্যে দিনাতিপাত করছে। কোনো সত্যিকারের সেনাপতি কখনো তার সৈন্যদের ছেড়ে পালায় না, কিন্তু শেখ হাসিনা ঠিক সেই কাজটাই করেছেন। এক কাপুরুষের মতো দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে, তিনি শুধু নিজের মর্যাদা নয়, পিতার উত্তরাধিকার এবং জাতির প্রতি তার দায়িত্বকেও কলঙ্কিত করেছেন। তার এহেন আচরণ প্রমাণ করেছে যে, তিনি জনগণের আস্থার অযোগ্য এবং তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।

ছাত্রদের বুকে নির্বিচারে গুলি চালানোর কারণে তার প্রতি সমস্ত আনুগত্য প্রত্যাহার করে নিয়েছি। তাকে এখন আমার বিশ্ব বেহায়া এরশাদ কিংবা এতিম আত্মসাৎ খালেদার মত একজন স্বৈরাচারী ছাড়া বেশি কিছু মনে হয় না।

তার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ অবশিষ্ট নেই, কিন্তু বঙ্গবন্ধু আমার চিন্তা ও চেতনায় জাগরুক। শেখ হাসিনার প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিলেও আমি বঙ্গবন্ধুকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছি। শেখ হাসিনার পতন কোনো আদর্শের পতন নয়, এটি তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যর্থতার ফল। শেখ হাসিনা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও আমাদের বেঁচে থাকতে হবে; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন।

এক কবি বন্ধু, যিনি নিউইয়র্কে থাকেন, কথাপ্রসঙ্গে বললেন, "আমার কি শেখ হাসিনার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি দরদ বেশি?" আমি বললাম, অবশ্যই; যতদিন পর্যন্ত আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে হত্যা করছি না, ততদিন পর্যন্ত আমি শেখ হাসিনার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতি অধিক প্রেমিক। শেখ হাসিনা ছাত্রদের বুকে গুলি চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পুরোপুরি বিসর্জন দিয়েছেন। তাকে আর বঙ্গবন্ধুর অনুসারী ভাবা যায় না, এমনকি তিনি জাতির পিতার কন্যা হলেও না।

আমাকে নিয়ে অনেকে অভিযোগ করেছেন যে, আমি নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি না, বরং তাদের নিয়ে নেতিবাচক কথা বলছি। যারা আমাকে অভিযোগে অভিযুক্ত করছেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন এই দেশের নাম বাংলাদেশ এবং জাতিতে আমরা বাঙালি। ৯০-এর গণআন্দোলনের সময় এরশাদের পতনের পরে যে উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল, তা বর্তমান উচ্ছ্বাসের চেয়ে হাজার গুণ বেশি ছিল। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাসের পরিণতি কী হয়েছিল, তা এতিম আত্মসাৎ খালেদাকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারেন। ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়ও এমন উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল, যার পরিণতি আমরা সকলেই জানি।

ছাত্রদের রাস্তা পরিষ্কার ও ট্রাফিক কন্ট্রোলে আপনারা যে বিপ্লব দেখছেন, আমি সেটা দেখি না কারণ বাঙালির স্বভাব সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা আছে। সরকারকে আমি অভিনন্দন না জানালেও কিছুই আটকে থাকবে না; সরকার সরকারের মতই চলবে। আমি চাই, সরকার আমার আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করুক। ছাত্ররা আমার আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করুক। গণ আন্দোলনের পরে মানুষের যদি সামান্যতম পরিবর্তন হয়, তাহলে আমি অত্যন্ত খুশি হব। এবং সরকারকে সঠিক সময়ে অভিনন্দন না জানানোর জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবো।

আমি বিশ্বাস করি, একজন লেখকের দায়িত্ব হলো সমাজের অসঙ্গতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা। লেখকরা যদি চুপ থাকেন, তাহলে সমাজে ন্যায়বিচার ও সত্য প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি, আমার লেখার মাধ্যমে মানুষের চিন্তাকে জাগ্রত করতে, সমাজের সঠিক চিত্র তুলে ধরতে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। আমার লেখাগুলো হয়তো সবার মনপুত হবে না, কিন্তু আমি জানি, আমার লেখাগুলো সমাজের বাস্তবতা এবং মানুষের অভিজ্ঞতার প্রতিফলন।

আমি আমার মত প্রকাশে স্বাধীন এবং আমার লেখার মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে বদ্ধপরিকর। কেউ যদি এতে আপত্তি করে, সেটা তার ব্যক্তিগত সমস্যা। আমি আমার নিজের পথে চলবো, সবার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে।

লেখক : যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক।