প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
অ্যালজাইমার্স রোগে কারো মৃত্যু হয় না, প্রয়োজন জ্ঞান ও সচেতনতা
২০২৪ সেপ্টেম্বর ২০ ১৭:১৫:৪০ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
অ্যালজাইমার্স এমন রোগ, যেখানে মস্তিষ্কের কোষগুলি বিকল হতে শুরু করে। প্রথম দিকে এর উপসর্গ বোঝা যায় না। এই রোগের কিছু কারণ রয়েছে।বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নানান জিনিস ভুলে যাওয়া একটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। খুব ছোটখাটো জিনিস আমাদের মাথা থেকে বেরিয়ে যায়। চশমা খুলে রাখলাম টেবিলে, পরক্ষণেই ভুলে গেলাম কোথায় রেখেছি চশমা। এমনই ধরনের সমস্যা পড়ে ঘোরতর হয়। প্রথমে বিষয়টা সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তবে এই ভুলে যাওয়ার রোগ বাড়তে বাড়তে এমন জায়গায় পৌঁছয় যে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা মারাত্মক প্রভাবিত হয় তাতে। আচরণের মধ্যেও নানা ধরনের পরিবর্তন চোখে পড়ে। এই ভয়ঙ্কর রোগই হল অ্যালজাইমার্স।আর এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোগ যাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েই দেখা উচিত। এবং এটার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিশ্ব অ্যালজাইমার্স দিবস পালন করা হয়। এক ধরনের ডিমেনশিয়া হচ্ছে এই অ্যালজাইমার্স রোগটি। আর দিন দিন এই রোগ গোটা বিশ্ব ভয়াবহ আকারে বেড়েই চলেছে। তাই যাতে সাধারণ মানুষ এই রোগটা নিয়ে সচেতন হয়, সতর্ক হয় তার জন্যই ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জুড়ে পালিত হয় অ্যালজাইমার্স ডে।
এটি একটি নিউরোডিজেনেরেটিভ রোগ যা ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং পরে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কেসেই এটা ডিমেনশিয়ার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ক্রমশ বাড়ছে এই রোগের প্রকোপ এবং চিকিৎসকরা মনে করছেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি ৮৫ জন ষাটোর্ধ্ব মানুষের মধ্যে অন্তত ১জন আক্রান্ত হতে পারেন এই রোগে। তাই, রোগটি সম্পর্কে সচেতনতা জরুরি
অ্যালজাইমার্স শব্দটি শুনলে যেটা আমাদের মনে পড়ে যে কথা ভুলে যাওয়া, কিছু মনে রাখতে না পারা, ইত্যাদি।
এই দিনটির ইতিহাস কী?
১৯০১ সালে প্রথমবার একজন জার্মান মনোবিদ অ্যালয়েজ অ্যালজাইমার এই রোগটিকে চিহ্নিত করেন, তখন থেকেই এই রোগটিকে অ্যালজাইমার্স রোগ নামে ডাকা হয়ে থাকে। এই রোগটি তিনি একজন ৫৫ বছর বয়সী মহিলার মধ্যে চিহ্নিত করেছিলেন। এবং ১৯০৬ সাল পর্যন্ত অ্যালজাইমার তাঁর চিকিৎসা করেন এবং পর্যবেক্ষণও করেন গভীর ভাবে। তারপর সেই মহিলার মৃত্যুর পর তিনি এই রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান প্রকাশ্যে। এরপরের পাঁচ বছর একই ধরনের বহু কেস আসতে থাকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। আর তখন থেকেই তখন এই রোগটিকে অ্যালজাইমার্স বলে অভিহিত করা শুরু করে।
বিংশ শতাব্দীতে ৪৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সীদের মধ্যেই এই রোগ হতে দেখা যায় সব থেকে বেশি। আর রোগ থেকেই ডিমেনশিয়া হতে থাকে। ১৯৮৪ সাল থেকে অ্যালজাইমার্স ডিজিজ ইন্টারন্যাশনাল এই রোগে আক্রান্ত মানুষদের চিকিৎসা করাতে সাহায্য করতে থাকে এবং একই সঙ্গে সচেতনতাও ছড়াতে থাকে। ১৯৯৪ সালে এই সংস্থাই ২১ সেপ্টেম্বরকে বেছে নেয় বিশ্ব অ্যালজাইমার্স দিবস হিসেবে, যেদিন এই রোগের গুরুত্ব, ভয়াবহতা ইত্যাদি সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করা হবে। ২১ তারিখ বেছে নেওয়া হয়েছিল কারণ ১৯৯৪ সালে এই সংগঠনের ১০ বছর পূর্ণ হয়েছিল ওই দিনই তাই।
এই দিনের গুরুত্ব কী?
বিশ্ব অ্যালজাইমার রিপোর্ট ২০০৯ সালের অ্যালজাইমার্স দিবসের দিন প্রকাশ্যে আনা হয় যাতে সেটার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা যায়। এর পর থেকে প্রতি বছরই এই দিন রিপোর্টটি প্রকাশ করা হতে থাকে যে রোগটি কোন ভয়াবহ হারে প্রতি বছর বাড়ছে, বর্তমান ছবি কী সেটা তুলে ধরার জন্য।
এই রোগের তিনটি ধাপ হয়, প্রাথমিক ধাপে রোগ ধরা পড়লে এবং সঠিক চিকিৎসা হলে দ্রুত সেরে ওঠা যায়। কিন্তু শেষ ধাপে যখন ধরা পড়ে এই রোগটি তখন আর কিছুই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এই রোগের মূল লক্ষণ হচ্ছে সব জিনিস ভুলে যাওয়া, কিছু মনে রাখতে না পারা। পরে সেটা বাড়তে বাড়তে কথা বুঝতে না পারা, ভাষা চিনতে বা বলতে না পারা, মুড সুইং, হারিয়ে যাওয়ার সমস্যা বাড়তে থাকে।
অ্যালজাইমার্স রোগ কেন হয়
অ্যালজাইমার্স রোগের পেছনে নির্দিষ্ট কোনও কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞরা জানান, মস্তিষ্কের নার্ভ সেলগুলো নষ্ট হয়ে গেলে এমন লক্ষণ দেখা দেয়। দুটো কারণে এই লক্ষণ হতে পারে। প্রোটিন ডিপোজিট কিংবা কোনও ধরণের অসুস্থতা থেকে এবং জিনগত বা অনিয়মিত, খারাপ জীবনযাত্রা থেকে মস্তিষ্কের সেলগুলোতে প্রভাব পড়ে। যা থেকে অ্যালজাইমার্স রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
অ্যালজাইমার্স-এর কিছু রিস্ক-ফ্যাক্টর আছে:-
হ্যাঁ, অ্যালজাইমার্স ডিজিজ হওয়ার সঙ্গে কিছু রিস্ক-ফ্যাক্টর যুক্ত থাকে। এগুলি এই রোগ তৈরিতে এবং তীব্রতায় প্রভাব ফেলে। যেমন–
* নিম্ন সামাজিক-অর্থনৈতিক শ্রেণি
* বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন
* দুর্বল সামাজিকতা
* অলস মস্তিষ্ক বা মস্তিষ্কের যথোপযুক্ত ব্যবহার না করা
* প্রবল পারিবারিক চাপজনিত বিষণ্ণতা
হাইপারটেনশন ও ব্লাড সুগারের মতো ভাস্কুলার রিস্ক ফ্যাক্টরসমূহ, যা মস্তিষ্কে রক্ত প্রবাহ হ্রাস করে, যার ফলে ডিমেনশিয়া বৃদ্ধি পায়। যদিও, এরফলে সরাসরি অ্যালজাইমার্স ডিজিজ তীব্রতর হয় না।
কী উপসর্গে ধরা পড়বে আলজাইমার্স রোগটি
আলজাইমার্স রোগে ধীরে ধীরে স্মৃতি লোপ পাবে। চেনা মানুষের নাম ভুলে যাওয়া, পরিচিতি রাস্তা হারিয়ে ফেলা, প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা মনে না থাকাসহ ছোট বড় অনেককিছুই স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। সামাজিক অ্যাক্টিভিটি ও সম্পর্কগুলোকে ভুলে যেতে থাকবেন। সবার সঙ্গে গুছিয়ে কথা বলতে পারবেন না। রোগী ঠিকভাবে লিখতে বা পড়তে পারবেন না। কোনও কিছু পড়ার সময় সমস্যা হলে এবং দূরত্ব নির্ণয় করতে সমস্যা হলে তা অবশ্যই অ্যালজাইমার্সের লক্ষণ।
রোগী যেকোনও বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে পারবেন না। কোনও কথা বলতে বলতে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাওয়াও এই অসুখের অন্যতম লক্ষণ।
আচমকাই মেজাজ বদলে যাওয়া, পরিচিত এবং ঘনিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে অকারণে রাগ করাও এর লক্ষণ। রোগীদের মধ্যে সন্দেহ প্রবণতা, উদ্বেগ, অবসাদের মতো লক্ষণ দেখা দেয়।আর এই রোগের কিছু কারণ রয়েছে। সেগুলি হল- জেনেটিক বিষয়, পারিপার্শ্বিক বিষয়, বার্ধক্যজনিত কারণ, লাইফস্টাইলের সমস্যা যেমন, ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া না করা অথবা নিয়মিত এক্সারসাইজ না করা। তাই আগে থেকেই সতর্কতা মেনে চলতে হবে। গবেষণায় পাওয়া গেছে যে, কিছু খাবার আছে, যেগুলো অ্যালজাইমার্সের ঝুঁকি কমিয়ে দিতে সাহায্য করে।
* শাক-সবজি: শাক-পাতা কি একেবারেই খেতে পছন্দ করেন না বললে আর চলবে না। ডায়েটে যোগ করুন শাক-পাতা। আর নিয়মিত খেতে হবে সবুজ সবজি, কারণ শাক-পাতা আপনার ব্রেনের কর্মক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। একটা স্টাডিতে দেখা গিয়েছে, সবুজ শাক-পাতায় রয়েছে ভিটামিন বি৯ বা ফোলেট, যা ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়।
* ডার্ক চকোলেট: চকলেট তো সবাই খেতে ভালবাসে। চকলেট আপনার হার্টকে ভাল রাখে। চকলেট হতাশা দূর করে। প্রচুর গুণ রয়েছে চকলেটের। এই চকোলেটই আবার অ্যালজাইমার্সের দাওয়াই। এক গবেষণা রিপোর্টে এমনটাই দাবি করা হয়েছে। তবে, সব চকোলেট নয়। ডার্ক চকেলেটেরই এই বিশেষ গুণ রয়েছে। সতেজ রাখতে সাহায্য করে আপনার মস্তিষ্ককে। মার্কিন গবেষক গিউলিও মারিয়া পাসিনেত্তি জানান, ডার্ক চকলেটের মধ্যে রয়েছে পলিফেনলস। মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস সেই পলিফেনল স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই উপকারী।
* কফি: আপনি কফিতে আসক্ত হলে তো ভালই। কারণ ক্যাফিন বিশেষ করে কফি পান করলে অ্যালঝাইমার্সের ঝুঁকি অনেকটা কমানো যেতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, স্মৃতিশক্তির ক্ষেত্রে দারুণ কাজ করে কফি বা ক্যাফিন।
* নানা ধরণের বেরি: অ্যালজাইমার্সের খুব ভাল দাওয়াই হল বেরি জাতীয় ফল। স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি- এই সব ফলের প্রচুর গুণ রয়েছে। যা আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ৮ থেকে ১০ বছর বয়স থেকে শুরু করে বয়স হওয়া পর্যন্ত এই ধরনের বেরি জাতীয় ফল খেলে মস্তিষ্কের ক্ষমতা ভাল হয়।
* সামুদ্রিক মাছ: যে সব মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, সেই সব মাছ আপনার মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য দারুণ উপকারী। সে ক্ষেত্রে অ্যালঝাইমার্সের ঝুঁকি কমাতে স্যালমন, টুনা, ম্যাকরেল-এই ধরনের ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডযুক্ত মাছ দারুণ।
> অ্যালজাইমার্স ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেতে জীবনযাত্রায় কী ধরনের সহজ পরিবর্তন আনা যেতে পারে?
যেসব ব্যক্তির কোনও সক্রিয় জীবন নেই, তারা ক্রসওয়ার্ড পাজল সমাধান করতে পারেন, নিয়মিত সামাজিক কর্মকাণ্ডে যোগ দিতে পারেন এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ভিত্তিক বিতর্কে অংশ নিতে পারেন। এর ফলে মস্তিষ্ক সর্বদা সক্রিয় থাকবে। আর মস্তিষ্ক সক্রিয় রাখতে পারলে, অ্যালজাইমার্স ডিজিজকেও দূরে রাখা সম্ভব।
অ্যালজাইমার্স কি সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব?
না। এই রোগের কোনও স্থায়ী প্রতিকার নেই। এর চিকিৎসা, রোগের লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখে কিছু ওষুধ এবং কাউসেলিং-এর মাধ্যমে করা হয়। এক কথায়, এই রোগের চিকিৎসা প্রতিরোধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই, আগাম সতর্কতার যেমন প্রয়োজন, ঠিক তেমনই এই রোগে আক্রান্তদের সুস্থ রাখার জন্য এগিয়ে আসতে হবে প্রতিটি শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে। আন্তরিক যোগাযোগ এবং সামাজিক মেলামেশার মাধ্যমেই সুস্থ রাখতে হবে রোগীকে।
পরিশেষে বলতে চাই, অ্যালজাইমার্স রোগীকে সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। পরিবার, স্বজনদের কাছ থেকে সহযোগিতা পেলে তারা অনেকটাই সেরে উঠে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। রোগীর দেখাশোনা করা, সবসময় তার পাশে থাকা, তার সঙ্গে কথা বলা, তাকে বুঝিয়ে বলা- এসবই অ্যালজাইমার রোগীকে ভালো রাখে। তবে এই রোগে কারো মৃত্যু হয় না তাই এই রোগ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান এবং সচেতনতা প্রয়োজন।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।