ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

শিশুদের হার্টের সমস্যায় আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা 

২০২৪ সেপ্টেম্বর ২১ ১৭:৩৪:৪০
শিশুদের হার্টের সমস্যায় আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সঠিক চিকিৎসা 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


একটি সুস্থ শিশু বয়ে নিয়ে আসে আশার আলো। কিন্তু, সৌভাগ্যের দীপশিখা জন্মগত ত্রুটি নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশু ও তার পরিবারকে নিয়ে যায় হতাশার সমুদ্রে, সেও পরবর্তীতে জাতির জন্য বোঝা হয়ে উঠে। শিশুর জন্মগত হৃদরোগ এমনই একটি রোগ যার শুরু মায়ের গর্ভে। বর্তমানে হার্টের সমস্যা শুধু বড়দের নয়, শিশুদেরও হতে পারে। এই সমস্যা নানা ধরনের হয়। গর্ভাবস্থা থেকেই শিশুকে নিয়ে মা-বাবা বেশ চিন্তিত থাকেন। কিন্তু এই চিন্তা যখন বাস্তবে রূপ নেয় তখন মা-বাবার ঘুম হারাম হয়ে যায়। শিশুদের জন্মগত রোগের মধ্যে হৃদরোগ অন্যতম। যা শুরু মায়ের গর্ভ থেকেই।

গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০০ জন জীবিত শিশুর মধ্যে ৮ জন শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। এই ১০০০ জনের ৮ জনের মধ্যে আবার ২-৩ জনের রোগের লক্ষণ জন্মের প্রথম ৬ মাসের মধ্যেই নানাবিধ উপসর্গ সহ প্রকাশ পায়। বাকিদের পরবর্তীতে জীবনের যেকোনো সময় তা প্রকাশ পেতে পারে। আর আমাদের দেশে গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর ২৫ থেকে ৩০ হাজার শিশু জন্মগত হৃদরোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। যাদের চিকিৎসা করতে হিমশিম খেতে হয়। আবার অনেক গরিব রোগীর পিতা-মাতা চিন্তায় প্রায় পাগলের মতো হয়ে যান।

জন্মগত হৃদরোগ কী?

জন্মগত হৃদরোগ হল হৃদযন্ত্র বা হৃৎপিণ্ডের গঠনগত ত্রুটি যা জন্ম থেকেই বিদ্যমান। এক্ষেত্রে নানা রকমের ত্রুটি থাকতে পারে। যেমন, হৃৎপিণ্ডের দেওয়ালে ছিদ্র থাকতে পারে আবার ভালভ বা কপাটিকার গঠনে সমস্যা থাকতে পারে। অনেকসময় রক্তজালির বিন্যাসে ত্রুটি থাকায় হৃদপেশীতে রক্তপ্রবাহে সমস্যা হয়।

জন্মগত হৃদরোগের প্রকার: জন্মগত হৃদরোগ মূলত দুই ধরনের- সায়ানোটিক ও নন-সায়ানোটিক।

১. সায়ানোটিক কনজেনিটাল হার্ট ডিজ়িজ়: এই সমস্যা গুরুতর ও জন্মের পরেই ধরা পড়ে যায়। এক্ষেত্রে শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ কমে শিশুর ত্বক, ঠৌঁট, নখ, জিভের রঙ নীলচে হয়ে যায়। শিশু খেতে পারে না, এমনকী মায়ের দুধ টানতেও সমস্যা হয়। নানা কারণে এটা হতে পারে। যেমন হৃৎপিণ্ডের বাঁ দিকটা যদি তুলনায় বেশ ছোট হয় (হাইপোপ্লাস্টিক লেফ্ট হার্ট সিনড্রোম) বা মহাধমনীর গঠন অসম্পূর্ণ থাকে (ইন্টেরাপটেড অ্যাওর্টিক আর্চ) তখন হৃৎপিণ্ড থেকে শরীরে পরিশোধিত রক্ত প্রবাহে বাধা হয়। আবার হৃৎপিণ্ডের ডান দিকে কপাটিকা বা ভালভের গঠনে ত্রুটি থাকার কারণে (পালমোনারি অ্যাট্রেসিয়া, ট্রাইকাস্পিড অ্যাট্রেসিয়া) ফুসফুসে রক্ত যাওয়ার পথেও সমস্যা হতে পারে। আবার হৃৎপিণ্ডের গঠনগত ত্রুটির জেরে অক্সিজেন শূন্য ও অক্সিজের পূর্ণ রক্ত মিশে বিপদ হতে পারে। যেমন, হৃৎপিণ্ডে দু’টির বদলে একটি মহাধমনী থাকলে এমন বিপর্যয় হতে পারে। সায়ানোটিক সমস্যাগুলিতে হৃৎপিণ্ডের দ্রুত সার্জারি করতে হয়। সাধারণত জন্মের এক মাসের মধ্যে সার্জারি করা হয়।

২. নন-সায়ানোটিক বা অ্যাসায়ানোটিক কনজেনিটাল হার্ট ডিজ়িজ়: এক্ষেত্রে শিশুদের গায়ের রং পরিবর্তন হয় না বা চট করে ধরা পড়ার মতো কোনও উপসর্গ থাকে না। দেড় থেকে দুই মাস পরে হয়তো দেখা গেল শিশুর ওজন বাড়ছে না, খাওয়া কমে যাচ্ছে, খাওয়ার সময় শিশু ঘেমে যাচ্ছে। তখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে পরীক্ষা করে সমস্যাটি জানা যেতে পারে। অ্যাসায়ানোটিকের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল হৃৎপিণ্ডে ছিদ্র বা ফুটো। অনেকসময় বড়বেলা পর্যন্ত এই সমস্যা চাপা থেকে যায়, ধরা পড়ে না। কখনও আবার ছোটবেলা নিজে থেকেই ছিদ্রটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কোথায় ফুটোটি রয়েছে তার উপরে নির্ভর করে সমস্যাটি কতটা গুরুতর। অবস্থান অনুযায়ী এর প্রকারভেদগুলি হল- আট্রিয়াল সেপটাল ডিফেক্ট (হৃৎপিণ্ডের পেশীর দেওয়াল বা সেপটামে ফুটো), অ্যাট্রিওভেন্ট্রিকুলার ক্যানাল, পেটেন্ট ডাকটাস আর্টেরিওসাস, ভেন্ট্রিকুলার সেপটাল ডিফেক্ট। হার্টে ফুটো ছাড়া অ্যাসায়ানোটিক সমস্যার মধ্যে রয়েছে মহাধমনীর গঠনগত ত্রুটি। মহাধমনী সরু হওয়ার কারণে বা এর ভালভের ত্রুটির জন্য রক্ত প্রবাহে সমস্যা হতে পারে। পালমোনারি আর্টারি, যেটা হৃৎপিণ্ড থেকে ফুসফুসে রক্ত পাঠায়, সেটিও সরু হওয়ার কারণে সমস্যা হতে পারে।

জন্মগত হৃদরোগের লক্ষ্মণ

রোগীর বয়স, হৃদযন্ত্রে কতগুলো জায়গায় সমস্যা, তা কতটা গুরুতর ইত্যাদি অনুযায়ী লক্ষ্মণ ভিন্ন হয়। যেমন, সায়ানোসিসের ক্ষেত্রে ত্বক, জিভ, নখ নীলচে হয়ে যাওয়া প্রধান লক্ষ্মণ। তাই একে বলে ‘ব্লু বেবি সিনড্রোম’। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা নেমে যায় লক্ষ্যণীয় ভাবে। নন-সায়ানোসিসের ক্ষেত্রে অনেক সময় কোনও লক্ষ্মণই বাইরে থেকে নজরে আসে না। তবে, শ্বাসে সমস্যা, দম ফুরিয়ে যাওয়া, ক্লান্তি, দুর্বল নাড়ির গতি, অনেকক্ষণ ধরে ঘুম, ওজন না বাড়া ইত্যাদি লক্ষ্মণ সাধারণত থাকে জন্মগত হৃদরোগীদের। হার্টে ফুটো থাকলে অনেক সময় অস্বাভাবিক রক্ত প্রবাহের জন্য হৃৎপিণ্ড থেকে সাঁই সাঁই শব্দ শোনা যায় (হার্ট মুরমুর) স্টেথোস্কোপে।

শিশুর অভিভাবকের করণীয়

* শিশুর জন্মের পর যত দ্রুত সম্ভব একজন ডাক্তারের মাধ্যমে শিশুকে। পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে- শিশুর বুকে কোন অস্বাভাবিক শব্দ (Murmur) আছে কি না।

* যদি এধরনের কোন সমস্যা বা ত্রুটি ধরা পড়ে তবে একজন শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে ।

* শিশুর টনসিলাইটিস, নেফ্রাইটিস, ভাইরাল রোগ হলে, এই সব রোগকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে শিশু চিকিৎসক ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের তত্বাবধানে চিকিৎসা করানো উচিত।

হৃদযন্ত্রের ছিদ্রের সমস্যার কারণ কী?

হৃদযন্ত্রের চারটি চেম্বার থাকে। দুটো এট্রিয়াম, দুটো ভিট্রিক্যাল। দুটো এট্রিয়ামের মাঝে একে বলা হয় ইন্টারেট্রিয়াল সেপট্রাম। দুটো ভেন্টিকুলারের মাঝে একে বলা হয় ইন্টারভেন্টিকুলার সেপট্রাম। সাধারণত ছিদ্র বলতে যাকে বোঝায় বা এই সেপট্রামের দুটো ছিদ্র হতে পারে। কেননা এরা সম্পূর্ণ পর্দা হিসেবে তৈরি হয় না। এটা বিভিন্ন জায়গা থেকে তৈরি হয়ে পর্দাকে সম্পূর্ণ করে। এটি একটি জন্মগত ত্রুটি। সুতরাং এই সম্পন্ন হওয়ার প্রক্রিয়া যদি বাধাগ্রস্ত হয়, কোনোটাতে ত্রুটি হয়—এই পর্দাটা ছিদ্র হিসেবে জন্মের পর আবির্ভূত হয়। জন্মের পরও হার্টের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হয়। অনেক সময় পর্দা যদি ছোট থাকে, তাহলে জন্মের পরও এই ছিদ্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

জন্মগত হৃদরোগ নির্ণয়

জন্মের আগেই ফেটাল ইকোকার্ডিওগ্রাম করে ভ্রূণের হার্টে কোনও সমস্যা রয়েছে কি না জানা যায়। জন্মের পর সায়ানোটিকের ক্ষেত্রে ‘ব্লু-বেবি’ দের বাহ্যিক পর্যবেক্ষণ ছাড়া পালস্ অক্সিমেট্রিতে অক্সিজেন লেভেল পরিমাপ করে নিশ্চিত হওয়া যায় সমস্যাটি সম্পর্কে।

সাধারণ ভাবে হৃদযন্ত্রের সমস্যা নির্ণয়ে বুকের এক্স-রে, ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম, ইকো কার্ডিওগ্রাম করা হয়। করোনারি অ্যাঞ্জিওগ্রাফি করে বোঝা যায় হৃদযন্ত্র ঠিক ভাবে রক্ত সঞ্চালন করতে পারছে কি না। প্রয়োজনে এমআরআই করে হৃদযন্ত্রের ছবি নেওয়া হয়।

শিশুর হৃদরোগের এলোপ্যাথি চিকিৎসা

** হৃদ্‌রোগ নির্ণয়ের পর ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা শুরু করা হয়। অবস্থা বুঝে পরে ধাপে ধাপে অস্ত্রোপচার লাগতে পারে।

** ওষুধের মাধ্যমে কিছু হৃদরোগ ভাল হয়ে যায়। যেমন- ASD, VSD, PDA, AS, PS, CoA

** বুক কেটে অপারেশন ছাড়া কিছু রোগীর হৃদরোগ ভলো করা সম্ভব।

** বেলুন ডায়ালেশনের মাধ্যমে বড় কোন অস্ত্রোপচার ছাড়া কোয়ার্কটেশন অফ অ্যাওর্টার চিকিৎসা সম্ভব। তবে অনেক ক্ষেত্রে বড় রকমের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়।

** জন্মের পরপরই রোগ নির্ণয় করা গেলে খুব সহজ পদ্ধতিতে সার্জারি ছাড়াই বোতাম বা ডিভাইসের মাধ্যমে ছিদ্র বন্ধ করা সম্ভব। তবে এসব ডিভাইস ও বোতাম বেশ ব্যয়বহুল।
** কিছু ক্ষেত্রে রোগীর অপারেশন করানোর প্রয়োজন হয়।

শিশুর হৃদরোগের হোমিওপ্যাথি

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় হৃদরোগ একেবারে তুচ্ছ, হোমিওপ্যাথি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, রোগ এবং রোগের কারণ থাকে মানুষের স্তরে যাকে জীবনীশক্তি বলা হয়, পক্ষান্তে শরীরে এবং মনে আমরা রোগ নামে যা দেখি, এগুলো আসলে রোগ নয় বরং রোগের ফলাফল মাত্র। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, যেহেতু রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয়, এই জন্য মানুষের শক্তি স্তরে কাজেই রোগ নিরাময়কারী ওষুধকেও হতে হবে শক্তি ওষুধ। অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রাথমিকভাবে যেসব ওষুধ নির্বাচন করে থাকে, ক্র্যাটিগাস, অরম মেটালিকাম, এডোনিস, ভান্যালিস, অর্জুনআর্নিকা, মন্টেনা, গ্লোনয়িন, ভ্যানাডিয়ম, ল্যাকেসিস, ডিজিটালিস, বেলাডোনা, স্পাইজেলিয়া, এনথেলমিয়া, ন্যাজাট্রাইপুডিয়ামস, নাক্স ভুমিকাসহ আরও অনেক ওষুধ লক্ষণের ওপর আসতে পারে। তাই ঔষধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

পরিশেষে বলতে চাই, শিশুর হৃদরোগের হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই রোগগুলির ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে। ওষুধেই এই রোগ ভাল হয়। তবে, এই চিকিৎসা একটু ব্যয়বহুল। তবে সবার আগে যেটা দরকার, তা হল শিশুদের বাবা-মায়েদের আগে হৃদপিণ্ডের সমস্যা সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। লক্ষণগুলি নজরে পড়লে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। আর শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষৎ। শিশুর সুন্দর, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন আমাদের সকলের কাম্য। তাই জন্মের শুরু থেকেই শিশুদের দিকে পিতা-মাতার বিশেষ যত্ন নেয়া অপরিহার্য। তাই এই বিষয়ে সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে। অন্যান্য রোগ নিয়ে যেমন লাগাতার প্রচার হয়, এই রোগ নিয়েও ভীষণ ভাবে প্রচার প্রয়োজন।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।