ঢাকা, শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

‘আমাগের সব নদীতে গিলে খাইছে’

২০২৪ অক্টোবর ১৪ ১৮:২৮:২৬
‘আমাগের সব নদীতে গিলে খাইছে’

শেখ ইমন, ঝিনাইদহ : গড়াইপাড়ে সন্ধ্যা নামছে নিয়ম করেই। নীড়ে ফিরে আসছে পাখিরাও। কিন্তু মানুষ হয়েও নিজেদের ঘরে ফেরার সাহস করতে পারছেন না ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার গড়াই নদীর তীরে বসবাসরত অনেকেই। মানুষগুলো এখন তাকিয়ে থাকছেন গড়াইয়ের দিকে। তাদের এত ভালোবাসার নদী এতদিন ধরে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ,বসতবাড়ী,ছোটবড় সড়ক,স্থাপনা নিজের উদরে নিয়েছে। এখন তা ফের ধেয়ে আসছে তাদের শেষ আশ্রয় বসতবাড়ির দিকে। বছরের পর বছর চলছে এভাবেই। তবুও ভাঙন রোধে কর্তৃপক্ষ কোনো স্থায়ী পদক্ষেপ নেয়নি।

উপজেলার বড়–রিয়া গ্রামের আয়ুব আলী,কয়েক বছর আগেও আবাদি জমি ছিল প্রায় ৪০ বিঘা। কিন্তু তা চোখের সামনে একের পর এক নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবুও কিছুই করতে পারেননি তিনি। শেষ সম্বল আছে বসতবাড়িটুকু। এবারের ভাঙনে সেটিও না থাকার শঙ্কা চোখে-মুখে। কোনদিন খেয়ে তো কোনদিন না খেয়ে দিন যায় তার। বসতবাড়িটি নদীগর্ভে হারালে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কোথায় থাকবেন সে চিন্তায় ঘুম হারাম হয়েছে আয়ুব আলীর।

একই এলাকার আবদুল মালেক মন্ডলের টিনের চৌচালা ঘর ছিল। আরও ছিল ১০ বিঘা চাষের জমি। এগুলো এখন তাঁর কাছে শুধু স্মৃতি। ভিটা আর চাষের জমি সবই চলে গেছে গড়াই নদীর পেটে। এখন থাকেন অন্যের জমিতে। একেকবার ঘর ভেঙেছে আর বাঁচার জন্য নতুন করে ঘর বেঁধেছেন। অসংখবার বসতবাড়ির জায়গা পরিবর্তন করেছেন। শুধু আয়ুব আলী বা আব্দুল মালেক-ই নন, তাদের মতো নদী ভাঙনে নিঃস্ব হয়েছেন উপজেলার হাকিমপুর ও সারুটিয়া ইউনিয়নের অনেকে।

স্থানীয়রা বলছেন, গত ২২ বছর ধরে নদী ভাঙনের শিকার বড়–রিয়া গ্রাম। একসময় এখানে অন্তত ১ হাজার ৪’শ বিঘা ফসলি জমি ছিল। এখন টিকে আছে ২০০ থেকে ২৫০ বিঘা। আগে গ্রামে দু’শ পরিবার ছিল। ভাঙনের কারণে বিভিন্ন সময় প্রায় ৩০টি পরিবার গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। এখনো যারা গ্রামে টিকে আছে, তারা ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে কয়েক দফা ঘর সরিয়েছে।
একই অবস্থা কৃষ্ণনগর গ্রামের। এই গ্রামের প্রায় ৪০টি পরিবারের বসতভিটা ও চাষের জমি বিলীন হয়েছে গড়াই নদীতে। প্রতিবছরই ওই দুটি গ্রাম বেশি ভাঙনের কবলে পড়ছে। পাশের গোসাইডাঙ্গা, কাতলাগাড়ি ও সারুটিয়া গ্রামও ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ,গড়াইয়ের অব্যাহত ভাঙ্গনে ফসলি জমি,বাড়িঘরসহ নানা স্থাপনা নদীগর্ভে বিলিন হলে ২০১২ সালে ভাঙ্গন রোধে কিছুটা অস্থায়ী কাজ করা হয়। কিন্তু সময় গড়ালেও নেয়া হয়নি স্থায়ী ব্যবস্থা। এরপর নামমাত্র কিছু জিও ব্যাগ ও টিউব ব্যাগ ফেলা হলেও তা ভাঙন রোধে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। এরই মধ্যে আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন অনেকেই। বছরের পর বছর এভাবে চললেও ভাঙন রোধে কর্তৃপক্ষের কোনো স্থায়ী পদক্ষেপ নেই। তাই দ্রুত বাঁধ নির্মাণের দাবি নদীপাড়ের বাসিন্দাদের।

বড়–রিয়া গ্রামবাসী বলছেন, ‘গত দুই দশকে তাঁদের গ্রামের আনসার আলী, আজাদ হোসেন, তারেক আলী, আবদুল মান্নান, রবিউল ইসলাম,সামছুল আলমসহ অন্তত ৩০টি পরিবার গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। একইভাবে কৃষ্ণনগর গ্রামের ৪০টি পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। কেউ অন্যত্র জমি কিনে ঘর করেছেন। আবার কেউ সব হারিয়ে যাযাবরের মতো বসবাস করছেন।’

বড়–রিয়া গ্রামের নদীপাড়ের বাসিন্দা মোমেনা খাতুন আঞ্চলিক ভাষায় বলেন, ‘আমাগের সব নদীতি গিলে খাইছে। বাধ না দিলি হেনে(এখানে) আর থাকতি পারবো নানে। ঘর ভাঙ্গে গেলি যাওয়ার জাগা নেই। ঝড়-বৃষ্টি আলি ভয়ে থাকতি হয়। ঘরের চালা উড়ে যায়। সেইতা খুঁজে আনে আবার মেরামত করতি হয়।’

কৃষ্ণনগর গ্রামের আবদুর রহিম মন্ডল বলেন, ‘ভাঙনের কারণে বসতবাড়ির জায়গা পাল্টেছেন ছয়বার। তাঁর আটবিঘা জমি ছিল। পাকা ভিতের ওপর টিনের ঘর ছিল। গরু-ছাগল পালতেন। এখন অন্যের জমিতে কৃষি শ্রমিকের কাজ করেন। সবকিছু চলে গেছে এই গড়াই নদীর পেটে।’

বড়–রিয়া গ্রামের বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘নিজেদের যতটুকু জমি ছিল তা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে নদীর ওপারের(পাংশা) অংশে চলে গেছে। সেইসব জমি ওপারের বাসিন্দারা ভোগ করছে। আমরা একবার গিয়েছিলাম চাষাবাদ করতে, তখন পুলিশ এনে গুলিবর্ষণ করে আমাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।’

আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘নদীগর্ভে সবই চলে গেছে। নতুন করে দূরে খালের উপর অন্যের জায়গায় বাড়ি করেছি। ভাঙ্গন ঠেকাতে সরকারীভাবে এখন পর্যন্ত কিছু জিও ব্যাগ ফেলা ছাড়া স্থায়ী কিছু করেনি।’

ভাঙ্গনের বিষয়ে ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রঞ্জন কুমার দাস বলেন, ‘নদী ভাঙনের বিষয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। প্রকল্প পাস ও ঠিকাদার জটিলতা শেষ হলেই শুরু হবে কাজ।’

(এসআই/এসপি/অক্টোবর ১৪, ২০২৪)