ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

শুধু হিন্দুধর্মে নয়, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মেও দেবী লক্ষ্মীর উল্লেখ পাওয়া যায়

২০২৪ অক্টোবর ১৬ ১৭:০৩:০০
শুধু হিন্দুধর্মে নয়, বৌদ্ধ ও জৈনধর্মেও দেবী লক্ষ্মীর উল্লেখ পাওয়া যায়

গোপাল নাথ বাবুল


শারদীয় দুর্গোৎসব শেষ। ঊমা দেবী কৈলাসে ফিরে গেছেন। স্বভাবত বাঙালি শোকাহত। এরপর কোজাগরী লক্ষ্মীপূজো বাঙালির শোক কাটাতে সহায়ক হয়। এবছর ১৬ অক্টোবর কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। সৌন্দর্য ও সম্পদের দেবী লক্ষ্মী। বাঙালি হিন্দুর ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপূজো এক চিরন্তন উৎসব।

সনাতন শাস্ত্রমতে, অনেক বছর আগে এক রাজা ঘোষণা করেন, লক্ষ্মীপূজোর সময় কোনো শিল্পীর তৈরি মূর্তি যদি বিক্রি না হয়, তবে সে মূর্তি রাজা নিজেই কিনে নিবেন। তখন লক্ষ্মীপূজো হতো অমাবস্যায় এবং সেদিনই দেওয়ালি পালন করা হতো। সেসময় এক শিল্পীর দারিদ্রের প্রতীক বলে পরিচিত অলক্ষ্মীর একটি প্রতিমা অবিক্রিত থাকে। রাজা তাঁর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী সে প্রতিমা নিজে কিনে এনে মন্দিরে লক্ষ্মীর পাশে প্রতিষ্ঠা করেন। এতে মা লক্ষ্মী অসন্তুষ্ট হন এবং রাজ্য ছেড়ে চলে যান। কারণ, যেখানে অলক্ষ্মী থাকেন সেখানে লক্ষ্মী থাকেন না। ফলে রাজার রাজ্যপাটও ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে থাকে।

রাজা তখন অনন্যোপায় হয়ে ধর্মের শরণাপন্ন হন। ধর্ম রাজাকে তার কারণ জানিয়ে আশ্বিনের পূর্ণিমায় কোজাগরী লক্ষ্মীব্রত পালন করার উপদেশ দেন। রাজা তখন ধর্মের কথামত লক্ষ্মীব্রত পালন করে লক্ষ্মীকে ফিরিয়ে আনেন আর অলক্ষ্মীকে রাজ্যের বাইরে ফেলে আসেন। রাজার রাজ্য আবার সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা হয়ে ওঠল। এরপর এ খবর রাজ্যময় প্রচার হলে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজো ঘরে ঘরে শুরু হয়।

রীতি অনুযায়ী, কোজাগরী পূর্ণিমার রাতেই মা লক্ষ্মী পূজো নেন। সন্ধ্যায় পূজো করে সারারাত জেগে থাকাই কোজাগরী-নীতি। “কোজাগর” শব্দটি এসেছে সংস্কৃত “কঃ জাগর” শব্দবন্ধ থেকে। ‘কঃ’ মানে কে, ‘জাগর’ মানে জেগে আছে। তাই ‘কোজাগর’ মানে “কে জেগে আছে”? মানুষের বিশ্বাস, পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় যখন উদ্ভাসিত চরাচর বা পৃথিবী অথবা এই জগৎ, তখনই মা লক্ষ্মী স্বর্গ থেকে পা রাখেন মর্ত্যের মাটিতে। যে ভক্ত রাত জেগে মায়ের আরাধনা করেন, তাঁকে আশীর্বাদ করে যান তিনি। তাকেই ধন সম্পত্তিতে ভরিয়ে দেন মা লক্ষ্মী। সে বিশ্বাসেই বিশেষ করে সনাতনী মহিলারা সারারাত জেগে থাকেন।

লক্ষ্মীপূজোর সময় সরায় আঁকা লক্ষ্মী প্রতিমা আর মা লক্ষ্মীর মৃন্ময়ী মূর্তির সঙ্গে কলাগাছের ছাল দিয়ে তৈরি নৌকা, ছোট কলাগাছ দিয়ে তৈরি একটি বউ, ধানের ছড়া, বেতের কুলায় ভর্তি আরো অনেককিছু নিয়ে আসেন ভক্তরা। এগুলো পূজোর উপকরণ হিসেবে গণ্য হয়।

এ ব্যাপারে লোক সংস্কৃতির গবেষক গুরুসদয় মিউজিয়ামের কিউরেটর বিজন কুমার মন্ডল বলেন, “কোজাগরী লক্ষ্মীপূজোর সময় কলাগাছকে উর্বরতার প্রতীক ও নারী হিসেবে ভাবা হয়। ধান আমাদের প্রধান শস্য, তাই ধানকে শস্য শ্যামলার প্রতীক মনে করা হয়। আর সরাকে পৃথিবী হিসেবে কল্পনা করে তাতে নৌকার মতো বাঁকা একটি রেখার ওপর ছয় রকমের লক্ষ্মীর পট আঁকা হয়। এটা সারা পৃথিবীতে বাণিজ্যের প্রতীক হিসেবে লক্ষ্মীপূজোর সময় ব্যবহার করা হয়, আবার কলাগাছের ছাল দিয়ে তৈরি নৌকাকেও ভাবা হয় বাণিজ্যের প্রতীক”।

সনাতনীদের পাশাপাশি লক্ষ্মীপূজোর দেখা মেলে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মেও। আসলে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ব্রাহ্মণ্যবাদী মতবাদ ও বৈদিক আচার থেকে সরে এসেই জন্ম এই দুই ধর্মের। কিন্তু তারা লক্ষ্মীকে ত্যাগ করেননি। বৌদ্ধ জাতকে দেখা যায়, দুর্ভাগ্যকে দূর করতে লক্ষ্মীর আরাধনা করছেন বিপন্ন নারী-পুরুষরা। দুর্ভাগ্যের দেবী কলঙ্কিনীর কবল থেকে বাঁচতে দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করতে দেখা যায় তাঁদের। এছাড়াও বৌদ্ধতন্ত্রে বসুধারা নাম্মী যে দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায়, তিনিও সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের দেবী। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলিতে জনপ্রিয়তম দেবদেবীর অন্যতম বসুধারা।

‘বসুধারা ধরণি’ গ্রন্থে তার উল্লেখ মেলে। পাশাপাশি বৌদ্ধ স্তুপগুলোতে যক্ষরাজ কুবেরেরও দেখা মেলে। তিনি ধন-সম্পত্তির রক্ষক। সাধারণভাবে লক্ষ্মীকে চঞ্চলা বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ এক স্থানে বেশিদিন থাকেন না তিনি। আবার কুবের স্থায়ী সম্পদের দেবতা। তাই লক্ষ্মীর সঙ্গে কুবেরের সম্পর্ক অতি নিবিড়। দু’জনই বৌদ্ধধর্মে স্থান করে নিয়েছেন।

বৌদ্ধধর্মে লক্ষ্মীকে প্রাচুর্য এবং সৌভাগ্যের দেবী হিসেবে গণ্য করা হয় এবং বৌদ্ধধর্মের প্রাচীনতম টিকে থাকা স্তুপ এবং গুহা মন্দিরগুলোতে তাঁকে উপস্থাপন করা হয়। চীনা বৌদ্ধধর্মে লক্ষ্মীকে গংদেতিয়ান (মেধাবী দেবতা) বা জিক্সিয়াং তিয়ান্ন (শুভ দেবী) হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং তিনি সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধির দেবী। তাঁকে পিশামেন্তিয়ান বা বৈশ্রবণের (চারজন স্বর্গীয় রাজাদের একজন) বোন হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁকে ২৪টি প্রতিরক্ষামূলক দেবতাদের একজন হিসেবেও বিবেচনা করা হয় এবং তাঁর মূর্তি প্রায়শই অন্যান্য দেবতাদের সাথে বেশিরভাগ চীনা বৌদ্ধ মঠের মহাবীর হলে স্থাপিত করা হয়। তাঁর মন্ত্র শ্রী দেবী ধরণী দশটি ছোট মন্ত্রের মধ্যে একটি হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে।

‘ধরণী’ সাধারণত চীনা বৌদ্ধ মন্দিরে সকালের উপসনামূলক সেবার সময় পাঠ করা হয়। তিব্বত, নেপাল এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৌদ্ধ সম্প্রদায়গুলিতে বসুধারা ছোট মূর্তিগত পার্থক্য সহ হিন্দু দেবীর বৈশিষ্ট্য এবং গুণাবলীকে প্রতিফলিত করে। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মে, লক্ষ্মী একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী। তাঁর শান্তিপূর্ণ ও ক্রোধপূর্ণ উভয় রূপ রয়েছে। ক্রোধ রূপটি কামধাত্বিশ্বরী নামে পরিচিত। তিনি তিব্বতি বৌদ্ধধর্ম এবং লাসা তিব্বতের প্রধান নারী রক্ষক। জাপানি বৌদ্ধধর্মে, লক্ষ্মী কিশিজোতেন নামে বিখ্যাত। তিনি সৌভাগ্য এবং সমৃদ্ধির দেবী। চীনের মতো কিশিজোতেনকে বিশামনের বোন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি মানুষের জীবন জীবন রক্ষা করেন, অন্যায় ও মন্দের বিরুদ্ধে লড়াই করেন এবং সৌভাগ্য নিয়ে আসেন। এছাড়া, প্রাচীন চীনা ও জাপানি বৌদ্ধ সাহিত্যে লক্ষ্মী এবং বৈশ্রবণের যেমন উল্লেখ পাওয়া যায়, তেমনই তাঁদের শিকড় হিন্দুধর্মের দেবতাদের মধ্যেও পাওয়া গেছে। লক্ষ্মী দেবীকে ইন্দোনেশিয়ার বালিতে উর্বরতা ও কৃষির দেবী হিসেবে পূজা করা হয়।

লক্ষ্মী জৈনধর্মেরও একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী। কিছু জৈন মন্দির শ্রী লক্ষ্মীকে সম্পদ ও আনন্দের দেবী হিসেবেও চিত্রিত করা হয়েছে। জৈন গ্রন্থ কল্পসূত্রে লক্ষ্মীর প্রশংসা প্রতিফলিত হয়েছে। তীর্থঙ্কর তথা মহাবীরের জন্মের আগে তাঁর মা স্বপ্নে অনেকগুলি শুভ জিনিসের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দেবী শ্রী। এছাড়াও তাঁর স্বপ্নে ভেসে ওঠেছিল পাত্র, রত্নের স্তুপ, নাগ, যক্ষ, ঘোড়া, হাতি, শঙ্খ, সিংহাসন, ইচ্ছেপূরণকারী গাছ।

জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে লক্ষ্মীর জনপ্রিয়তা থেকে ধারণা করা হয়, সম্ভবত বৈদিক যুগেরও আগে থেকেই প্রচলন ছিল লক্ষ্মী দেবীর আরাধনা। যা পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ঋগ্বেদ হয়ে জৈন এবং বৌদ্ধধর্মেও নিজের স্থান করে নিয়েছেন। তাছাড়া, পরবর্তী সময়ে শ্রী ও লক্ষ্মী একই সঙ্গে ব্যবহৃত হলেও কালক্রমে তাঁরা পৃথক দুই দেবী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।