ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত

নড়াইলে মধুমতী নদীর ভাঙ্গনে ১৮টি বাড়িঘর বিলীন

২০২৪ অক্টোবর ২২ ১৫:৩৩:১২
নড়াইলে মধুমতী নদীর ভাঙ্গনে ১৮টি বাড়িঘর বিলীন

রূপক মুখার্জি, নড়াইল : চলতি বর্ষায় বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে হেলেনা বেগমের। প্রায় তিন একর ফসলি জমিও। পাশেই অন্যের জমিতে দোচালা ঘর তুলেছেন বসবাসের জন্য। পাঁচ সদস্যের পরিবার। ছেলে ঢাকায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করে। কৃষিজীবী স্বামী নিজেদের জমিজমা চাষ করে সংসার চালাতেন। মোটামুটি চলছিল। এখন পরিবারটি নিঃস্ব।

যে কোনো সময়ে নদীতে যাবে বসতঘরের অবশিষ্ট উঁচু মাটিটুকুন। নদীর পাড়ে নিজেদের সেই উচুঁ মাটিতে মুখে হাত দিয়ে বসেছিলেন হেলেনা বেগম (৫৫)। বিড়বিড় করছিলেন। চোখে পানি। ভবিষ্যতের জীবনযুদ্ধের বুকফাটা গর্জন যেন নদীর স্রোতধারার গর্জনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। হেলেনা এ প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘ক্যাম্বায় হ্যান্নে বাঁচে থাকব ? ছাওয়ালের পড়া ক্যাম্বায় চলবে ? আমরা যে পথের ফকির হয়ে গেলাম।’

হেলেনা বেগমের বাড়ি নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার শালনগর ইউনিয়নের রামকান্তপুর গ্রামে। চলতি বর্ষায় অন্তত ১৮টি বসতবাড়ি নদীতে গেছে ওই গ্রামের মানুষের। শুধু চলতি বর্ষায়ই নয়, অন্তত দুই দশক ধরে মধুমতী নদীতে বিলীন হয়েছে গ্রামের অর্ধেকের বেশি পরিবারের বসতভিটা, ফসলি জমি। গ্রামের কৃষিজীবী পরিবারগুলো, এক দশক আগেও যাদের সংসারে অভাব তেমন ছিল না। নদীর কাছে হার মেনে এখন তাদের অসহনীয় জীবনযুদ্ধের যন্ত্রণায় দিন কাটছে। কেউ এখন ভ্যানচালক, কেউবা শ্রমজীবী।

গ্রামের কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তি জানালেন, ইউনিয়নের মধ্যে অন্যতম বড় গ্রাম ছিল রামকান্তপুর। নদীতে বসতভিটা ভেঙে গ্রামে পরিবারের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। কারো কারো পরিবার তিন-চারবারও ভাঙনের কবলে পড়েছে, ফসলি জমি গেছে সব। অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় বসতি গড়েছেন। অসচ্ছলতার কারণে যারা শহরে বা অন্যত্র যেতে পারেননি, বারবার বসতভিটা সরিয়ে তারা নদীপাড়েই বসবাস করছেন। হঠাৎ নিঃস্ব হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর জীবনযুদ্ধ যেন একেকটি ইতিহাস। কিন্তু এ ভাঙন প্রতিরোধে নেওয়া হয়নি কোনো পদক্ষেপ।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রামকান্তপুর গ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে মধুমতী নদী। নদীর অপর পাড়ে চর পড়েছে। গ্রামের উজানে চর পড়ে নদী বাঁক নিয়েছে। সেই বাঁকের কারণে স্রোতের ঢেউ সরাসরি গ্রামটিতে আঘাত করছে। সেই আঘাতে গ্রামটি নদীতে বিলীন হচ্ছে। ভাঙন অব্যাহত আছে। গ্রামটিতে গাছপালায় ঠাসা। অনেকে ভাঙনের ভয়ে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে ভাঙন পাড়েই আছেন।

গ্রামের লোকজন জানালেন, এখন যেখানে নদী সেখানেই ছিল তাদের মূল ফসলের মাঠ ও গ্রামের প্রায় অর্ধেক বাড়িঘর। ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে পুরো গ্রামটিই নদীতে বিলীন হবে। গ্রামের লোকজনের তথ্যমতে, চলতি বর্ষায় তৈয়েব শিকদার, মনির শিকদার, হামিদা বেগম, ছেয়ারননেছা, তাহের আলী, তোয়াক্কেল মুছল্লি, মাসুদ মুসল্লি, জালাল সরদার, উজ্জ্বল সরদার, কওছার মোল্লা, শাহাবুদ্দিন মোল্লা, শহীদ মোল্লা, মহিউদ্দিন মোল্লা, সোহেল মোল্লা, দিলবার মোল্লা, শফিউদ্দিন মোল্লা, বিপুল মুসল্লি ও আলমগীর সরদারের বাড়ি নদীতে গেছে।

সবেজান বেগমের (৫০) বাড়ি একদম নদীর পাড়ে। ভাঙনের ভয়ে ঘরের মালামাল সরিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ঘর সরাননি। নিজেদের আর কোনো জমি নেই, তাই ঘর সরিয়ে রাখবেন কোথায় ? এমন প্রশ্ন করে চোখের পানি ফেলে সবেজান বলছিলেন, ‘রাতি ঘোম হয় না। কোনো শব্দ হলি উঠে পড়ি, নদীর কূলি আসি। কন্নে যে ঘরবাড়ি নদীতি যায়।’

১২ একর ফসলি জমি ছিল জাকির হোসেনের (৫০) পরিবারের। সব এখন নদীতে। তিনবার নদীতে গেছে বসতবাড়ি। তিনি জানালেন, এক সময় তাদের বাইচের নৌকা ছিল। সংসারের জৌলুস ছিল। আনন্দ উল্লাসে কাটত পরিবারের সবার। নদীতে সব হারিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন কোনোরকম বেঁচে থাকার সন্ধানে।

তৈয়েব শিকদারের (৫৮) বসতবাড়ি ছিল ৪৫ শতাংশ জমির ওপর। বাড়িতে নারকেল, আম, কাঠালসহ অন্যান্য ফলফলালির গাছে ভরপুর ছিল। এতেই সংসারের খরচ চলে যেত। চলতি বর্ষায় বসতবাড়ি ও গাছপালা সব নদীতে গেছে। ফসলি জমি কয়েক বছর আগেই বিলীন হয়েছে। এখন তার কোনো জায়গাজমি নেই। অন্যের জমি ইজারা নিয়ে বসবাসের দোচলা ঘর তুলেছেন। এখন ভ্যান চালিয়ে সংসার চালানোর চেষ্টা করছেন।

মধুমতীর গ্রাসে অসহনীয় জীবনযুদ্ধের যন্ত্রণায় যখন গ্রামের ওই পরিবারগুলো। অন্য পরিবারগুলোর অবস্থা যখন একই পরিণতির দিকে। তখন ভাঙনরোধে নেই কোনো উদ্যোগ, নেই কোনো আশার কথা। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) নড়াইল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী উজ্জ্বল কুমার সেন জানান, গত বছর থেকেই পাউবোর কাজ সীমিত হয়ে গেছে। বরাদ্দ নেই। তাই ভাঙনরোধের কোনো পরিকল্পনা বা প্রকল্প আপাতত নেওয়া হচ্ছে না।

(আরএম/এএস/অক্টোবর ২২, ২০২৪)