প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
ডুব দেরে মন কালী বলে
২০২৪ অক্টোবর ২৩ ১৭:০৫:২২গোপাল নাথ বাবুল
কালী পূজো। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে এ উৎসব উপলক্ষে প্রবল উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যায়। কারণ, দুর্গাপূজোর পর হিন্দু বাঙালিদের কাছে অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব হলো কালীপূজো বা শ্যামাপূজো। কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে অনুষ্ঠিত এ পূজোকে দীপান্বিতা কালীপূজোও বলা হয়। এ পূজো আলো ও আতসবাজির উৎসব। পুরাণ মতে, দেবী কালীর একাধিক রূপের বর্ণনা পাওয়া যায়। যেমন, দক্ষিণাকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গ্রহকালী, চামুন্ডা, ছিন্নমস্তা। এছাড়াও বিভিন্ন মন্দিরে আনন্দময়ী, ভবতারিণী ইত্যাদি নামেও মা কালীর পূজো করতে দেখা যায়।
পুরাণ মতে, সংহারের অধিপতি দেবাদিদেব মহাদেবের আর এক নাম হলো কাল এবং কাল-এর স্ত্রীলিঙ্গ সংহারের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কালী। মা কালীই হলেন মহামায়ার দশ মহাবিদ্যা রূপের প্রথম রূপ। ভগবতীর গায়ের রঙ ঘন কালো বলেই তাঁকে ‘কালী’ বলে সম্বোধন করা হয়। প্রাচীনকাল থেকেই এ বাংলায় শাক্ত সাধনার প্রসার ঘটেছিলো। শক্তির উপাসনার আরাধ্য আদ্যশক্তি মহামায়ার অন্যতম রূপ দেবী কালী শাক্ত ধর্মে এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করেন। শক্তির উপাসনার সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে বহন করে বাংলার বুকে আজও দেবী কালীর আরাধনা করা হয়। কাল অর্থ অনন্ত সময়। জগতের উৎপত্তি, স্থিতি, মহাপ্রলয়ের পিছনে রয়েছে কালশক্তি। শাস্ত্রে উল্লেখ আছে, কাল সর্বজীবকে গ্রাস করে। সেই কাল-কে যিনি গ্রাস করেন, তিনিই কালী। এ কাল-এর অর্থে সংহার ও মৃত্যুর ভাবনাও লুকিয়ে আছে। তাই মা কালী যেমন সময়ের জন্মদাত্রী ও পালনকত্রী তেমনি তিনি প্রলয়কারিণী নিয়ন্ত্রক। দেবীর নামে কাল শব্দের সঙ্গে যুক্ত ঈ-কার। সনাতন ধর্মে ঈশ্বরী বা সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলদ্ধি করতে ঈ-কারের সৃষ্টি এবং শব্দোচ্চারণকে উল্লেখ করা হয়েছে। ক্রোধাম্বিতা, রণরঙ্গিণী, করালবদনী, মহানিশার প্রতীক দেবী কালী সংহারক বেশে প্রলয়বাদন জাগিয়ে তোলেন আর প্রলয়ের শেষে অসীম শান্তিতে ভরে ওঠে ভক্তের মন।
কালীপূজো দু’ধরণের হয়। সাধারণ পদ্ধতি ও তন্ত্র পদ্ধতিতে পূজো। যে কেউ সাধারণ পদ্ধতিতে কালীপূজো করতে পারেন; কিন্তু তন্ত্র পদ্ধতিতে গুরুর তত্ত্বাবধান ছাড়া করা যায় না। মধ্যরাতে কালীপূজো করা হয়। কালীপূজোয় লাল ও কালো বস্তুও বিশেষ মাহাত্ম্য রয়েছে। ২৪ অক্টোবর সোমবার অমাবশ্যা তিথিতে হবে কালীপূজো। এর পূর্বদিন হবে ভূত চতুর্দশী। ওইদিন চৌদ্দ শাক খেয়ে হিন্দু বাঙালিরা তাদের ঘরে ঘরে ১৪টি প্রদীপ জ্বেলে ‘শুভ সময়’কে আমন্ত্রণ জানান। ভূত চতুর্দশীকে নরক চতুর্দশীও বলা হয়। পুরাণ অনুযায়ী মনে করা হয়, এদিন স্বর্গ ও নরকের দ্বার কিছুক্ষণের জন্য উম্মোচিত হয়। একই সঙ্গে বিদেহী আত্মা এবং স্বর্গত ব্যক্তিরা নেমে আসেন পৃথিবীতে।
পুরাণ মতে, পুরাকালে শুম্ভ এবং নিশুম্ভ নামক দুই দৈত্য সারা পৃথিবী জুড়ে তাদের ভয়ঙ্কর ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। দেবতারাও এ দুই দৈত্যের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেবলোক ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র দেবলোক ফিরে পেতে আদ্যশক্তি মা মহামায়ার তপস্যা শুরু করেন। তাতে সন্তুষ্ট দেবী আবির্ভূত হয়ে দেবতাদের অভয় দান করে অসুর নিধনে তাঁর রুদ্র রূপ ধারণ করেন। কিন্তু অসুরদের সম্মিলিতভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে দেখে মহামায়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন এবং তাঁর তৃতীয় নেত্র থেকে জন্ম নেন এক ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি। এ ভয়ঙ্কর রুদ্রমূর্তি হলেন মা কালী। অবতীর্ণ হয়ে দেবী কালী একে একে সকল অসুরদের বিনাশ করতে শুরু করেন। অসুরদের হত্যা করে মা তাদের নরমুন্ড হাতে ধরেন, নরমুন্ডের মালা পরিধান করেন এবং খড়গ দ্বারা অসুরদের হাত কেটে তিনি তাঁর কোমরবন্ধ বানিয়ে নেন। এ অবস্থায় অসুররা দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। তারা বুঝে ওঠতে পারছিলেন না, কীভাবে এ ভয়ঙ্কর দেবীর মোকাবিলা করবেন।
তখন শুম্ভ-নিশুম্ভ তাদের সেনাপতি প্রজাপতি ব্রহ্মার অভিনব বরপ্রাপ্ত রক্তবীজকে দেবীর মুখোমুখি করেন। বরটি ছিল কারও অস্ত্রাঘাত দ্বারা রক্তবীজের শরীর থেকে যদি একফোটা রক্ত মাটিতে পড়ে, তাহলে সে রক্তের প্রতিটি বিন্দুকণা থেকে পুনরায় এক একটি রক্তবীজের জন্ম হবে অর্থাৎ এ চালাক অসুর একপ্রকার অমরত্ব বর লাভ করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছ থেকে। এরূপ বরশালী রক্তবীজকে দেখামাত্রই মা রুদ্রমূর্তি ধারণ করে তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হন। মায়ের খড়গের আঘাতে রক্তবীজের শরীর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেখলেন, তার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া প্রতিটি রক্তকণা থেকে পুনরায় জন্ম নিচ্ছে লক্ষ লক্ষ রক্তবীজ। তখন মা বুঝতে পারলেন, ব্রহ্মা কর্তৃক তার বর পাওয়ার বিষয়টি। এবার দেবী কালী রক্তবীজদের হত্যা করার পর তাদের রক্ত জিহ্বা দিয়ে গ্রাস করতে থাকেন। এভাবে তিনি রক্তবীজ অসুরকে হত্যা করে তার রক্তশূণ্য দেহ ছুঁড়ে ফেলে দেন। এরপরই শুরু হয় মায়ের তান্ডবনৃত্য। সেই তান্ডব নৃত্যে স্বর্গ-মত্য-পাতালে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে। দেবতারা বুঝতে পারেন, সারা পৃথিবীজুড়ে এক প্রলয়ের সৃষ্টি হতে চলেছে, যা তাদের পক্ষে রোধ করা অসম্ভব।
তখন তারা ছুটে যান দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে। মহাদেব সকলের অনুরোধে মা কালীর রুদ্রমূর্তির তান্ডবনৃত্য বন্ধ করতে মায়ের সামনে শুয়ে পড়েন। তান্ডবনৃত্য করতে করতে মা কালী এক সময় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেখেন তিনি তাঁর স্বামীর বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তা দেখে তিনি জিভ কাটেন। পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে সেই সময়কার সেই রূপ পূজিত হয়ে আসছে আজও। মা কালীর এ রুদ্রমূর্তিই আমরা প্রত্যক্ষ করি তাঁর সকল রূপে, বিভিন্ন চিত্রকলায় এবং বিভিন্ন মূর্তিতে। এভাবেই মায়ের চিরাচরিত সম্মুখে জিহ্বা বের করা মূর্তি প্রসিদ্ধ লাভ করে পৃথিবীলোকে।
সুতরাং দেবী কালী সর্বোচ্চ শক্তির প্রকাশ। তাঁর ভয়ঙ্কর রূপের মধ্যেও সেই প্রেমময় এবং যত্নশীল মাকে দেখা যায়। তিনি তাঁর ভক্তদের চারপাশে থাকা সমস্ত নেতিবাচক শক্তিগুলোকে ধ্বংস করেন, ভক্তদের মন থেকে সমস্ত অশুভ, অশুচিতা, নেতিবাচকতা, অন্ধকার দুর করেন এবং সমস্ত মন্দ কাজ থেকে মুক্ত রাখেন। রাহু, কেতু ও শনির শান্তির জন্য কালীপূজো বিশেষ কার্যকরী বলে বাঙালি সনাতনীরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাছাড়া কালীপূজো এদেশের শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। সমাজজীবনে বাঙালির দৃষ্টিতে নারী মহামায়ার প্রতীক। দেবী মহামায়া তথা কালী সর্বদাই অসুর বিনাশ করে সৎ মানুষকে রক্ষা করেন এবং মন্দকে ধ্বংস করেন। আমাদের মঙ্গল এবং কল্যাণের জন্যই মা কালী উগ্র ও ভয়ঙ্করী। সুতরাং তাঁর শ্রীচরণে প্রার্থনা জানাই এবং সাধক রামপ্রসাদের সুরে বলি, ‘ডুব দেরে মন কালী বলে, হৃদি রত্নাকরের অগাধ জলে।’
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।