ঢাকা, শুক্রবার, ৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

ভূত চতুর্দশীতে ১৪ শাক খাওয়ার উপকারিতা

২০২৪ অক্টোবর ২৬ ১৭:৪৩:৫৩
ভূত চতুর্দশীতে ১৪ শাক খাওয়ার উপকারিতা

গোপাল নাথ বাবুল


কালীপূজা বা দীপাবলি কিংবা দেওয়ালি হলো অন্যতম এক হিন্দু উৎসব, যা আগামী ৩১ তারিখ অনুষ্ঠিত হবে। সারাবিশ্বে কম-বেশি এ আলোর উৎসব পালন করা হয়। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদর্শীর দিন ধনতেরাস অথবা ধনত্রয়োদর্শী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উৎসবের সূচনা হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা পক্ষে, দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ উৎসব শেষ হয়। নবরাত্রি উৎসব অথবা বাঙালিদের দুর্গোৎসব শেষ হওয়ার ১৮ দিন পর দীপাবলি শুরু হয়। গ্লেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে, মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বরের মধ্যে দীপাবলি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

কালীপূজার ঠিক আগের দিনকে বলা হয় ভূত চতুর্দশী। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ু ও কর্ণাটকে ভূত চতুর্দশীকে ‘নরক চতুর্দশী’ বলা হয়। পুরাণে বর্ণিত আছে, এদিন শ্রীকৃষ্ণ ও সত্যভামা দানব নরকাসুরকে বধ করেছিলেন। পুরাণ মতে, ভূত চতুর্দশীর দিন দেবী কালী ধীরে ধীরে জাগ্রত হতে শুরু করেন। সেই প্রেক্ষিতে অশুভ শক্তির বিনাশের পূর্বক্ষণই এ ভূত চতুর্দশী। কথিত আছে, চামুন্ডারূপী ১৪ ভূত দিয়ে অশুভ শক্তিকে ভক্তের বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্যে মা কালী মর্ত্যে আসেন। এদিন দুপুরে ১৪ শাক খাওয়া আর পূর্বপুরুষদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সন্ধ্যায় ১৪ প্রদীপ জ্বালানো এবং দরজায় ১৪ ফোঁটা দেওয়া বাঙালি হিন্দুর বহু দিনের রেওয়াজ। লোকবিশ্বাস, এদিন তাঁদের আত্মারা মর্ত্যে নেমে আসেন। আধুনিক যুগে ১৪ শাক খাওয়াকে অনেকে কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দিলেও এ প্রথা চালু হওয়ার পিছনে একদিকে যেমন রয়েছে একাধিক পৌরাণিক বা ধর্মীয় কারণ তেমনি রয়েছে শারীরবৃত্তীয় বিষয়ও। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রকৃতপক্ষে, নিয়মনীতির আড়ালে পুষ্টিগুণের অভ্যাসই আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিয়েছেন আমাদের পূর্বপুরুষরা।

ভূত চতুর্দশীকে ‘যম চতুর্দশী’ও বলা হয়। কারণ এদিন ১৪ জন যমের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়। এ ১৪ জন যমরাজ হলেন, ধর্মরাজ, মৃত্যু, অন্তক, বৈবস্বত, কাল, সর্বভূতক্ষয়, যম, উড়ুম্বর, দধ্ন, নীন, পরমেষ্ঠী, বৃকোদর, চিত্র ও চিত্রগুপ্ত।

সনাতন ধর্মের প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, যেহেতু মৃত্যুর পর মানুষের দেহ ‘পঞ্চভূত’ অর্থাৎ প্রকৃতিতে বিলীন হযে যায় সেহেতু এ ১৪ পুরুষ, জল, মাটি, বাতাস ও অগ্নির সঙ্গে মিশে রয়েছেন। আর এজন্যেই মূলত মাটির মধ্যে জন্মানো ১৪টি বিশেষ শাক খেয়ে ১৪ পুরুষদের উৎসর্গ করা হয় ভূত চতুর্দশীর দিনটি। আবার অনেকে মনে করেন, ১৪ ভূবনের অধীশ্বরী দেবীর উদ্দেশ্যে ১৪ শাক খাওয়া এবং ১৪ প্রদীপ জ্বালানো হয়।

পুরাণ মতে, ভূত চতুর্দশীতে ১৪ শাক খাওয়ার রীতি প্রচলন করেন ঋকবেদের বাস্কল বা শাকদ্বীপি ব্রাহ্মণ’রা। যদিও এ আচার পূর্ব ভারতে এবং দুই বাংলায় সমধিক প্রচলিত। শাক শব্দটি কেবলমাত্র কোনও গাছের বা লতাপাতাকে বোঝায় না। বৃহত্তর অর্থে শাক বলতে পাতা, ফুল, ফল, নাল, কন্দ, ছত্রাক সবই বোঝায়। তাই ওলের মত কন্দ ভাতের সঙ্গে খেলেও শাকই খাওয়া হয়। একইভাবে সিদ্ধ কাঁচকলা, সিদ্ধ পটল, বকফুল ভাজা, মানকচু সিদ্ধ, লাউ-কুমড়োর ডাঁটা খেলেও শাক খাওয়ারই নামান্তর।

তবে কালীপূজার সঙ্গে ১৪ শাকের সম্পর্ক নিয়ে কোনও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকলেও সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এ প্রথার সঙ্গে শস্যদায়িনী দেবী ভাবনার যোগাযোগ রয়েছে। ভেষজবিজ্ঞানীদের মতে, ঋতু পরিবর্তনের সময়ে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এ শাকগুলি খাওয়া হত।

বাংলার ঋতুর প্রকোপ ভারতীয় উপমহাদেশের অন্য স্থান থেকে বেশি হওয়ায় ‘আশ্বিন ও কার্তিক’ মাস দু’টিকে যমদংস্টা কাল বলা হত। তখনকার দিনে বাংলার নব্য-স্মৃতিশাস্ত্রকার রঘুনন্দন ভট্টাচার্য (১৬ শতাব্দী) তার অষ্টবিংশতি তত্ত্বের অন্যতম গ্রন্থ “কৃত্যতত্ত্বে” উল্লেখ করেছেন ‘নির্ণয়া-মৃতের’ অভিমত অনুসরণ করে-

‘ওলং কেমুকবাস্তুকং,সার্ষপং নিম্বং জয়াং। শালিঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শেলুকং গুড়ুচীন্তথা। ভণ্টাকীং সুনিষন্নকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ, প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্ত্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ’।

আয়ুর্বেদ মতে, প্রাচীন বাংলায় ১৪ শাকগুলি ছিল পালং শাক, লাল শাক, সুষণি শাক, পাট শাক, ধনে শাক, পুঁই শাক, কুমড়ো শাক গিমে শাক, মুলো শাক, কলমি শাক, সরষে শাক, নোটে শাক, মেথি শাক, লাউ শাক অথবা হিঞ্চে শাক। এ ১৪ রকম শাক খেলে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। তাছাড়া, সব লোকাচারের পিছনেই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকে। শরতের শেষ এবং হেমন্তের শুরুতে আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এ সময় নানা রকম রোগের উপদ্রব বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই ভেজষ গুণ সমৃদ্ধ এসব শাক খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। আবার এ সময় পোকামাকড়ের উপদ্রব বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাই পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতেই বাজি পোড়ানো হয় এবং প্রদীপ জ্বালানো হয়। কারণ, ধোঁয়ায় পোকামাকড় বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারে না।

আয়ুর্বেদ মতে, এ ১৪ শাকে যথেষ্ট পরিমাণ ভেষজ গুণ রয়েছে। যেমন-সর্ষে তেলের মত সর্ষে শাকেও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন রয়েছে। নিয়মিত খেলে রক্তে উপকারী কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়ে এবং দেহে ভিটামিন ডি তৈরি করতে সাহায্য করে এবং চোখ ও যকৃত যত্নে রাখে। পালং শাক কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে। এ শাকে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ, বি, সি, ই এবং আয়রন। কলমি শাক পেট পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং শরীরে জলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে। পুঁই শাকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি এবং প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়াম, খনিজ লোহা, ম্যাগনেসিয়াম ও জিংক রয়েছে। যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। লাল শাকে রয়েছে অ্যামিনো, ফসফরাস, আয়রন, ভিটামিন ই, পটাসিয়াম, ভিটামিন সি ও ম্যাগনেসিয়াম। এসব উপাদান ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।

এ শাক রক্তে হিমোগ্লোবিন বাড়ায়। যাদের অ্যানিমিয়া রয়েছে তাদের জন্য খুবই উপকারি এ শাক। গিমে শাক জন্ডিস, জ্বর, লিভারের অসুখ, সর্দি-কফে খুবই উপকারি এবং মুখের রুচি বাড়ে। পাট শাক কোষ্ঠকাঠিন্য, পেটের রোগ, সর্দি, কাশি প্রভৃতি সমস্যায় খুবই উপকারি। মুলো শাক হজমশক্তি বাড়ায়, বাতের ব্যাথা সারে। বেতো শাক কৃমিনাশক, পাইলসের যন্ত্রণার উপশম, কিডনি সমস্যার সমাধান, মুখের রুচি ও হজমশক্তি বাড়ায় এবং লিভার সুস্থ রাখে। লাউ বা হিঞ্চে অথবা হিলঞ্চ শাক পিত্তনাশক, রক্তশোধক, ক্ষুধাবর্ধক, হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, শরীর ঠান্ডা রাখে, রক্ত পরিষ্কার রাখে এবং অ্যানিমিয়া রোগ সারাতে সাহায্য করে। শুষণি শাক স্মৃতিবর্ধক হিসেবে পরিচিত।

১৪ শাক রান্নার কোনও নির্দিষ্ট প্রস্তুত প্রণালী নেই। একেক জায়গায় একেক রকম ভাবে এ শাক রান্না করা হয়। কোথাও কালজিরে-কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, কোথাও রসুন-শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে আবার কোথাও শুধু পাঁচফোড়ন দিযেও ১৪ শাক রান্না বা ভাজা খাওয়া হয়।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।