প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
পর্ব : তিন
বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছর শাসনামলের ইতিহাস
২০২৪ নভেম্বর ১৭ ১৯:০৪:১৩আবীর আহাদ
বঙ্গবন্ধু এভাবে একটি বৈপ্লবিক কর্মসূচি নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানান জটিল সমস্যা সমাধানে আত্মনিয়োগ করলেন। কিন্তু একই পাশাপাশি অল্প কিছুদিনের মধ্যে পাকিস্তানি ধ্যানধারণার রাজনীতিক, সামরিক-বেসামরিক আমলা, ধনিক-বণিক, পুঁজিবাদের অন্ধ সমর্থক-দালাল, ইসলামের মোড়কে দেশের একটি বিরাটসংখ্যক মোল্লা-মৌলভী, প্রকাশ্য বিরোধী দল জাসদ, চৈনিকপন্থী স্বাধীনতাবিরোধী কতিপয় তথাকথিত সাম্যবাদী রাজনৈতিক দল এবং ক্ষমতার সাথে জড়িত একটি প্রতিক্রিয়াশীল-প্রতিবিপ্লবী অপশক্তির পশ্চাতে মার্কিন চীন পাকিস্তান ও সৌদি সাম্রাজ্যবাদ মদদ যুগিয়ে নানান ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক আর্থসামাজিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একটি নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
ঐসব সাম্রাজ্যবাদ ও পরাজিত পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের এদেশীয় সেবাদাস ও দেশীয় পুঁজিবাদী চেতনার মুক্ত অর্থনীতির ধারক-বাহক পেটি বুর্জোয়া অপশক্তি একযোগে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক বৈপ্লবিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তৎপরতা হয়ে ওঠে। এই অপশক্তি অর্থ দিয়ে প্রশাসনের অধিকাংশ আমলা ও সামরিক বাহিনীর পাকিস্তান-প্রত্যাগত অমুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ও ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত উচ্চাভিলাষি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কিনে ফেলতে থাকে। তারা তাদের সমর্থক ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর মাধ্যমে বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে জনগণের মনে অসন্তোষ তৈরি করতে থাকে। অর্থের বিনিময়ে টাউট মোল্লা-মাওলানা/রাজাকার-আলবদর ধর্মীয় চক্রকে হাত করে তাদের দিয়ে নানান ধর্মীয় জলসা-সেমিনার, ওয়াজ-মাহফিল ইত্যাদি অনুষ্ঠানাদির নামে সমাজতন্ত্র ধর্মনিরপক্ষেতা গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী দর্শন ও চেতনার বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু করে এবং এসব দর্শনকে ইসলামবিরোধী কুফরি মতবাদ বলে বিষোদ্গার করতে থাকে। মুজিববিরোধী রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী ও ঐসব ধর্মীয় মোল্লাচক্র বঙ্গবন্ধু, তাঁর আত্মীয়-পরিজন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বলিষ্ঠ নেতা-কর্মীদের নামে নানান অপবাদ দিতে থাকে। এমনকি তারা দেশের প্রাণশক্তি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র ও যুবকদের দুষ্কৃতিকারী, হাইজ্যাকার, নারীহরণকারী, ডাকাত ইত্যাকার অপবাদে ভূষিত করতে থাকে।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট স্বাধীনতাবিরোধী এ-সব গণবিরোধী অপশক্তি ব্যাঙ্ক ডাকাতি, পাটের গুদামে অগ্নিসংযোগ, কলকারখানায় অন্তর্ঘাত, রেললাইন তুলে ফেলে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি, খাদ্যগুদাম থেকে খাদ্যশস্য লুটপাটসহ নানান অপকর্ম করে বঙ্গবন্ধু সরকারকে হেয়প্রতিপন্ন করার কারসাজি করে তারাই আবার এসবের জন্য মুজিববাদীদের ওপর দোষারোপ করতে থাকে। জাসদের গণকন্ঠ, মাওলানা ভাসানী হককথা, এমনকি প্রভাবশালী পত্রিকা ইত্তেফাকসহ এনায়েতউল্লাহ খানের ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে ও অন্যান্য কতিপয় পত্রিকা এ-জাতীয় অপপ্রচারের লিপ্ত হয়। মুজিববিরোধী হোঁচট খাওয়া রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী-লেখকদের মধ্যে আবুল মনসুর আহমদ, বদরুদ্দিন উমর, আহমদ শরীফ, আখতারুল আলমসহ নব্য বামপন্থী লেখক-সাহিত্যিক-সাংবাদিক-কবিরাও এ-অপপ্রচারের আদাজল খেয়ে শরীক হন। এ-অবস্থার মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং হেনরি কিসিঞ্জার সাহেব, যিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানের পরাজয়কে যিনি তাঁর ব্যক্তিগত পরাজয় বলে একদা খেদোক্তি করেছিলেন------সেই কিসিঞ্জার সাহেব ওয়াশিংটনে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানান বোলচাল করে যাচ্ছিলেন। তাঁরই এদেশীয় সেবাদাসদের দ্বারা সৃষ্ট বাংলাদেশের আর্থিক দুর্গতির সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে উপহাস করেন। কিসিঞ্জারের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে এদেশীয় অপশক্তি ঐ উপহাসকে নানান রঙচঙ মেখে বক্তৃতামঞ্চ আর খবরের কাগজের খোরাক হিশেবে ব্যবহার করতে থাকে।
এ-প্রসঙ্গে বাংলাদেশের ডিগবাজি খাওয়া রাজনীতিক, উচ্চাভিলাষী ধনিক-বণিক ও বিশেষচক্রের দ্বারা সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের শ্রেণীচরিত্র ও কার্যকলাপের ওপর যৎকিঞ্চিত আলোকপাতের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি।
উনিশশো উনপঞ্চাশ সালে শাসক মুসলিম লীগ সরকারের গণবিরোধী কার্যকলাপ, বিশেষ করে পাকিস্তানি পাঞ্জাবি শোষক-প্রতারকদের বাঙালিবিরোধী শাসন-শোষণের প্রতিবাদে একই দলের একটি প্রগতিশীল অংশ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের পতাকাতলে জড়ো হয়। তরুণ উদীয়মান নেতা শেখ মুজিবুর ছিলেন এই দলে যুগ্ম সম্পাদক। মূলত: তিনি ছিলেন সাধারণ কর্মীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। তৎকালীন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সিংহভাগেরই আগমন ঘটেছিল ধনিক বণিক শিল্পপতি ও আধাসামন্তবাদী পরিবার থেকে। এদিক থেকে সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা ফজলুল হক, মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব ব্যতিক্রম ছিলেন। এঁদের আগমন ঘটেছিল পেশাজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে।
মুসলিম লীগ সরকার তথা পাকিস্তানের কায়েমী ধনিক বণিক শাসক ও শোষকশ্রেণীর স্বৈরাচারী শাসন-শোষণ, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সর্বোপরি পূর্ববাংলার প্রতি বৈষম্যের কারণে পূর্ববাংলার ঐসব নেতা-কর্মী মাওলানা ভাসানীর দলে এসে ভিড়তে থাকে। ক্ষমতাসীন শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর সাথে প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে পারছিল না এমন উঠতি ধনিকরা ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্নে বিভোর হয়ে তাই পূর্ববাংলার উঠতিদের একটি বিরাট অংশ এই নবীন দলের সাথে একাত্ম হতে থাকে । ৫৫/৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের নেতৃত্বে দলকে অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও ব্যাপক মানুষের অংশগ্রহণের লক্ষ্যে নতুন উদ্যমে আওয়ামী লীগ পুনর্গঠিত হয়। এ-সময় মাওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামক ভিন্ন দল গঠন করেন ।
কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দী ও পূর্ববাংলায় শেখ মুজিবের প্রখর সাংগঠনিক প্রজ্ঞার ফলশ্রুতিতে অচিরেই পূর্ববাংলার জনগণ আওয়ামী লীগের মধ্যেই তাদের স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজে পায়। আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় মুগ্ধ হয়ে তাই এদেশের উঠতি ধনিকশ্রেণীর একটি বিরাট অংশ জড়ো হতে থাকে এ-দলের পতাকাতলে।
তবে এ-কথাও অনস্বীকার্য যে, আওয়ামী লীগে আগত উঠতি ধনিকশ্রেণী বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনায় উজ্জীবিত ছিলেন এবং বাঙালি জাতির প্রতিটি আন্দোলনে এরাও পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে এদের শ্রেণীচরিত্র ও উদ্দশ্যে-লক্ষ্যের বিষয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ণভাবে সজাগ ছিলেন। তিনি হৃদয় দিয়ে বুঝতে পারছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদীচক্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্র, শিল্প ব্যাঙ্ক ব্যবসা বাণিজ্য ও সামরিক বাহিনীতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। সর্বোপরি তারা বাঙালি বিদ্বষী। এই শক্তিশালী ধূরন্ধর শাসক-শোষকগোষ্ঠীর কবল থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি। ফলে দলের মধ্যে কারা ধনিক-বণিক, শোষিত-সর্বহারা-----এ-জাতীয় শ্রেণীসত্তা বিচার করে চলা তৎকালীন পাকিস্তানের রাজনীতিতে অবকাশ ছিল না। বাঙালি জাতির সর্বশ্রেণীস্তরের সমন্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার আলোকে বিভিন্নভাবে গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাদেশীয় চেতনাবোধ জাগ্রত ও পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে মুক্তকরণের সংগ্রামমুখর কার্যক্রমে বাঙালির মধ্যে শোষক-শোষিতের প্রশ্নও ছিল তাই গৌণ।
বঙ্গবন্ধু মূলত: সর্বস্তরের বাঙালিদের জাতীয় ঐক্যের বেদীমূলে বলিয়ান হয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত করে স্বাধিকার থেকে জাতীয় স্বাধীনতা অর্জন করে মুক্ত বাংলার মাটিতে বসে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক শোষণহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক চিন্তাধারা গ্রহণ করেছিলেন। এ-জন্য স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে জাতির মধ্যে কোনোরকম বিভেদ-বিভক্তি সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। এ-ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু মহামতি লেনিনের পথ অনুসরণ করেছিলেন। লেনিন বলেছেন, বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে সমন্বয়সাধন ও পুঁজিবাদী সমাজের ইট-কাঠ দিয়ে জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে গড়তে হবে নতুন সমাজ, নতুন দিগন্ত। চলবে---
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষক