প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
কেন্দ্রীয় ব্যাংক শক্তিশালী না করে ব্যাংক খাত সংস্কার সম্ভব নয়
২০২৪ নভেম্বর ২৯ ১৭:১৯:১২চৌধুরী আবদুল হান্নান
“একজন বিশেষজ্ঞ ভালো ভালো আইডিয়া দিতে পারেন বটে, তা কার্যকর করার সক্ষমতা রাখেন না।” নিয়ন্ত্রক সংস্থা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সকল রোগে আক্রান্ত, দুর্বল হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে, ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো ক্ষমতা তার নেই। এক কথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্পূর্ণ অকার্যরকর হওয়ার পথে।
অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বলতা কাটাতে এবং শক্তি সঞ্চয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। ২ মাসেরও বেশি সময় পূর্বে ৬ সদস্যের একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে, তারা শ্বেতপত্র প্রকাশের মাধ্যমে ব্যাংকের প্রকৃত পরিস্থিতি জানাবেন। আশার কথা, কমিটির সার্বিক সমন্বয় করবেন গভর্নর নিজে।
কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করণে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার জন্য আলাদা একটি টাস্ক ফোর্স গঠনের কথা রয়েছে, এ উদ্যোগ ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের প্রাথমিক পদক্ষেপ বলা যায়।
অর্থ উপদেষ্টা সম্প্রতি বলেছেন, “আর্থিক খাতের এত বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, বাইরে থেকে কল্পনাও করা যাবে না। এত অনিয়ম, এত বিশৃঙ্খলা, এত দুর্নীতি পৃথিবীর আর কোথাও হয়নি।”
অর্থ পাচার প্রতিরোধ, মুদ্রানীতি ও ঋণনীতি প্রণয়ন এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবস্থাপনাসহ বহুবিধ কাজের মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম প্রধান কাজ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রণ ও সুশাসন বজায় রাখা। কিন্ত সংস্থাটি এখন কর্ম ক্ষমতা হারিয়ে ঝিমিয়ে পড়া চলৎশক্তিহীন এক হাতি।
একটু পিছনে ফিরে তাকাই, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটা পঙ্গু হয়ে আছে তা দেখার জন্য।
কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম-দুর্নীতির মামলার শুনানিকালে ক্ষোভ প্রকাশ করে হাইকোর্ট বলেছিলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংকে যে সব কর্মকর্তা বসে বসে মধু খেত, তারা চুপ থাকতো।” এ সময় একজন নির্বাহী পরিচালককে চোর ও ডাকাত বলেও উস্মা প্রকাশ করেন হাইকোর্ট।
ভয়ঙ্কর বিষয় হলো, রাষ্ট্রীয় কোষাগার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ সংস্থায় পরিণত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে গেছেন সরকার পতনের অব্যবহিত পূর্বের দুই গভর্নর। শীর্ষ কর্মকর্তাদের দুর্নীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় আগের থেকেই ক্রমাগত ভঙ্গুর হচ্ছিল নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। অবস্থা এমন, যে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই পারছে না, সে কীভাবে অন্যকে পথ দেখাবে।
কর্মকর্তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়া, বেশির ভাগ সিদ্ধান্ত ওপর থেকে চাপানো, ভালো রিপোর্ট দেওয়ার শর্তে ব্যাংক পরিদর্শকদের ঘুষ গ্রহণের মতো নানা অনৈতিক কর্মকান্ডের প্রতিবাদে অনেক কর্মকর্তার পদত্যাগ এবং সর্বশেষ সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ ক্ষত কতটা তা সহজেই বোঝা যায়।
ব্যাংক খাত সংস্কারের আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে হবে কিন্ত এ নতুন সরকারের বয়স ৩ মাস পার হলেও সংস্কার বিষয়ে আশানুরূপ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে মনে করা যায় না। কেবল দুর্বল ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট নিরসনে তাদের তৎপরতা দৃশ্যমান। ব্যংকের প্রকৃত অবস্থা জানাতে ৬ সদস্যের যে টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে, তাদের রিপোর্টের অগ্রগতি বিষয়ে কিছু জানা যায়নি। আর নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাটি মেরামতের জন্য কমিটিই গঠিত হয়নি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কার না করে ব্যাংক ও আর্থিক খাত সংস্কারের উদ্যোগ, অনেকটা ঘোড়ার আগে গাড়ি চলার মতো।
ব্যংকিং কোম্পানি আইন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেশের ব্যাংকিং খাতকে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা দিয়েছে। কিন্ত তারা স্বাধীনভাবে কাজ করার সক্ষমতা হারিয়েছে, শীর্ষ নির্বাহীগণ ন্যুনতম প্রতিবাদ না করে সকল অপরাধমূলক কাজের সাথে নিজেরাই সম্পৃক্ত থেকেছেন।
মাথার ওপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ক্রীয়াশীল থাকায় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করার কারণে ব্যাংকিং বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করতে পারছে না — এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এমন কি বর্তমান অর্থ উপদেষ্টার বিভিন্ন সাক্ষাৎকার ও লেখায় এমন মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে মুক্ত করার এখনই উপযুক্ত সময়, কারণ অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ চাইলেই তা হতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা এই উপদেষ্টার আমলেই যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত না হতে পারে, তা হলে কবে হবে ?
অন্যথায় মানুষ বলবেই, একজন বিশেষজ্ঞ ভালো ভালো আইডিয়া দিতে পারেন বটে, তা কার্যকর করার সক্ষমতা রাখেন না। দেশের খ্যাতনানা অর্থনীতিবিদরা বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় যা ই বলুক তা না শুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিৎ হবে ব্যাংকিং নিয়মাচার মেনে কাজ করা। কিন্ত এমন স্বাধীনচেতা গভর্নর কোথায় পাওয়া যাবে ?
প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে চাটুকার আর যোগ্যতাহীন কর্মকর্তাদের চাপে দৌরাত্ম্যে যোগ্যতা সম্পন্ন কর্মকর্তারা কোনঠাসা হয়ে পড়েন। সৎ ও মেধাবীদের সুরক্ষা দিলে সব প্রতিষ্ঠানই নিশ্চয় সফলতার দিকে অগ্রসর হবে।
সাবেক গভর্নর ও বর্তমান অর্থ ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের প্রাজ্ঞ ও সময়োচিত পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয় কোষাগার দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিশ্চয়ই সমহিমায় ঘুরে দাঁড়াবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।