প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
নারী অধিকার ও পুরুষ অধিকারের মধ্যে পার্থক্য
২০২৪ ডিসেম্বর ০৫ ১৭:২৯:০৮মোসাম্মৎ শামিমা ইয়াসমিন অরিনা
নারী অধিকার ও পুরুষ অধিকারের মধ্যে পার্থক্য মূলত সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠেছে। এই দুইটির মধ্যে কিছু মৌলিক সমানতা এবং কিছু পার্থক্য রয়েছে, যেগুলো সমাজের চাহিদা, বাস্তবতা ও মানুষের ধারণার ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়। তবে, বর্তমান বিশ্বে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও তাদের সমান অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন তীব্র হচ্ছে, যখন পুরুষদের অধিকারের প্রসঙ্গেও নতুন নতুন ধারণা উঠে আসছে। নিচে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আলোচনা করা হলো:
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:প্রতিটি সমাজে পুরুষ এবং নারীর ভূমিকা আলাদা হয়ে এসেছে। বহু যুগ ধরে নারীকে ঘরকন্না, সন্তান পালন এবং অন্যান্য গৃহস্থালির কাজের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, ফলে নারীর অধিকার সীমাবদ্ধ ছিল। পুরুষদের বেশি বাইরে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, আর এই কারণে সমাজে পুরুষরা অধিক ক্ষমতা ও সুযোগ পেয়ে এসেছে। নারীর ভোটাধিকার, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ইত্যাদি অধিকারের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে সংগ্রাম করতে হয়েছে।
সামাজিক অবস্থান: সামাজিকভাবে পুরুষরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল এবং নারীরা নানান রকম বৈষম্য ও নিষেধাজ্ঞার শিকার হয়েছে। পুরুষেরা সর্বত্র পুরোভাগে ছিল, বিশেষত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রগুলোতে। নারীরা এই ক্ষেত্রগুলোর বাইরে থাকলেও, ১৯০০ সালের পর থেকে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বেশ কিছু অগ্রগতি হয়েছে। বর্তমানে নারীরা পুরুষদের সমান অধিকারে অংশ নিতে শুরু করেছে, তবে সামাজিক কিছু বাধা এখনও বিদ্যমান।
শারীরিক পার্থক্য: নারী ও পুরুষের শারীরিক গঠনের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, যেমন শারীরিক শক্তি, সহনশীলতা, প্রজননক্ষমতা ইত্যাদি। এর কারণে, কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের শারীরিক কাজের জন্য বেশি সুবিধা থাকে, তবে নারীরাও তাদের শারীরিক ও মানসিক দক্ষতার মাধ্যমে বিভিন্ন কাজ করতে সক্ষম। নারীর প্রজননক্ষমতা ও মা হওয়ার দায়-দায়িত্ব সমাজে নারীকে কিছু সামাজিক চাপের মধ্যে ফেলে দেয়, যা পুরুষদের ক্ষেত্রে কম।
আইনগত পার্থক্য: অনেক দেশে নারীর অধিকার সুরক্ষিত করতে বিশেষ আইন রয়েছে। যেমন, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি, শ্রম বাজারে বৈষম্য এবং মাতৃত্বকালীন ছুটি ইত্যাদি। পুরুষদের অধিকারের ক্ষেত্রেও কিছু আইনি সুবিধা রয়েছে, তবে নারীদের অধিকার নিয়ে আরও বেশি আইনগত উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কারণ নারীরা ঐতিহাসিকভাবে অনেক বেশি শোষিত হয়েছে।
পরিবার ও সমাজে ভূমিকা: একটি পরিবারে পুরুষ সাধারণত আয়ের উৎস এবং পরিবারের প্রধান হিসেবেই কাজ করে আসছে, যখন নারীরা ঘরকন্না, সন্তান পালন এবং সংসার ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত থাকে। যদিও আজকাল পুরুষরা নারীদের সমানভাবে সাহায্য করছে, তবে সমাজে নারীদের কাজের মূল্য অনেক সময় কমিয়ে ধরা হয়। নারীর শ্রমকে অনেক সময় অবমূল্যায়ন করা হয়, যেখানে পুরুষের কাজের মূল্যায়ন বেশি।
নারীর অধিকার আন্দোলন: বিশ্বব্যাপী নারীর অধিকারের আন্দোলন দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। নারীরা অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করেছে, যেমন ভোটাধিকার, শিক্ষা, কাজের অধিকার এবং নিজেকে স্বাধীনভাবে চিহ্নিত করার অধিকার। পুরুষদের অধিকারের জন্য তেমন কোনো বৃহৎ আন্দোলন হয়নি, কারণ পুরুষেরা ঐতিহাসিকভাবে অধিক ক্ষমতা ও সুবিধা পেয়েছে। তবে, পুরুষেরও কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলোতে তাদের অধিকারের সুরক্ষা প্রয়োজন, যেমন পুরুষের মানসিক স্বাস্থ্য, পিতৃত্বকালীন ছুটি, সহিংসতার শিকার পুরুষ ইত্যাদি।
অর্থনৈতিক সুযোগ: অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পুরুষরা আরও বেশি সুযোগ পেয়েছে। তবে নারীরা এখন অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের সমান বেতন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। তবে, কিছু ক্ষেত্রে পুরুষদের তুলনায় নারীরা এখনও কম মজুরি পায়, বিশেষ করে কিছু উচ্চপদে এবং প্রযুক্তিগত খাতে।
মানসিক স্বাস্থ্য: পুরুষেরা সাধারণত তাদের অনুভূতি প্রকাশে বেশি সংযত থাকে, যা কখনও কখনও তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় নিয়ে যেতে পারে। নারীরা সাধারণত তাদের অনুভূতি প্রকাশে আরও স্বচ্ছন্দ থাকে। সমাজের চাপ ও প্রত্যাশা পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্যেও কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
পরিশেষে বলতে চাই, নারী ও পুরুষের অধিকারের মধ্যে পার্থক্য মূলত সমাজের পুরানো ধারণা, সাংস্কৃতিক বাধা এবং ঐতিহাসিক অবস্থা দ্বারা প্রভাবিত। নারীর অধিকারের ক্ষেত্রে এখন অনেক অগ্রগতি হলেও, পুরুষেরও কিছু সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মানসিক সমস্যার সমাধান প্রয়োজন। সমাজে পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনও নির্দিষ্ট লিঙ্গকে বৈষম্যের শিকার না হতে হয়।
লেখক: নারী উদ্যোক্তা ও কলাম লেখিকা।