প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
হযবরল রাজনীতি ও অর্থনীতি: গন্তব্য কোথায়?
২০২৫ ফেব্রুয়ারি ০৬ ১৮:০২:৩৬-1.jpg)
মীর আব্দুল আলীম
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ফলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি আজ গভীর সংকটের মুখোমুখি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ক্ষমতার পালাবদল হলেও অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য ফেরেনি; বরং বিভিন্ন খাতে স্থবিরতা ও অবনতি প্রকট হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অনড় অবস্থান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থাহীনতা দেশের অর্থনীতিকে চরম অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নিম্নগতি: এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সম্প্রতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মতে, চলতি অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫.১ শতাংশে নেমে আসবে, যা পূর্বের ৬.৬ শতাংশ পূর্বাভাসের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে কম। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রতিক বন্যা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং বৈশ্বিক আর্থিক অস্থিতিশীলতা এ নিম্নগতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা যতদিন চলবে, বিনিয়োগকারীরা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না, যা প্রবৃদ্ধির হার আরও কমিয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক নির্বাচন ও সংস্কারের দ্বন্দ্বে সংকট দিনদিন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিরতা ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অন্তবর্তীকালনি সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র আকার ধারণ করেছে। বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলসমূহ নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবিতে সরকারকে চাপ দিচ্ছে। হুমকি এসেছে আন্দোলনের। অন্যদিকে সরকার নির্বাচনপদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনের পথ সুগম করতে চায়। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকারের দাবি, নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী করে এবং কিছু কাঠামোগত পরিবর্তন এনে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা সম্ভব।
তবে বিরোধী দলগুলোর অভিযোগ, সরকার ক্ষমতার স্বার্থে এই সংস্কারের উদ্যোগ নিচ্ছে এবং এটি মূলত তাদের একক আধিপত্য বজায় রাখার কৌশল। তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়, যা বর্তমান সরকার মানতে নারাজ। সাধারণ জনগণ এই রাজনৈতিক সংকটের ফলে চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবন ব্যাহত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি পারস্পরিক সমঝোতায় না আসে, তাহলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে এবং দেশ একটি গভীর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও শান্তি বজায় রাখতে হলে সংলাপ এবং সমঝোতার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো জরুরি। সরকার ও বিরোধী দলের উচিত জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সমাধান খোঁজা, যাতে দেশে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসে।
শিল্প কারখানা বন্ধ ও বেকারত্ব বৃদ্ধিদেশে সংকট আরও বাড়িয়ে তুলেছে। বর্তমানে বাংলাদেশে শিল্প খাত এক চরম সংকটকাল অতিক্রম করছে। গত ছয় মাসে শতাধিক রপ্তানিমুখী কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, যার ফলে বেকারত্বের হার উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত উচ্চ সুদহার, ঋণপ্রবাহের স্থবিরতা, এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় শ্রমিক ছাঁটাই ব্যাপকভাবে বেড়েছে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।
শিল্প খাত ধ্বংসের কারণ- ১. উচ্চ সুদহার ও ঋণপ্রবাহের স্থবিরতা। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারছে না, ফলে কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও রপ্তানি কমে যাওয়া। বিশ্ববাজারে অর্থনৈতিক মন্দার ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য রপ্তানিমুখী শিল্পের চাহিদা কমে গেছে। ফলে অনেক কারখানা পর্যাপ্ত ক্রয়াদেশ পাচ্ছে না এবং উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকট: শিল্প কারখানায় উৎপাদন সচল রাখতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ প্রয়োজন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এ দুটি খাতেই সংকট দেখা দেওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নতুন বিনিয়োগ থমকে যাওয়ায় এবং বন্ধ কারখানাগুলোর কারণে বিপুলসংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এটি চরম সংকট সৃষ্টি করেছে।
এদিকে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করের উচ্চহার এবং বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা উদ্যোক্তাদের নিরুৎসাহিত করছে। ফলে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে না এবং পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলোও টিকে থাকতে পারছে না। শিল্প খাতকে সচল রাখতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমাতে হবে এবং সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। এতে উদ্যোক্তারা নতুন বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। শিল্পখাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জ্বালানি নীতিতে সংস্কার আনতে হবে। বশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে রপ্তানিমুখী শিল্প খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা এবং কর রেয়াত প্রদান করা উচিত। বিনিয়োগ বান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হলে শিল্প খাতে কর ও শুল্কের হার সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ প্রচেষ্টায় নতুন শিল্প গড়ে তোলার জন্য বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। শিল্প খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি টেকসই শিল্পনীতি গ্রহণ করতে হবে। এতে ব্যবসায়ীদের আস্থাও বাড়বে।
শিল্প খাতের সংকট দূর করতে হলে সরকার, ব্যবসায়ী ও শ্রমিক সবার সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। শিল্পবান্ধব নীতি গ্রহণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, সহজ ঋণপ্রবাহ এবং কর হ্রাসের মাধ্যমে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে দেশের অর্থনীতি আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে। রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির জন্য এই সংকট ভয়াবহ হতে পারে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ছে, যেখানে ভারত, ভিয়েতনাম, ইথিওপিয়া বাংলাদেশের বিকল্প হয়ে উঠছে। সময়মতো সরকারি নীতি সহায়তা না পেলে রপ্তানিমুখী শিল্পগুলোর টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি: রাজনৈতিক অস্থিরতা কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি মন্থর হচ্ছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমছে, যা সরাসরি অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দীর্ঘস্থায়ী হলে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।
দেশের প্রধান প্রধান শহরে সংঘর্ষ সহিংসতা সেসঙ্গে বিএনপি এবং আওয়ামীলীগের আন্দোল হরতালের ঘোষনা ব্রবসা বাণিজ্যে আরো সংকট তৈরি করবে। ফলে ব্যবসায়ী মহলে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে এখন "উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ" হিসেবে দেখছে, যা ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও শ্লথ করে দিতে পারে।
ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ: আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতি ও প্রতিবেশী দেশের ষড়যন্ত্রের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেখানে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে এগোচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়লে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে কূটনৈতিক দক্ষতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে হবে। না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আরও কমে যাবে।
সমাধানের পথ: অর্থনীতির উন্নতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। কেবলমাত্র ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কার আনতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা এবং নীতি-নির্ধারণে স্বচ্ছতা ও দূরদর্শিতা থাকতে হবে। ব্যবসায়ীদের আস্থা ফেরাতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হলো কৃষি, তৈরি পোশাক খাত, রেমিট্যান্স এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই)। কিন্তু এসব খাতে বর্তমানে যে সংকট চলছে, তা নিরসন করা না গেলে সার্বিক অর্থনীতির উন্নতি সম্ভব নয়। কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে এবং কৃষকদের জন্য সহজ শর্তে ঋণপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। পোশাক খাতের জন্য বৈদেশিক বাজার সম্প্রসারণ, নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার এবং শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগ দিতে হবে। শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নেও মনোযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শিল্পের চাহিদার সমন্বয় ঘটিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে হবে।
সর্বোপরি, অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে সরকারকে অবশ্যই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা ছাড়া অর্থনৈতিক সংকট কাটানো সম্ভব নয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দায়িত্বশীল নীতিমালার মাধ্যমে অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার সময় এখনই।
লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।