প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
রাম মন্দির অযোধ্যার ভাগ্য পাল্টে দিয়েছে
২০২৫ মার্চ ১২ ১৬:৪৪:৪৯
শিতাংশু গুহ
বলা হয়েছে যে, মহাকুম্ভমেলার ৭০% পুণ্যার্থী প্রয়াগরাজ থেকে রাম পুণ্যভূমি অযোধ্যায় গেছেন, বাকি ৩০% গেছেন কাশী বিশ্বনাথ বা বেনারস-এ। পরিসংখ্যান ঠিক ঐরকম কিনা জানিনা, তবে ঘটনা সত্য। অযোধ্যায় গিয়ে সেটি টের পেলাম। লোকে-লোকারণ্য অযোধ্যা। প্রয়াগরাজের ভীড় আছড়ে পড়েছে অযোধ্যায়। ক’দিন আগেও অযোধ্যা ছিলো গ্রাম, এখন সেটি একটি শহর, বলা ভাল নুতন শহর, চারিদিকে কাজ চলছে, গড়ে উঠছে পুণ্যতীর্থ রাম-জন্মভূমি।
নুতন শহর অযোধ্যা। রাতারাতি এ শহরে মানুষগুলো ‘বড়লোক’ হয়ে গেছে। জমির দাম আকাশছোয়া, চারিদিকে নির্মাণ কাজ চলছে, পর্যটক আসছে, হোটেল ব্যবসা রমরমা, জমজমাট। আগে যে হোটেলের ভাড়া ছিলো ২/৩ হাজার, এখন সেটি ৫/৭ গুণ, তাও পাওয়া গেলে। খুব ভালো ট্র্যাডিশনাল হোটেল ৩০/৩২ বা ২০/২৫ হাজার রুপি। খুব একটা ভাল হোটেল যে আছে তা নয়, প্রায় সব হোটেল মোটামুটি। চেইন হোটেল গড়ে উঠছে। শুনলাম, এতকিছুর পরও অযোধ্যার মানুষ নাকি মোদীকে ভোট দেয়নি?
আমরা একটি হোটেল নেই (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫), ভাড়া ৫/৬ গুণ, ছোট্ট হোটেল, মাত্র ১৪টি রুম, নুতন বিল্ডিং, সবকিছু ঝকঝকে তকতকে। মালিক-ম্যানেজার-কর্মচারী সবাই স্থানীয়, আন্তরিক, কোন কৃত্রিমতা নেই, নেই কোন ফরমালিটি। ম্যানেজার জানালেন, এখানে ভক্তরা আসেন, ভক্তের সেবাই তাঁদের লক্ষ্য। আমরা একরাত ছিলাম, সেবার কোন ত্রুটি ছিলোনা। না জেনে এ হোটেল নিলেও সিদ্ধান্তটি ভাল ছিলো। কারণ রামমন্দির হোটেল থেকে হাঁটাপথ। হোটেলটি কেন্দ্রবিন্দুতে, অনেকগুলো দর্শনীয় তীর্থ হাঁটা বা রিকশা দিয়ে যাওয়া যায়।
রিসাব নামে স্থানীয় একটি ছেলে আমাদের এয়ারপোর্ট থেকে কখনো নুতন রাস্তা, কখনো গ্রাম্য পথে হোটেলে নিয়ে যায়, বুঝলাম হোটেল সেও চিনে না। রিসাব আমাদের রাম মন্দিরে নিয়ে যায়, আগেই জেনেছি যে, বিদেশী পাসপোর্ট হলে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট পাওয়া যায়। সত্যিই তাই, যেখানে মানুষ ৪/৫ ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে রামলালা’র দর্শন পায়, আমরা মাত্র ৩০/৪০ মিনিটে তা শেষ করি। পূজা দেয়ার ব্যবস্থা নেই, তাই পান্ডা নেই! তবে দর্শন শেষে প্যাকেট প্রসাদ বিনামূল্যে দেয়া হয়।
রাম মন্দির সন্নিকটেই দশরথ ভবন, ও কনক মহল। সবই অতি পুরানো, এতকাল অযত্নে পড়েছিল, এখন সংরক্ষণ হচ্ছে। রাজা দশরথ ছোটরানী কৈকেয়ী-কে কনক মহল তৈরী করে দিয়েছিলেন। রামচন্দ্র বিয়ে করে সীতাকে নিয়ে এলে রানী কৈকেয়ী সেটি উপহার হিসাবে সীতাকে দেন্। পাশেই হনুমান গারহি মন্দির। এ রাস্তাটা যথেষ্ট চাপা, এবং সেখানে অনেক বাঁদরের বসবাস। আমরা ৩ জন কলা কিনে খাচ্ছিলাম, লক্ষ্য করিনি, হটাৎ একটি বাদর আমার হাত থেকে অর্ধ-খাওয়া একটি কলা নিয়ে যায়। আমরা ওদের বেশ ক’টি কলা খেতে দেই। ফেরার পথে আবার অনেকগুলো কলা ওঁদের খেতে দেই।
দশরথ ভবনের সামনে র্দাড়িয়ে আপনি ভাবতেই পারেন, এবাড়ীতেই ছোটবেলায় রাম-লক্ষণ খেলা করতো! এখন থেকেই তাঁরা বনবাসে যায়, এই অযোধ্যাই ছিলো, ‘রামরাজ্য’। সূর্য বংশের রাজারা এখানে শাসন করেছেন। অযোধ্যা থেকে শ্রীলংকার দুরুত্ব ২৬৩১ কিলোমিটার। এখনকার হিসাবে সামান্যই, তখনকার হিসাবে বহুতদূর! রাম-রাবন যুদ্ধের কথা স্মরণ করে আপনি শিহরিত হতে পারেন। মূলত: শহরের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যেই সবকিছু, আপনি নাগেশ্বরনাথ মন্দিরেও যেতে পারেন।
পড়ন্ত বিকেলে আমরা হোটেলের ঠিক করে দেয়া রিকশায় সরজু নদীর পাশে যাই। এটি মেইন রাস্তা, হেঁটে রাম মন্দির যাওয়া যায়, সেখানে মানুষের ঢল, লোকে লোকারণ্য। আমরা উল্টোদিকে হাঁটি, সেখানে লতা মুঙ্গেশকারের সম্মানে একটি বিশাল সারেঙ্গী রাখা আছে, স্থানটি’র নাম ‘লতামুঙ্গেশকার স্কয়ার’। সাথেই সরযূ নদী, লেকের মত, বোঝা যায়, পরিকল্পিতভাবে এটিকে ঐস্থানে পুণ্যার্থীদের জন্যে হাটু জল করে রাখা হয়েছে। দুইদিকে বাধাই করা ঘাট, একপাড়ে ছোটখাট মেলা। অন্য পাড়ে দোকানপাট, মন্দির সবই আছে। সরযূ নদীর পাড়ে সন্ধ্যা আরতি হয়, আমরা দেখলাম, ভালই। হিন্দু মাত্রই ছোটবেলায় রামায়ণ পড়া থাকবে, অযোধ্যায় গেলে নুতন করে আবার দশরথ, কৈকেয়ী, বা সরযূ নদীর কথা মনে পড়বে। সন্ধ্যা বেলায় সরযূ নদীর পাশ দিয়ে হাঁটতে মন্দ লাগবে না।
পরদিন আমাদের ফ্লাইট দুপুরে হলেও আমরা সকালেই বেরিয়ে পড়ি, কারণ আমাদের আরো কিছু দর্শনীয় স্থানে যাবার কথা। রিসাব সকালেই চলে আসে, আমরা প্রথমে যাই পঞ্চশিবের মন্দির। পুরানো, কিন্তু সাজানো-গুছানো। সেখান থেকে গুপ্তারঘাট, অর্থাৎ শ্রীরাম সরযূ নদীর যে ঘাট থেকে স্বর্গবাসী হ’ন। পুরানে আছে তিনি সরযূ নদীতে নেমে স্বর্গে চলে যান। এজন্যে এই ঘাটের নাম এটি। তিনি যেই খড়ম জাতীয় জুতা ব্যবহার করতেন, বা যে জুতাজোড়া ছেড়ে তিনি শেষবারের মত নদীতে নামেন, সেই জুতাজোড়া সেখানে রক্ষিত আছে, এটিকে বলা হয়, ‘রাম কি পিদি’।
বিমান বন্দরে যেতে মিলিটারি টেম্পল পড়বে, আমাদের যাওয়া হয়নি। তবে ‘তুলসী উদ্যান গার্ডেন’ আপনি বাইরে থেকে দেখে নিতে পারেন। অযোধ্যা বিমানবন্দরটি এখন আন্তর্জাতিক, ছোট্ট, পরিচ্ছন্ন। শুনলাম, পাঁচ বছরে অযোধ্যার নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। বহু পুরাতন ঐতিহাসিক শহর ‘অযোধ্যা’ গিয়ে আপনার ভাল লাগবে। মাটির গুণ কিনা জানিনা, রিসাব ছেলেটি ভাল, শুনলাম এমবিএ, জানালো, মায়ের অসুস্থতার কারণে অযোধ্যা ছেড়ে যেতে পারছেন না! এমনিতে অযোধ্যায় আপনার ভয় লাগবে না, চোর-ডাকাত সন্ত্রাসী আছে বলে শুনিনি।
লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।