প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
বিকৃত পৌরুষের শিকার আছিয়া, সমাজ কতটা দায়ী?
২০২৫ মার্চ ১৩ ১৯:০২:৫৩মীর আব্দুল আলীম
আছিয়া আর ফিরবে না। তার নিষ্পাপ মুখ আর অপলক চাহনি কোনোদিনও আমাদের সামনে ভেসে উঠবে না। অথচ তার মৃত্যু আমাদের সামনে রেখে গেছে এক কঠিন প্রশ্ন— আমরা কি সত্যিই সভ্য সমাজে বাস করছি? আমাদের মানবতা কি শেষ হয়ে গেছে?
আছিয়ার মৃত্যু আমাদের চরম ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। এটি শুধু একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি নয়, এটি আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে থাকা বিকৃত পৌরুষত্বের প্রতিফলন। আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক নির্মম উদাহরণ।
গত ৬ মার্চ, ২০২৫ সালে বড় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে সে হয়ে পড়ে পাশবিক নির্যাতনের শিকার। অভিযোগ অনুযায়ী, তার দুলাভাই সজীব হোসেনে বাবা হিটু শেখ তাকে ধর্ষণ করে। আর এই বর্বরতার ঘটনা জানার পর সজীবের মা জাবেদা বেগম ও ভাই রাতুল শেখ মিলে বিষয়টি ধামাচাপা দিতে শিশুটিকে হত্যার চেষ্টা করে। গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলেও শেষরক্ষা হয়নি। চিকিৎসকদের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে আসিয়া মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এই ঘটনা আমাদের সামনে সমাজের এক অন্ধকার দিক উন্মোচিত করেছে— যেখানে নারীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানো হয়, তাদের স্বপ্ন ধ্বংস করা হয়, এবং কখনও কখনও তাদের জীবন কেড়ে নেওয়া হয়। বিকৃত পৌরুষত্ব কেবল নারীদের জন্য নয়, গোটা মানবতার জন্য এক অভিশাপ।
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা নতুন কিছু নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এমন নৃশংসতার পরও বিচার পাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। নারী ও শিশু নির্যাতনের বেশিরভাগ মামলাই বিভিন্ন কারণে ধামাচাপা পড়ে যায়। প্রভাবশালী আসামিদের কারণে স্বজনেরা ন্যায়বিচার পান না। আদালতে গড়ালেও দীর্ঘসূত্রতা ও দুর্নীতির কারণে বিচার পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়।
২০১২ সালে সাভারে পাঁচ বছরের শিশু সামিয়ার ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা আলোড়ন তুলেছিল। ২০২০ সালে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে নিন্দার ঝড় তোলে। কিন্তু এসব ঘটনার কঠোর শাস্তির দৃষ্টান্ত সমাজে কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে?
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১,৯৮৭ জন নারী ও শিশু, যার মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১২৪ জন। কিন্তু এদের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির সংখ্যা খুবই কম। আছিয়া সেই বিচারহীনতার নির্মম শিকারদেরই একজন।
ঘৃণিত পৌরুষত্বের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ
১. পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা: শিশুকাল থেকেই ছেলেদের শেখানো হয় যে তারা নারীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। এই মানসিকতা তাদের মধ্যে এক ধরনের অধিকারবোধ তৈরি করে, যা পরে ঘৃণিত পৌরুষত্বে পরিণত হয়।
২. বিচারহীনতার সংস্কৃতি: নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তার বাস্তবায়ন প্রায়শই হয় না। অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যায়, ফলে ভবিষ্যতে অন্যরা একই অপরাধ করতে উৎসাহিত হয়।
৩. নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি: সমাজে নারীদের স্বাধীনতা সহ্য করা হয় না, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার খর্ব করা হয় এবং তাদের ব্যক্তি পরিচয়কে শুধুমাত্র পুরুষের অধীনস্থ করে তোলা হয়।
৪. শিক্ষার অভাব ও বিকৃত সংস্কৃতি: নারীর প্রতি সম্মানবোধ শেখানো না হলে ঘৃণিত পৌরুষত্ব আরও শিকড় গেড়ে বসে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক রীতিনীতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে নারীকে দুর্বল করে রাখার চেষ্টা করা হয়।
সমাজের ভূমিকা ও করণীয় পদক্ষেপ
১. নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব গড়ে তোলা: পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধার শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে।
২. বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী করা: নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. নারীর ক্ষমতায়ন: শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে নারীদের আত্মনির্ভরশীল করতে হবে।
৪. পুরুষদের মানসিকতা পরিবর্তন: পুরুষদের মধ্যেও নৈতিক শিক্ষা প্রদান করতে হবে, যাতে তারা নারীদের সহযোগী হিসেবে দেখে, প্রতিপক্ষ হিসেবে নয়।
৫. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যম, সামাজিক আন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক প্রচারণার মাধ্যমে ঘৃণিত পৌরুষত্বের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
আজ প্রশ্ন একটাই— আমরা কি আরেকটি আছিয়ার লাশ দেখতে চাই? সমাজ কি এই পাশবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে, নাকি চোখ বুজে থাকবে?
আমাদের প্রয়োজন কঠোর আইন ও তার যথাযথ প্রয়োগ। ধর্ষণের বিচার দ্রুততম সময়ে সম্পন্ন করতে হবে। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিক প্রতিটি স্তরে নারী ও শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন না হলে আইন করেও সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।
ধর্ষকের একমাত্র পরিচয় সে ধর্ষক- সে কোনো দলের, কোনো সম্প্রদায়ের, কোনো পরিবারের গর্ব হতে পারে না। আছিয়ার রক্ত বৃথা গেলে আমাদের বিবেক চিরদিনের জন্য কলুষিত হবে। আমরা কি সেই কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকতে চাই?
লেখক : কলামিস্ট ও সমাজ বিশ্লেষক।