ঢাকা, শনিবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৫, ১৩ বৈশাখ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন: ধরিত্রী দিবসে করণীয় বিশ্লেষণ

২০২৫ এপ্রিল ২১ ১৭:৩৪:৪৪
পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন: ধরিত্রী দিবসে করণীয় বিশ্লেষণ

ডা. মাহতাব হোসাইন মাজেদ


প্রতিবছর ২২ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালিত হয় “বিশ্ব ধরিত্রী দিবস” বা “Earth Day”। এটি এমন একটি দিন, যেদিন মানুষ পরিবেশ, প্রকৃতি ও পৃথিবী রক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। আধুনিক সভ্যতা যত এগিয়ে যাচ্ছে, ততই প্রকৃতি ও পরিবেশের উপর চাপ বাড়ছে। এই দিনে বিশ্ববাসী একত্রিত হয়ে পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য, সবুজ ও টেকসই রাখার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়। সম্প্রতি বিশ্ববাসী জলবায়ু পরিবর্তনে সোচ্চার হয়ে আন্দোলন ও আলোচনা অব্যাহত রাখছে বিশ্বজুড়েই। বিভিন্ন দেশের মানুষ এই আন্দোলনে অংশগ্রহণও করছেন নিয়মিত। শিল্পোন্নত দেশের খামখেয়ালিপনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন আলোচনা ও লেখালেখির মাধ্যমে। পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমিয়ে আনার প্রচেষ্টায় লড়াই করে যাচ্ছেন তাঁরা। তাঁদের অভিযোগের তির তাক করানো রয়েছে শিল্পোন্নত দেশগুলোর দিকেই। মূলত শিল্পোন্নত দেশগুলোই পরিবেশের বিপর্যয় ঘটিয়ে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়িয়ে দেওয়ার নেপথ্য নায়ক। বড় বড় শিল্পকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি নির্মাণ, নির্বিচারে বন উজাড়, নদীশাসন ইত্যাদির ফলে দারুণভাবে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সমগ্র বিশ্বে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর খামখেয়ালিপনার কারণে সিএফসি গ্যাস, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনোক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বেড়ে গেছে। যে গ্যাস নিঃসরণের কারণে পৃথিবীর ফিল্টার নামে খ্যাত ওজোনস্তর পাতলা হয়ে ভূপৃষ্ঠ তপ্ত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে। অর্থাৎ সূর্যের প্রায় ১ লাখ ১৫ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাকে ছেঁকে বিশুদ্ধ করে পৃথিবীর উপযোগী তাপমাত্রা পাঠাতে ব্যর্থ হচ্ছে ওজোনস্তর।

উল্লেখ্য, পৃথিবীর জন্য সুষম তাপমাত্রা হচ্ছে ১০-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (কমবেশি হতে পারে)। অথচ সেই সুষম তাপমাত্রা এখন আর বিরাজ করছে না, বরং উল্টোটি ঘটছে। ধীরে ধীরে বরফযুগের সমাপ্তি ঘটিয়ে পৃথিবী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ক্রমেই। তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। কয়েক বছর আগে, (৮ জুন, ২০১৯ সালে) কুয়েতের তাপমাত্রা বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছিল। কুয়েতেই সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৬৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠেছিল। ওই তাপে গাড়ির চাকার টায়ারও গলে গেছে। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, ছায়াযুক্ত স্থানেও ছিল ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। যেই তাপমাত্রায় একজন মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিনতর হয়ে পড়ে। উদাহরণ হচ্ছে, তাপমাত্রা ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে গেলেই ডিম সেদ্ধ হতে থাকে, সে ক্ষেত্রে ৬৩-৭০ ডিগ্রি অতি নিকটেই। কাজেই আমরা বলতে পারি, এটি বিশ্বের জন্য অতি ভয়ানক একটি অশনিসংকেত। আর প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণের মধ্যে মানুষ মাত্র হলো একটি প্রাণ।

এছাড়াও পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রাণ রয়েছে, যা আমাদের জীবন রক্ষায় সহযোগিতা করে। সুতরাং প্রত্যেকটি প্রাণের টিকে থাকার পরিবেশ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। পৃথিবী টিকিয়ে রাখতে আন্তঃনির্ভরশীল প্রাণ বৈচিত্র্যময় প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। আমাদের একটি নীল গ্রহ যেখানে এখন প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ আর কোটি কোটি প্রাণী গ্রহের বাসস্থান। সঙ্গে আছে নদনদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর, মরুভূমি, জলপ্রপাত। আমাদের ধরিত্রী আমাদের দিয়েছে জীবন ধারণের জন্য নির্মল বায়ু, পানি, খাদ্যসম্ভার, বসবাসের উপযোগী সব উপকরণ। আজ আমাদের এই একটি বাসযোগ্য ধরিত্রী জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে হুমকির মুখে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে একদিকে যেমন তীব্র তাপপ্রবাহ আর আরেক দিকে প্রচণ্ড শীত অথবা বন্যা, খরা, ঝড়-বৃষ্টি,জলোচ্ছ্বাস বা দাবানলে আজকের ধরিত্রী জর্জরিত। এগুলোর জন্য মানুষের কর্মকাণ্ড অনেকটা দায়ী। অতিলোভী মানুষ প্রকৃতির সম্পদের অপব্যবহার করেছে। পাহাড়-পর্বত, বনাঞ্চল কেটে উজাড় করেছে। নদনদী, খাল-বিল, জলাশয় ভরাট করে আবাস্থল আর শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করেছে। বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় বৃষ্টির পরিমাণ কমে যাচ্ছে আর তাপপ্রবাহ বাড়ছে। এই বছরের এপ্রিল মাসের তাপপ্রবাহ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে আমাদের ধরিত্রী দিনদিন উত্তপ্ত হচ্ছে। তীব্র তাপপ্রবাহে মানুষের শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে পানিসংকট দেখা দিচ্ছে। জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা করার জন্য বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখতে হবে। এর ওপর গেলে প্রাণীকুলের বাঁচার সম্ভাবনা কম।

বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের ইতিহাস:বিশ্ব ধরিত্রী দিবস প্রথম উদযাপিত হয় ১৯৭০ সালের ২২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসন এই দিনের সূচনা করেন। তিনি পরিবেশ দূষণ, বন উজাড়, বন্যপ্রাণী ধ্বংস এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে একটি গণসচেতনতা তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৯৭০ সালের সেই প্রথম ধরিত্রী দিবসে প্রায় ২ কোটি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। সেই থেকেই এটি প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে, এবং আজ তা ১৯০টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

এই দিনের গুরুত্ব:বিশ্ব ধরিত্রী দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা প্রকৃতির অংশ এবং প্রকৃতি বিনষ্ট হলে আমরাও নিরাপদ নই। এটি শুধুমাত্র গাছ লাগানো বা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার আহ্বান নয়, বরং পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার একটি বৈশ্বিক আন্দোলন।পরিবেশের উপর মানুষের নেতিবাচক প্রভাব যেমন-

* গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণতা * বায়ু ও পানির দূষণ * বনাঞ্চল নিধন * প্লাস্টিক দূষণ * জীববৈচিত্র্যের ক্ষয় এই সকল ইস্যু ধরিত্রী দিবসের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু। এই দিনে বিভিন্ন সেমিনার, র‍্যালি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি এবং সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধরিত্রী দিবস: বর্তমান বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছর উষ্ণতার হার বাড়ছে, বরফ গলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে, অরণ্য উজাড় হচ্ছে, এবং নতুন নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এই পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে অন্যতম।বিশ্ব ধরিত্রী দিবস তাই এইসব সমস্যার সমাধানে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলে। যেমন: * নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার * পুনর্ব্যবহারযোগ্য সামগ্রী ব্যবহার * গাছ লাগানো ও বন সংরক্ষণ * শিল্প-কারখানায় দূষণ নিয়ন্ত্রণ * জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ * পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে: বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। প্রতি বছর বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, খরা ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখানে নিয়মিত দেখা যায়। এইসব দুর্যোগের পেছনে রয়েছে পরিবেশগত ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব।

বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান পরিবেশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। বিদ্যালয় ও কলেজে পরিবেশ সচেতনতামূলক শিক্ষা চালু হয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের ভূমিকা:ধরিত্রী দিবস কেবল একটি দিন নয়, এটি একটি দায়িত্বের নাম। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে কিছু সহজ অভ্যাস গড়ে তুললে আমরা পরিবেশের জন্য অনেক কিছু করতে পারি। যেমন:- পানি অপচয় বন্ধ করা * বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা * নিজের বাসা ও আশপাশ পরিষ্কার রাখা * প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাপড় বা কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করা * অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ এড়িয়ে চলা * গাছ লাগানো ও যত্ন নেওয়া

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ধরিত্রী দিবস:বিশ্ব ধরিত্রী দিবসে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের প্রতিযোগিতা যেমন রচনা লেখা, চিত্রাঙ্কন, পোস্টার তৈরি, আলোচনা সভা, নাটিকা ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয়। শিক্ষার্থীরাই ভবিষ্যতের নেতৃত্ব, তাই তাদের প্রকৃতিপ্রেমী ও পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে হবে।

জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক উদ্যোগ: জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি ও সম্মেলন করেছে। কিয়োটো প্রোটোকল, প্যারিস চুক্তি এবং কপ (COP) সম্মেলনগুলো পরিবেশ রক্ষার বৈশ্বিক পরিকল্পনার অংশ। এগুলোর মাধ্যমে দেশগুলো নির্ধারিত লক্ষ্য পূরণে কাজ করে যাচ্ছে। তবে কেবল সরকার নয়, সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া এসব লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব।

এবারের ধরিত্রী দিবসে আসুন এ পৃথিবী সম্পর্কে দারুণ কিছু তথ্য জেনে নেই

পৃথিবী পুরোপুরি গোল নয়: আমাদের পৃথিবীকে সাধারণত গোল বলে বর্ণনা করা হয়, কিন্তু এটি আসলে পুরোপুরি গোলাকৃতির নয়। দুই মেরুর কাছে পৃথিবী কিছুটা চাপা, কাজেই আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে পৃথিবী আসলে উপ-বর্তুলাকার। আর সব গ্রহের মতোই মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং নিজের অক্ষের উপর ঘূর্ণনের কারণে সৃষ্ট কেন্দ্রাতিগ শক্তির প্রভাবে মেরু অঞ্চল কিছুটা চ্যাপ্টা, আর নিরক্ষীয় অঞ্চল কিছুটা চওড়া। এ কারণেই বিষুব রেখা বরাবর পৃথিবীর ব্যাস এক মেরু হতে অন্য মেরু বরাবর ব্যাসের চেয়ে ৪৩ কিলোমিটার বেশি।

পৃথিবীর ৭০ ভাগ পানি: পৃথিবীতে পানি আছে কঠিন, তরল এবং বায়বীয়- এই তিনটি আকারে।এছাড়া বিশ্বের উপরিভাগের তিন চতুর্থাংশই পানিতে ঢাকা, যা আছে হিমবাহ, জলাভূমি, লেক, নদী, সাগর কিংবা মহাসাগরের আকারে।তবে বিশ্বের পানির ৯৭ ভাগই মহাসাগরের লবণাক্ত পানি।

স্পেস বা মহাকাশের শুরু যেখান থেকে: বিশ্বের একশ কিলোমিটার ওপর থেকেই স্পেস বা মহাকাশের শুরু।বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশের যে সীমানা সেটি পরিচিত কারম্যান লাইন হিসেবে, যা সমুদ্রসীমার একশ কিলোমিটার ওপরে। বায়ুমণ্ডলে যেসব পদার্থ আছে, তার ৭৫ শতাংশই কিন্তু সমুদ্র সমতল হতে প্রথম ১১ কিলোমিটারের মধ্যে।

পৃথিবীর কেন্দ্রভাগ গঠিত মূলত লোহা দিয়ে: সৌরজগতে পৃথিবী হলো পঞ্চম বৃহত্তম গ্রহ। পৃথিবীর সবচেয়ে অভ্যন্তরভাগ একটি নিরেট বলের মতো বলে মনে করা হয়। এটির ব্যাসার্ধ প্রায় বারোশো কিলোমিটার। এটি মূলত লোহা দিয়ে গঠিত, যা এর ওজনের প্রায় ৮৫ শতাংশ। আর আছে নিকেল, যা এই নিরেট বলের প্রায় দশ শতাংশ।

পৃথিবী একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণ আছে: এই মহাবিশ্বে পৃথিবী একমাত্র নভোমণ্ডলীয় স্থান, যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব আছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। পৃথিবীতে তালিকাভুক্ত প্রাণির প্রজাতির সংখ্যা এখন ১২ লাখ। যদিও এটিকে মোট প্রাণির একটি সামান্য অংশ বলে মনে করা হয়। ২০১১ সালে বিজ্ঞানীরা ধারণা দিয়েছিলেন যে প্রাকৃতিক বিশ্বে প্রায় ৮৭ লাখ প্রজাতি আছে সব মিলিয়ে। এই পৃথিবীর গঠন হয়েছিলো প্রায় চার দশমিক পাঁচ বিলিয়ন বছর আগে এবং এর সম্পদ, ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস ও এর কক্ষপথের কারণেই এখানে লাখ লাখ বছর ধরে প্রাণের অস্তিত্ব টিকে আছে।

বিশ্বের সর্বত্র মাধ্যাকর্ষণ সমান নয়: আমাদের পৃথিবী যেহেতু নিখুঁত গোলক আকৃতির নয় এবং এর ভরও যেহেতু সর্বত্র সমানভাবে বিস্তৃত নয়, তাই মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র এবং শক্তিরও তারতম্য আছে বিভিন্ন জায়গায়। যেমন, আমরা যখন বিষুবরেখা হতে মেরু অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হই, মাধ্যাকর্ষণ শক্তির তীব্রতা বাড়তে থাকে।তবে মানুষের পক্ষে এই শক্তির তারতম্য অনুভব করা সম্ভব নয়।

পৃথিবী চরম বৈচিত্র্যের গ্রহ: এই পৃথিবী চরম বৈপরীত্যে পূর্ণ। ভৌগলিক এবং জলবায়ুর বৈচিত্রের কারণে প্রতিটি অঞ্চলেরই অদ্ভূত কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। পৃথিবীর উষ্ণতম স্থানের দাবিদার অনেক অঞ্চল আছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ডেথ ভ্যালীতেই এ পর্যন্ত বিশ্বের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ১৯১৩ সালের ১০ জুলাই ৫৬ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল থার্মোমিটারে।এর একদম বিপরীতে আছে অ্যান্টার্কটিকা। ১৯৮৩ সালের ৩১শে জুলাই সেখানে ভস্তক স্টেশনের যন্ত্রে তাপমাত্রা নেমে এসেছিল মাইনাস ৮৯ দশমিক ২ ডিগ্রিতে।

পৃথিবীতে জীবন্ত প্রাণের বৃহত্তম কাঠামো: অস্ট্রেলিয়া উপকূলের দ্য গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ হলো পৃথিবীতে জীবন্ত প্রাণের একক বৃহত্তম কাঠামো। এটি এত বড় যে, মহাকাশ থেকেও এটি দেখা যায়। প্রায় দু হাজার কিলোমিটার বিস্তৃত এই রিফে অসংখ্য সামুদ্রিক প্রজাতি বাস করে। ১৯৮১ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে।

সৌরজগতে একমাত্র: পৃথিবীতেই সক্রিয় টেকটনিক প্লেট আছে পৃথিবী হচ্ছে একমাত্র গ্রহ যেখানে সক্রিয় টেকটনিক প্লেট বিদ্যমান। এই প্লেটগুলোর নড়াচড়ার কারণে পৃথিবীর ভুপৃষ্ঠ ক্রমাগত পরিবর্তিত হচ্ছে। পৃথিবীতে পাহাড়-পর্বত গঠনের পেছনে এই প্লেটগুলোর ভূমিকা আছে। এগুলোর কারণেই ভূমিকম্প হয়, আগ্নেয়গিরি থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়। আবার এই প্লেটগুলো পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কার্বন ডাই অক্সাইডের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাসের রিসাইক্লিংয়ে সহায়তা করে।

পৃথিবীর একটি সুরক্ষা ঢাল আছে: পৃথিবীর ম্যাগনেটিক ফিল্ড সূর্যের উচ্চমাত্রার শক্তি কণা থেকে সুরক্ষার জন্য একটি ঢাল হিসেবে কাজ করে। এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড বিস্তৃত পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে শুরু করে বহিসীমা পর্যন্ত, যেখানে এটি সৌর বাতাসের সংস্পর্শে আসে। পাশাপাশি এই ম্যাগনেটিক ফিল্ড অনেক প্রাণীকে পথ খুঁজে পেতে সহায়তা করে। আমাদেরকেও কম্পাসের মাধ্যমে দিক নির্ণয়ে সাহায্য করে এটি।

পরিশেষে বলতে চাই, ধরিত্রী রক্ষায় সচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। এই পৃথিবীকে শুধু আমাদের জন্য নয় বরং পরবর্তী প্রজন্ম যেন সুস্থ এবং সুন্দরভাবে বেঁচে থাকতে পারে সে লক্ষ্যে পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে, তাই আমাদের বিশ্বাস, বিশ্ব ধরিত্রী দিবস পালনের মধ্য দিয়ে উপরিউক্ত বিষয়গুলো তুলে ধরার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বিশ্ববাসীর কাছে। তাতে শিল্পোন্নত দেশগুলো কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হবে তাদের কর্মকাণ্ডে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, বিশ্ব ধরিত্রী দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম অন্যান্য দিবসগুলোর তুলনায়, তাই দিবসটির তাৎপর্য গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট এবং পরিবেশের অবক্ষয় সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এ দিন নানা কর্মসূচিরও আয়োজন করা হয়।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।