প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
বিশ্ব বই দিবস: জ্ঞানের আলো ছড়ানোর একটি বিশ্বজনীন উদ্যোগ
২০২৫ এপ্রিল ২২ ১৭:১৮:০৩ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
মানব সভ্যতার ইতিহাসে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। হাজার হাজার বছরের জ্ঞান, সংস্কৃতি, অভিজ্ঞতা, আবিষ্কার ও কল্পনার সংরক্ষণ ও সংক্রমণের প্রধান মাধ্যম হলো বই। বই শুধু একটি বস্তু নয়, এটি একটি জানালার মতো, যেখান থেকে আমরা পৃথিবীর নানা কোণায় চোখ রাখতে পারি, নানা সময়ের ঘটনা অনুভব করতে পারি, এবং নিজেদের চিন্তা ও অনুভূতিকে প্রসারিত করতে পারি। এই বিশেষ ভূমিকার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিবছর ২৩ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব বই দিবস।
বই দিবসের ইতিহাস
বিশ্ব বই দিবসের সূচনা হয়েছিল ১৯৯৫ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে। এই দিনটিকে বেছে নেওয়ার পেছনে রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক গুরুত্ব। ২৩ এপ্রিল উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, মিগুয়েল দে সেরভান্তেস এবং ইনকা গারসিলাসো দে লা ভেগার মতো বিশ্বসেরা সাহিত্যিকদের মৃত্যুদিন। এই দিনটিকে কেন্দ্র করেই ইউনেস্কো ঘোষণা করে যে, এটি হবে "World Book and Copyright Day" — অর্থাৎ বই এবং কপিরাইট দিবস। উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বজুড়ে বই পড়া, বই প্রকাশ এবং কপিরাইট রক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।
বইয়ের গুরুত্ব
* বই কেবল তথ্যের ভাণ্ডার নয়, এটি একজন মানুষের চরিত্র গঠনে, চিন্তা-ভাবনার বিকাশে এবং সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিশুদের বয়সে পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলা মানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মননশীল, বিশ্লেষণধর্মী ও মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলা।
১. শিক্ষা ও জ্ঞানের বিকাশ: শিক্ষার মূল উপাদান বই। কোনো বিষয়ে মৌলিক ধারণা থেকে শুরু করে উচ্চতর গবেষণা পর্যন্ত, বইয়ের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। ডিজিটাল দুনিয়ার বিস্তার হলেও এখনো বইয়ের চাহিদা কমেনি।
২. মনন ও সংস্কৃতির চর্চা: বই একটি জাতির সংস্কৃতির প্রতিফলন। সাহিত্যের বই, ইতিহাস, দর্শন, ধর্মীয় গ্রন্থ প্রভৃতি আমাদের মনন ও মূল্যবোধে গভীর প্রভাব ফেলে।
৩. মানসিক শান্তি ও আত্মসুখ: অনেকেই বলেন, “A reader lives a thousand lives before he dies.” — পাঠক এক জীবনে অনেক জীবনের স্বাদ পান। বই পড়া মানুষকে এক ধরনের মানসিক প্রশান্তি দেয়, যা আজকের ব্যস্ত, যান্ত্রিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে বই দিবসের তাৎপর্য
* ডিজিটাল যুগে মানুষ অনেকটাই মোবাইল ও ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে পড়েছে। ইউটিউব, সোশ্যাল মিডিয়া, ই-বুক — সবকিছুই মানুষের পাঠ্যাভ্যাসকে প্রভাবিত করছে। এমন বাস্তবতায় বই দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় বইয়ের গুরুত্ব। এটা শুধু প্রতীকী নয়, একটি সচেতনতা তৈরির দিন — যাতে মানুষ আবার বইয়ের কাছে ফিরে আসে।
* বিশ্ব বই দিবসে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও পাঠাগারগুলোতে নানা রকম কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় — যেমন বই মেলা, পাঠ প্রতিযোগিতা, সাহিত্য আড্ডা, লেখক সম্মেলন ইত্যাদি। এই দিবসটি উদযাপন করে মানুষকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারা যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বই দিবস
* বাংলাদেশে বই পড়ার সংস্কৃতি আছে, এবং বইমেলা এই সংস্কৃতিকে আরও দৃঢ় করেছে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একুশে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে নতুন নতুন বই প্রকাশিত হয় এবং পাঠকেরা লেখকদের কাছ থেকে বই সংগ্রহ করেন। তবে শুধুমাত্র মেলা কেন্দ্রীক বইপড়া অভ্যাস গড়ে তুললে হবে না, তা হতে হবে বছরের প্রতিটি দিনজুড়ে।
* বিশ্ব বই দিবসের মতো আন্তর্জাতিক দিবসগুলো বাংলাদেশেও উদযাপিত হয়, যদিও এর ব্যাপকতা এখনও সীমিত। এই দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সংগঠন বই বিতরণ, পাঠচক্র, গল্প বলা, কবিতা পাঠ ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই উদ্যোগগুলো যদি গ্রাম ও প্রান্তিক পর্যায়ে বিস্তৃত করা যায়, তাহলে সার্বিকভাবে জাতির পাঠ্যাভ্যাসে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
বই ও আধুনিক প্রযুক্তি
* বর্তমানে বইয়ের একটি বড় অংশ চলে এসেছে ডিজিটাল মাধ্যমে — ই-বুক, অডিও বুক, অনলাইন রিডিং প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদিতে। যদিও এই প্ল্যাটফর্মগুলো পাঠকদের অনেক সুযোগ করে দিয়েছে, তবে প্রিন্ট বইয়ের গুরুত্ব এখনও অম্লান। গবেষণায় দেখা গেছে, ছাপানো বই পড়লে পাঠক বেশি মনোযোগী হন এবং তথ্য বেশি দিন মনে রাখতে পারেন।
* ডিজিটাল যুগে প্রযুক্তিকে শত্রু না ভেবে বন্ধু হিসেবে ব্যবহার করাটাই বেশি যৌক্তিক। প্রযুক্তির সহায়তায় পাঠ্যাভ্যাসকে আরও বিস্তৃত করা যায়। যেমন – অনলাইনে লাইব্রেরি তৈরি, অডিওবুক অ্যাপ, পাঠ প্রতিযোগিতার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তৈরি ইত্যাদি উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
বই দিবসে করণীয়
বিশ্ব বই দিবসে ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সমাজকে কিছু কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত, যেমন:
* একটি বই উপহার দেওয়া – কোনো প্রিয়জনকে বই উপহার দিন।
* পাঠচক্র আয়োজন – বন্ধু বা সহকর্মীদের নিয়ে সপ্তাহে একবার পাঠচক্রের আয়োজন করুন।
* বই বিনিময় কর্মসূচি – পুরাতন বই বিনিময়ের মাধ্যমে নতুন পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলা যায়।
* শিশুদের পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলা – ছোটবেলা থেকেই বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হবে।
* পাঠাগার ভ্রমণ ও বই কেনার দিন হিসেবে পালন – এই দিনে অন্তত একটি বই কিনুন বা লাইব্রেরি থেকে ধার নিন।
ভবিষ্যৎ ভাবনা
যখন একটি জাতি পড়ে, তখন সে গড়ে ওঠে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনে বইয়ের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিশ্ব বই দিবসকে ঘিরে আমাদের ভাবতে হবে কীভাবে মানুষকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করা যায়। শুধু শহরেই নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, গ্রামীণ স্কুলে, পথশিশুদের মাঝেও বই পৌঁছে দিতে হবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, তরুণদের স্বেচ্ছাসেবী অংশগ্রহণ এবং প্রিন্ট ও ডিজিটাল মাধ্যমের সমন্বয় জরুরি।
পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ব বই দিবস হলো একটি অনন্য উদ্যোগ, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বইয়ের অসীম শক্তির কথা। প্রযুক্তি যতই এগিয়ে যাক, বই তার গুরুত্ব হারাবে না। বরং বই-ই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নতুন যুগের দরজা খুলে দেবে। একজন পাঠক সমাজের জন্য আশীর্বাদ, আর একজন লেখক ভবিষ্যৎ নির্মাতা। এই বই দিবসে আমাদের শপথ হোক — আমরা আরও বই পড়ব, অন্যদের বই পড়তে উৎসাহ দেব, এবং একটি আলোকিত সমাজ গঠনে বইকে সঙ্গী করব।
লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।