প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ: ইতিহাস, প্রেক্ষাপট ও প্রভাব
২০২৫ মে ১০ ১৭:২৪:৩৩
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব ও বিরোধের ইতিহাসে একাধিকবার সরাসরি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। এ দুটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুধুমাত্র সীমান্ত সমস্যার প্রতিফলন নয়, বরং ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে সংঘটিত। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের মাধ্যমে এই দুই দেশের জন্ম হলেও, তাদের সম্পর্ক শুরু থেকেই উত্তেজনাপূর্ণ। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত তারা মোট চারটি প্রধান যুদ্ধ করেছে—১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯ সালে।
১৯৪৭ সালের কাশ্মীর যুদ্ধ (প্রথম ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ)
ভারত ও পাকিস্তানের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে, যা কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে। ব্রিটিশ ভারতের বিভাজনের সময় কাশ্মীর ছিল একটি স্বাধীন রাজ্য, যার অধিপতি ছিলেন হিন্দু রাজা হরি সিং। তিনি পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তান সমর্থিত উপজাতীয়রা কাশ্মীর আক্রমণ করলে রাজা হরি সিং ভারত সরকারের কাছে সহায়তা চান। ভারত কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার শর্তে সামরিক সহায়তা দেয়। ফলে শুরু হয় যুদ্ধ।
এই যুদ্ধ ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে শেষ হয় এবং নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control - LoC) নির্ধারিত হয়, যা এখনো কাশ্মীরকে বিভক্ত করে রেখেছে। তবে কাশ্মীরের মালিকানা প্রশ্ন আজও বিবাদমান।
১৯৬৫ সালের যুদ্ধ
এই যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল কাশ্মীর। পাকিস্তান মনে করেছিল, ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর ভারত দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ নামক একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে কাশ্মীর দখলের চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনারা কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ করলে ভারত পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং পূর্ণমাত্রায় যুদ্ধ শুরু হয়।
যুদ্ধটি ছড়িয়ে পড়ে পাঞ্জাব, রাজস্থান, জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলে। এক মাস স্থায়ী এই যুদ্ধ ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয়। তাসখন্দ চুক্তি ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। যদিও এই যুদ্ধ কোনো পক্ষের সুস্পষ্ট বিজয় নিশ্চিত করতে পারেনি, তবুও ভারতের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা ও ঐক্য প্রদর্শনের একটি উদাহরণ হয়ে রইল।
১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ সালের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সরাসরি পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে শুরু হলেও ভারতের ভূমিকাই যুদ্ধের গতিপথ পাল্টে দেয়।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করেন। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিলে ভারত ব্যাপক মানবিক ও সামরিক চাপে পড়ে।
ভারত ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। মাত্র ১৩ দিনের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধারা যৌথভাবে ঢাকায় প্রবেশ করে এবং পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি ৯৩,০০০ সেনার সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করেন। এর ফলে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ
১৯৯৯ সালে ভারতের কারগিল অঞ্চলে পাকিস্তান-সমর্থিত অনুপ্রবেশকারীরা ভারতীয় অবস্থানে হামলা করে। এই যুদ্ধ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের সবচেয়ে বিতর্কিত পর্বগুলোর একটি, কারণ এটি লাহোর ঘোষণা স্বাক্ষরের মাত্র কয়েক মাস পরে সংঘটিত হয়েছিল, যেখানে শান্তির অঙ্গীকার করা হয়েছিল।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট এবং কাশ্মীরি বিদ্রোহীরা কারগিলের চূড়াগুলো দখল করে। ভারতের সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে ধীরে ধীরে এইসব এলাকা পুনর্দখল করে। আন্তর্জাতিক মহল বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ পাকিস্তানকে চূড়ান্তভাবে চাপ দেয় অনুপ্রবেশকারীদের ফিরিয়ে নিতে। যুদ্ধটি শেষ পর্যন্ত ভারতের সামরিক ও কূটনৈতিক বিজয়ে পরিণত হয়। আর ২০২৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক চরম উত্তেজনার দিকে মোড় নিয়েছে, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুতর সামরিক সংঘর্ষে রূপ নিয়েছে।
সংঘর্ষের সূচনা
২০২৫ সালের ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগামে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের অধিকাংশই হিন্দু পর্যটক। ভারত এই হামলার জন্য পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বা ও তাদের সহযোগী দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্টকে দায়ী করে। পাকিস্তান এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
সামরিক প্রতিক্রিয়া ও পাল্টা হামলা
ভারত এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ৬ মে "অপারেশন সিন্দুর" নামে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, যার লক্ষ্য ছিল তথাকথিত সন্ত্রাসী ঘাঁটি। পাকিস্তান দাবি করেছে, এই হামলায় ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন।
পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান ভারতীয় যুদ্ধবিমান ও ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করেছে এবং সীমান্ত এলাকায় গোলাবর্ষণ চালিয়েছে, যাতে ১৫ জন ভারতীয় বেসামরিক নাগরিক নিহত হন।
পারমাণবিক উত্তেজনা ও আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনাকে "স্পষ্ট ও বর্তমান হুমকি" বলে অভিহিত করেছেন। উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত হওয়ায়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও জাতিসংঘ উভয় পক্ষকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে।
কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি
ভারত ও পাকিস্তান একে অপরের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক হ্রাস করেছে, সীমান্ত পারাপার বন্ধ করেছে এবং বাণিজ্যিক ও ভিসা কার্যক্রম স্থগিত করেছে। ভারত সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করেছে, যার ফলে পাকিস্তানে বন্যা ও পানির ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতি
উভয় দেশই উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে, সীমান্তে সেনা মোতায়েন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিমান চলাচল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। যুদ্ধের আশঙ্কা প্রবল হলেও, এখনও পর্যন্ত পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ শুরু হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করছে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রভাব
১. সামরিক প্রস্তুতি ও ব্যয়: যুদ্ধগুলোর ফলে উভয় দেশেই সামরিক বাজেট বেড়ে যায়। পারমাণবিক অস্ত্রের প্রতিযোগিতা শুরু হয় এবং সামরিকীকরণের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া এক উত্তপ্ত অঞ্চল হয়ে দাঁড়ায়।
২. মানবিক বিপর্যয়: প্রতিটি যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষ নিহত হন, লক্ষ লক্ষ মানুষ বাস্তুচ্যুত হন। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালে বাংলাদেশে গণহত্যা ও শরণার্থী সঙ্কট সারা বিশ্বকে নাড়া দেয়।
৩. আন্তর্জাতিক রাজনীতি: ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধগুলি আন্তর্জাতিক কূটনীতির অংশ হয়ে দাঁড়ায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব প্রতিটি যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪. কাশ্মীর সমস্যা: যুদ্ধগুলোর মূল কারণ কাশ্মীর সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান না হওয়া। আজও কাশ্মীর নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজমান।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ও সম্ভাব্য সমাধান
বর্তমানে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র। কোনো সরাসরি যুদ্ধ পুরো অঞ্চলকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই এখন আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি দুই দেশের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে।
যদিও মাঝেমধ্যেই সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং জঙ্গি হামলার পরিপ্রেক্ষিতে পাল্টা সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তবুও উভয় দেশের সাধারণ মানুষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে আগ্রহী। সাংস্কৃতিক বিনিময়, বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে ধীরে ধীরে সম্পর্ক উন্নত হতে পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ইতিহাস কেবল দুই দেশের নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এই যুদ্ধগুলো দেখিয়েছে যে শক্তি দিয়ে সমস্যার সমাধান হয় না, বরং শান্তি, সংলাপ ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমেই টেকসই সমাধান সম্ভব। ইতিহাসের শিক্ষা হলো—যুদ্ধ নয়, শান্তিই হোক দুই দেশের পথচলার মূলমন্ত্র।
লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।