ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

হীরার চেয়ে দামী, ফুলের চেয়ে নামী আজাদ রহমান

২০২৫ মে ১১ ১৭:৪৬:৫৭
হীরার চেয়ে দামী, ফুলের চেয়ে নামী আজাদ রহমান

ফাত্তাহ তানভীর রানা


‘সিধা পথে চলতে গিয়া হোছট খাইছি, সত্যি কথা কইতে গিয়া সাজা পাইছি; আমি সিধা পথে চলি না, সত্যি কথা বলি না; মিথ্যা লইয়া করি কারবার। লোকে আমায় কয় গুনাহগার’ এই নির্মম বাস্তবতাকে গানে রূপ দিয়ে মাসুদ পারভেজ পরিচালিত “গুনাহগার” সিনেমায় নিজেই গানটি গেয়ে মানুষের মুখে মুখে জনপ্রিয়তা এনে দেন কণ্ঠশিল্পী-সংগীত পরিচালক আজাদ রহমান। “মাসুদ রানা” সিনেমায় তিনি, মনের রঙে বনের ঘুম ভাঙিয়ে সাগর পাহাড়কে দিয়ে কথা বলান। তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী কণ্ঠশিল্পী সেলিনা আজাদকে দিয়ে এই গান করান। উল্লেখ্য তিনি এই গানটির গীতিকারও বটে।

তৎকালীন সমাজবাবস্থা ছিল রক্ষণশীল। নানান প্রতিকূলতা জয় করে আজাদ রহমান রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খেয়ালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তিনি ধূপদী-খেয়াল ছাড়াও টপ্পা গান, কীর্তন, তুমরি’র ও চর্চা করেন। এছাড়াও কাওয়ালি, রবীন্দ্র সঙ্গীত, ফোক গান, পঞ্চকবির গানও শিখেছেন। আজাদ রহমান পিয়ানো বাজানো থেকে শুরু করে সঙ্গীতের সকল শাখায় সমভাবে বিচরণ করেন। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা আজাদ রহমান ১৯৪৪ সালে ১ জানুয়ারী তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেন।

আজাদ রহমান বাংলাদেশের অনেক চলচ্চিত্রেই সঙ্গীত আয়োজনের কাজ সম্পাদন করেছেন। এর মধ্যে মাসুদ রানা, এপার ওপার, দস্যু বনহুর, বাদী থেকে বেগম, গুনাহগার, যাদুর বাঁশি, কুয়াশা, আমার সংসার, অনন্ত প্রেম, ডুমুরের ফুল, মতিমহল, রাজবাড়ী, আগুন, মায়ার বাঁধন, তুফান, পাগলা রাজা, আমার সংসার, নতুনবউ, দি ফাদার, খোকন সোনা, দেশপ্রেমিক উল্লেখযোগ্য। আজাদ রহমান যদি শুধু নিয়মিত গায়ক হতেন, তবে বাংলাদেশের প্রথম সারির অন্যতম গায়ক হতেন। তা‘ তাঁর এপার ওপার, চাঁদাবাজ, গুনাহগার, ডুমুরের ফুল সিনেমাসহ অন্যান্য সিনেমায় গাওয়া গান শুনলেই বোঝা যায়। কিন্তু সৃষ্টির নেশা তাঁকে করেছে সুরকার-সঙ্গীত পরিচালক; বাংলা খেয়ালের প্রবর্তক। আজাদ রহমান বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত দুই খন্ডের সংগীত বিষয়ক পুস্তক ‘বাংলা খেয়াল’ গ্রন্থেরও প্রণেতা। আজাদ রহমান প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ‘গোপন কথা‘ নামের একটি চলচ্চিত্ৰ নির্মাণ করেন। পরিবার পরিকল্পনা ও নারী স্বাস্থ্য নিয়ে নির্মিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন সোহেলরানা ও কবরী।

আজাদ রহমান উচাঙ্গ সংগীতের সাথে বাংলা গানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন; তবলা, হারমোনিয়ামের সাথে গিটারের সমন্বয় করেছেন দারুণভাবে। আজাদ রহমানের গানে এক ধরনের নিজস্বতা রয়েছে। তাঁর গানের শিল্পী নির্বাচনে তিনি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতেন। যে গান যাঁর গলায় মানাতো তাকে দিয়েই তিনি গাওয়াতেন। ১৯৬৩ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে আজাদ রহমান শকুন্তলা অবলম্বনে নির্মিত “মিস প্রিয়ংবদা” নামের কলকাতার একটি সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করার মধ্যে দিয়ে চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা শুরু করেন। এই সিনেমায় বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দেন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখার্জি, প্রতিমা বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ বিখ্যাত কণ্ঠ শিল্পীরা। আজাদ রহমান ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশের (পূর্ব পাকিস্থান) বাবুল চৌধুরী পরিচালিত “আগন্তুক” ছায়াছবিতে প্রথম গানে সুর আরোপ করেন। এছাড়াও “জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো“ এই দেশের গানের সুর করেন প্রখ্যাত সুরকার আজাদ রহমান।

বাংলা খেয়ালের জনক আজাদ রহমান ১৯৭৭ সালে আব্দুল লতিফ বাচ্চু পরিচালিত “জাদুর বাঁশি” সিনেমায় শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এরপর ১৯৯৩ সালে তিনি কাজী হায়াৎ পরিচালিত “চাঁদাবাজ” সিনেমায় শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ গায়ক হিসেবেও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। এছাড়াও তাঁর লেখা, সুরারোপিত এবং সঙ্গীত পরিচালনায় গানগুলো দর্শকপ্রিয়তা পায়। তিনি ২০১৬ সালে সংস্কৃতি কেন্দ্র আজীবন সম্মাননা পুরস্কার লাভ করেন। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ক্ল্যাসিক সুরকার আজাদ রহমান নব্বইয়ের দশকের মাঝা-মাঝি থেকে আড়ালে চলে যান। এরপর তাঁর কোনো গান আর দর্শক সিনেমায় খুব একটা উপভোগ করতে পারেননি।

আজাদ রহমান আমৃত্যু সংগীতের সাধনাই করেছেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফিরে আজাদ রহমান শিক্ষকতা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে, অধ্যক্ষ ছিলেন সরকারি সঙ্গীত কলেজে, মহাপরিচালক ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। আজাদ রহমান বলতেন, “সঙ্গীত হলো সমুদ্রের মতন; সঙ্গীত দিয়ে-প্রেম দিয়ে মানবতার কাছে যেতে চাই।” অশোক ঘোষ পরিচালিত “তুফান” সিনেমায় খুরশীদ আলম ও রুনা লায়লা আজাদ রহমানের সুরে গাইলেন ”হীরার চেয়ে দামী, ফুলের চেয়ে নামী আমার নুরজাহান!” আমি বলবো, হীরার চেয়ে দামী, ফুলের চেয়ে নামী আমার আজাদ রহমান!

গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, চলচ্চিত্র পরিচালক আজাদ রহমান। এতো পরিচয়ে সফল সংগীতজ্ঞ আর আছে কি বাংলাদেশে আছে? শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের এই গুণী ব্যক্তিত্ব ১৬ মে, ২০২০ আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমান পরপাড়ে। তাঁর মৃত্যুর পাঁচ বছর পূর্ণ হল। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের সংগীতে অসমান্তরাল ও অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

লেখক: ব্যাংকার ও গল্পকার।