ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

তরুণদের রাজনীতি : আমরা কেন পিছিয়ে থাকব?

২০২৫ মে ১৩ ১৭:৩৯:২০
তরুণদের রাজনীতি : আমরা কেন পিছিয়ে থাকব?

মীর আব্দুর আলীম


বিশ্ব রাজনীতির চেহারা বদলে যাচ্ছে। একে একে ক্ষমতার শীর্ষে উঠছেন তরুণ নেতারা। বিশ্বজুড়ে তরুণ নেতৃত্বের সাফল্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় আরও বড় এক প্রশ্ন তুলে দেয়-আমরা কেন পিছিয়ে থাকব? ফিনল্যান্ডের সানা মারিন, নিউজিল্যান্ডের জাসিন্ডা আরডার্ন, ইউক্রেনের ভলোদিমির জেলেনস্কি, ফ্রান্সের ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ—তারা সবাই তরুণ বয়সে নেতৃত্বের আসনে বসেছেন, এবং বিশ্ব রাজনীতির গতিপথে তাদের সৃষ্টি করেছে নতুন এক ধারা। তরুণরা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য নয়, তারা সমাজের বাস্তবতাকে আরও মানবিক, আধুনিক, পরিবেশবান্ধব এবং গণমুখী করে তুলেছে। তাদের নেতৃত্বে রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে কার্যকর, মেধাবী এবং যুগোপযোগী। তাদের নেতৃত্বের মধ্যে মেলে এমন এক দৃঢ়তা, যা একদিকে যেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, তেমনি আরেকদিকে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে।

বাংলাদেশের ইতিহাসও তার সাক্ষী—যখনই রাষ্ট্র ও সমাজের ভিত কাঁপানোর প্রয়োজন হয়েছে, তরুণদের সাহসী পদক্ষেপেই এসেছে পরিবর্তন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদ সালাম, রফিক, বরকত—এরা ছিলেন তরুণ, মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং প্রধান সেনানীও তরুণেরা ছিলেন। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের প্রধান শক্তি ছিল ছাত্ররা। তাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল জনসাধারণের আন্দোলন, যা ক্ষমতাসীন শাসককে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে শাহবাগ আন্দোলন, কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন—এসব ক্ষেত্রেও তরুণরা ছিল অগ্রণী। তারা শুধু প্রতিবাদ করেনি, যুক্তি ও প্রস্তাব নিয়ে এসেছে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি। তাদের এই সাহসিকতা ও উদ্ভাবনী ভাবনা আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিশাল প্রশ্ন তুলছে—কেন তরুণদের নিয়ে রাজনীতি হবে না?

তবুও, একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। এক দিকে, তরুণদের আগ্রহ রাজনীতি থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাচ্ছে, আর অন্য দিকে, মূলধারার রাজনীতি হয়ে উঠছে একান্তই অভিজ্ঞদের ‘ক্লোজড সার্কেল’। এই সার্কেলে তরুণদের জন্য আর কোনও স্থান নেই। তারা রাজনৈতিক দলের অন্তর্গত পদে নির্বাচিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে না। রাজনীতি হয়ে উঠেছে ‘দুর্নীতি’, ‘হিংসা’, ‘অসততা’—এমন এক খোলসের মধ্যে আবদ্ধ। তরুণরা মনে করছে, রাজনীতি এখন এমন একটি খেলা, যেখানে শুধুই স্বার্থের আদান-প্রদান হয়, জনগণের প্রয়োজনে কাজ করার সুযোগ নেই। একে কেন্দ্র করেই তরুণরা রাজনীতিকে দূরে ঠেলে দিয়েছে।

এই পরিস্থিতি সত্যিই দুঃখজনক এবং বিপজ্জনক। কারণ, যখন সমাজের ভালো মানুষ রাজনীতি থেকে পিছিয়ে যায়, তখন খারাপ মানুষদের হাতে চলে যায় দেশের ভবিষ্যত। আমাদের সবচেয়ে উজ্জ্বল এবং উদ্যমী তরুণরা যদি রাজনীতির মূল ধারায় না আসে, তবে রাষ্ট্রের পরিচালনা হবে এক ধরনের ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীর হাতে, যাদের কাছে গণমানুষের চাহিদা বা আশা-আকাঙ্ক্ষা কেবল একটি সরঞ্জাম হয়ে দাঁড়াবে। এই অবস্থার পরিবর্তন না হলে, দেশের ভবিষ্যত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, কারণ রাজনীতি হবে কেবল একটি ক্লাসিক্যাল ‘অধিকার’ প্রতিষ্ঠার খেলা, যেখানে তরুণদের উদ্ভাবনীর তাগিদ থাকবে না।

তবে, এই অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব এবং প্রয়োজন। যদি সত্যিই দেশের রাজনীতিকে তরুণদের হাতে তুলে দেওয়া হয়, তাহলে সেই রাজনীতি হবে আরও কার্যকর, মানবিক, আধুনিক এবং সবার জন্য উন্মুক্ত। সেই জন্য দরকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন, যা আমাদের রাজনৈতিক কাঠামোতে আমূল প্রভাব ফেলতে পারে।

তরুণদের জন্য রাজনীতির পথ খুলে দেওয়া: প্রস্তাবনা ও উদ্যোগ

প্রথমত, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তরুণদের জন্য স্থান সংরক্ষণ করা জরুরি। বর্তমান কাঠামোতে রাজনৈতিক দলে প্রবেশের সুযোগ সীমিত, বিশেষত তরুণদের জন্য। দলগুলোকে তরুণদের জন্য নির্দিষ্ট কোটার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তরুণরা তাদের সম্ভাবনা ও চিন্তা-চেতনার বাস্তব প্রয়োগ করতে পারে। তবে কেবল কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবভাবে তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও নেতৃত্বের পদ্ধতি তরুণদের জন্য আরও উন্মুক্ত হতে হবে। এবং এই কোটাব্যবস্থার মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলো তরুণদের যে পর্যায়ের নেতৃত্বে আসতে হবে, তার জন্য তাদের প্রস্তুত করতে হবে। তবেই তারা যেন সঠিকভাবে দেশের উন্নয়ন এবং গণতান্ত্রিক কাঠামো রক্ষার জন্য কাজ করতে পারে।

দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক শিক্ষার উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই তরুণদের নাগরিক শিক্ষা ও নৈতিক নেতৃত্বের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ‘লিডারশিপ প্রোগ্রাম’, ‘ইয়ুথ পার্লামেন্ট’, ‘ডেমোক্রেসি ক্যাম্প’—এমন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে তরুণরা রাজনৈতিক সচেতনতা অর্জন করবে। তাঁদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যাতে তারা রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে প্রস্তুত হতে পারে। শুধু পাঠ্যপুস্তক দিয়ে নয়, তাদের বাস্তব জীবনেও নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে, যা তাদের নিজেদের সমাজে কার্যকরভাবে পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে।

তৃতীয়ত, সহনশীল রাজনৈতিক পরিবেশ গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। আজকের তরুণরা সংঘাতমুখী নয়, তারা সহমত ও সমঝোতার রাজনীতি চায়। তাদের সঙ্গে পুরো রাজনৈতিক পরিবেশের বদল দরকার। রাজনীতির মাঠে এখনো বিরাজমান অপবাদ, প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের রাজনীতি আজকের তরুণদের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক। যদি তারা রাজনীতিতে প্রবেশ করে এবং এই দৃষ্টিভঙ্গি তাদের সামনে আসে, তাহলে তারা হতাশ হয়ে ফিরে যাবে। তাই, রাজনৈতিক দলের মধ্যে সহনশীলতা ও সহযোগিতার মনোভাবের বিকাশ ঘটানো উচিত। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শত্রু নয়, সহযোদ্ধা মনে করে দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করার মনোভাব তৈরি করতে হবে।

চতুর্থত, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা তরুণদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে পারে। নেতিবাচক রাজনীতির পরিবর্তে, তরুণদের সফল নেতৃত্বের গল্প প্রচার করতে হবে। সামাজিক মাধ্যমে তরুণদের সফলতা তুলে ধরা, তাঁদের রাজনৈতিক ভূমিকা, নতুন ধারণার প্রয়োগ—এগুলোই তাঁদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে। এটি শুধু তরুণদের উদ্দীপিত করবে না, বরং রাজনীতির প্রতি তাদের ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করবে। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হচ্ছে নেতিবাচক এবং হিংসামূলক রাজনীতি থেকে সরে গিয়ে তরুণদের সমাজ পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গির কাহিনিগুলি তুলে ধরা। যখন তরুণরা দেখবে যে অন্যরা সামাজিক বদল আনতে সক্ষম হয়েছে, তখন তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আশার আলো জ্বলবে।

একটি অন্য বড় প্রতিবন্ধকতা হলো পারিবারিক মানসিকতা। আমাদের সমাজে আজও রাজনীতি ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বা ‘নোংরা’ পেশা হিসেবে দেখা হয়। বাবা-মায়ের প্রথম চাওয়া থাকে যে তাদের সন্তান ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা বিসিএস ক্যাডার হোক, কিন্তু রাজনৈতিক নেতা নয়। সমাজের এই ভুল ধারণা ভাঙতে হবে। রাজনীতি যদি ভালো মানুষের হাতে থাকে, তবে তা হবে এক সম্মানজনক পেশা, এবং তরুণদের সেই রাজনীতির অংশ হতে উৎসাহিত করতে হবে। তাছাড়া, পারিবারিক মানসিকতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি, যাতে তরুণেরা রাজনীতির প্রতি তাদের আগ্রহ এবং আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে পারে।

এছাড়া, বিকেন্দ্রীকৃত রাজনৈতিক কাঠামো তৈরির মাধ্যমে তরুণদের তৃণমূল পর্যায়ে নেতৃত্বের সুযোগ দিতে হবে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়াতে স্বচ্ছতা এবং অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। তারা যেন স্থানীয় সরকারের পদগুলোতে আসতে পারে এবং তাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

তরুণদের হাতে রাজনীতির হাল দিলে তা হবে গণমুখী, মানবিক এবং অগ্রগতিমুখী। কারণ, তরুণরা স্বপ্ন দেখে, সাহস করে, এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করে। তাদের শক্তিকে অবজ্ঞা নয়, স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের নেতৃত্বেই গড়বে নতুন বাংলাদেশের দিগন্ত।

বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, তরুণ নেতৃত্বে সামাজিক ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারী অধিকার—এসব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের তরুণ ভোটারদের সংখ্যাও ৪ কোটি—যারা আগামীর নেতৃত্বে ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত। অতএব, তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পথ সুগম করতে হলে একমাত্র আহ্বান নয়, ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পরিবার এবং গণমাধ্যম—সবার সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমেই এই পরিবর্তন সম্ভব।

লেখক: চেয়ারম্যান-আল-রাফি হাসপাতাল লিমিটেড, সাংবাদিক, জীবনমুখী লেখক, কলামিস্ট।