ঢাকা, শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের নামে দমন-পীড়নের নতুন বন্দোবস্ত

২০২৫ মে ১৩ ১৭:৫৪:৫৯
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের নামে দমন-পীড়নের নতুন বন্দোবস্ত

মারুফ হাসান ভূঞা


প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের অবৈধ নীতি তৈরি করে, যে ধরনের অপরাজনীতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষ করে সেটি সবচেয়ে ভয়ংকর। দলীয় রাজনীতি করবে কি করবে না সেটা বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন কিংবা নিষিদ্ধ কোনোটাই করাবার ইখতিয়ার রাখে না। একজন শিক্ষার্থীর গণতান্ত্রিক অধিকার ও নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে রাজনীতি করার। আপনারা নৈতিক ভাবে ভেবে দেখুন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ফি, টিউশন ফি,লেইট ফি, কোর্স, বিল্ডিং স্ট্রাকচার পর্যন্ত রাজনৈতিক। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক রাজনৈতিক, গভর্নিং বডি রাজনৈতিক, প্রশাসন রাজনৈতিক। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির অনুমোদন বা নিষিদ্ধ সে আপনার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ? একেবারেই না।

বরং সে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ নীতি তৈরি করে। কারণ সে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতির সুযোগ করে দিতে, ক্ষমতাসীনদের দখলদারিত্বকে অনুমোদন করে দিতে। নিজের দাখলদারিত্ব নিশ্চিত করতে, অন্যায্য টিউশন ফি, শিক্ষার্থীদের শোষণকে জারি রাখতে। গণতান্ত্রিক আন্দোলন, নৈতিক আন্দোলন, বিশেষ করে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের সংকট, সমস্যা নিয়ে কথা বলবার অধিকারকে হরণ করার জন্য এসব অবৈধ নীতিমালা তৈরি করে। আপনি কি মনে করেন এই নীতিমালা ক্ষমতাসীন দলের কোনো ছাত্র সংগঠনের জন্য সে ব্যবহার করবে? করবে না। কারণ তাঁর কাজেই তো ক্ষমতাসীনদের দখলদারিত্ব-সন্ত্রাসে সহযোগিতা করা। নিজেও সে অনধিকার চর্চায় লিপ্ত হওয়া। স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলেও তো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল, কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের রাজনীতি ছিল না?

আলবাত ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় গুলো শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি সহ একগাদা ফি ও শিক্ষার্থী বিরোধী নানা কর্মকাণ্ড যুক্ত ছিল, সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিরোধিতা করলে সেখানে ছাত্রলীগ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাঁধা দিয়েছে, হামলা করেছে। পাশাপাশি ছাত্রলীগের সরাসরি শিক্ষার্থী নির্যাতন তো ছিলই। বরং সাধারণ শিক্ষার্থীদের এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করাও কষ্টসাধ্য ছিল। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের রাজনীতির বিরুদ্ধে কথা বলেছে তাকেই বহিষ্কার, জরিমানা, সাময়িক ছাত্রত্ব বাতিল করেছে “ রাজনীতি নিষিদ্ধ ” এই নীতিতে। রাজনীতি নিষিদ্ধ করলে ক্ষমতাসীনদের রাজনীতিই সহজ হয়।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। একটা রাজনৈতিক দলের অবৈধ শাসন, স্বৈরাচারী, ফ্যাসিবাদী শাসনকে উৎখাত করেছে, এই উৎখাত করার লড়াই সঠিক রাজনীতি, সঠিক রাজনৈতিক সচেতনতা। তাই রাজনৈতিক চর্চায় যদি বন্ধ করে দেন তাহলে সঠিক রাজনীতি হারিয়ে যাবে, শোষণ নিপীড়নের রাজনীতি, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার রাজনীতি বিস্তৃত হবে। আপনাকে শোষণ নিপীড়নের রাজনীতি, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার রাজনীতি আবদ্ধ করে রাখবে, শোষণ করবে, নিপীড়ন করবে, অত্যাচার করবে, মুখ তালাবদ্ধ করে রাখবে।

❝ অ্যাসোসিয়েশন অফ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিজ অব বাংলাদেশ (এপিইউবি) এবং বাংলাদেশ সোসাইটি ফর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি একাডেমিকস্ (বিএসপিইউএ) এর যৌথ উদ্যোগে সোমবার ১২ মে ২০২৪ ‘বর্তমান প্রেক্ষাপটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ আছে। বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীদের বহুমাত্রিক দাবি পূরণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। এর থেকে উত্তরণের জন্য বিকল্প সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। ❞

এই যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকপক্ষের নতুন ষড়যন্ত্রের আয়োজন লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে। সে ষড়যন্ত্র হলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক পক্ষের লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি নির্মাণ করবার প্রয়াস। অর্থাৎ যে লেজুড়বৃত্তি টিউশন ফি বাড়াবে, যে লেজুড়বৃত্তি দুর্নীতি করবে, যে লেজুড়বৃত্তি লুটপাট করবে, যে লেজুড়বৃত্তি টাকা যার শিক্ষা তার নীতি নির্মাণ করবে, যে লেজুড়বৃত্তি ছাত্রদের পক্ষে কথা বলবে না, যে লেজুড়বৃত্তি শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বাঁধা দিবে, যে লেজুড়বৃত্তি শিক্ষার্থীদের কণ্ঠ রুদ্ধ করবে, যে লেজুড়বৃত্তি সন্ত্রাস - দখলদারিত্বকে টিকিয়ে রাখবে, যে লেজুড়বৃত্তি ক্ষমতাসীনদের রাজনীতি করবে সে “মালিকি লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি” চাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক পক্ষ।

জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়েও আমরা স্পষ্টত দেখেছি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দাবি তুলেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, গভর্নিং বডি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাসিবাদী কাঠামো ভাঙার আওয়াজ উঠিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অবাধ টিউশন ফি ও তা দিতে বাধ্য করবার নির্যাতনে বছর বছর শিক্ষার্থী আত্মহত্যা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এখনো অহরহ খবর শুনা যায় টিউশন ফি এর কারণে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা। এছাড়া পরিবহণ সংকট, গ্রেডিং পদ্ধতি, অভিন্ন টিউশন ফি, মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ, গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন দাবিসহ শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ ক্যাম্পাসের পরিবেশ ভিত্তিক যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করেছে শিক্ষার্থীরা।আন্দোলন দমনে মালিক পক্ষ শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হয়রানি করেছে। এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। বরং শিক্ষার্থীদের ছাত্রত্ব বাতিল করেছে, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের হুমকি ও প্রলোভন দেখিয়ে আন্দোলন দমিয়েছে। কোথাও কোথাও অবিভাবকদেরও হুমকি দিতে ছাড়েননি। বিশ্ববিদ্যালয় এক নোটিশে বন্ধ করে দিয়েছে। এরপরও না ফেরে ওয়েবারের প্রলোভন দেখিয়ে পালটা শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দিয়েছেন। অথচ এসব শিক্ষার্থীরা গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকালেও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর একই প্রক্রিয়ায় দমন-পীড়ন, অত্যাচারের স্বীকার হতে হয়েছে।

এই সকল কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকরা ছাত্র রাজনীতির নিষিদ্ধের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এই মালিকরা যদি এতই সৎ হতো ছাত্রলীগের সন্ত্রাস - দখলদারিত্বের ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করেনি কেন? এরা কখনো সন্ত্রাস - দখলদারিত্বের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে না, করবেও না। এরা গণতান্ত্রিক মত, গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষার্থীদের পক্ষের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে এবং এটাই করবে। কখনোই ক্ষমতাসীন দখলদারিত্বের ছাত্রা রাজনীতি নিষিদ্ধ করবে না, করতে পারবে না।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক ছাত্র রাজনীতির চর্চার জন্য উন্মুক্ত করতে হবে। লেজুড়বৃত্তি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ আর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ একই বচন। আর এই সিদ্ধান্তও ফ্যাসিবাদী সিদ্ধান্ত।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক পক্ষের মনে রাখা উচিত ও জরুরি সন্ত্রাস - দখলদারিত্বের বিপরীতে দীর্ঘদিন যে-সকল ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রাজনীতি করেছে, নির্যাতন, নিপীড়নের স্বীকার হতে হয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন সংগঠন ছাত্রলীগের হাতে। তারচেয়ে একধাপ অতিক্রম করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর মালিক পক্ষ ছাত্রলীগের দখলদারিত্বের সুযোগ দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও ভিন্ন রাজনৈতিক মত দমনে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফ্যাসিবাদী কাঠামো নির্মাণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে। যখন খুশি বহিষ্কার, যখন খুশি কারণ দর্শানোর নোটিশ, যখন খুশি জরিমানা, অবিভাবকদের ডেকে এনে অপমান- অপদস্থ করা, কোথাও কোথাও এমন হয়েছে পুলিশের হাতে তুলে দিতো গণতান্ত্রিক মত প্রকাশের কারণে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কর্তৃক ২০১৫ সালে ভ্যাট বিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানসহ বহু আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ফ্যাসিবাদী প্রক্রিয়া নিপীড়ন করেছে, যেখানে ব্যর্থ হয়েছে ছাত্রলীগ দিয়েও নিপীড়ন করিয়েছিল। সেই ইতিহাস পত্রিকার পুরানো পাতা গুলোতে জমে আছে।

ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে কেবল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের আধিপত্য, সন্ত্রাস, দখলদারিত্ব চাই না। শিক্ষার্থীরা চাই নিয়েমিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন, শিক্ষার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পরিবেশ। যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও পরিবেশে শিক্ষার্থীরা সুস্থ ছাত্র রাজনীতির চর্চা করবে। মুক্ত মত, ভিন্নমতের চর্চা করবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলবে, মানবতা, মনুষ্যত্ব, মূল্যবোধের চর্চা ও লড়াই করবে। দেশের প্রয়োজনে যেন লড়াই জারি রাখতে পারে সে চর্চা করবে।

কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক পক্ষ সেটা চাই না,বিশ্ববিদ্যালয় মালিক পক্ষ চাই__ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের একক আধিপত্য কিংবা ক্ষমতাসীনদের আধিপত্য সে আধিপত্যের সংযুক্ততাই মালিকপক্ষের একক আধিপত্য দুর্নীতি, লুটপাট ও শিক্ষার্থীদের উপর অর্থনৈতিক শোষণ জারি রাখা।

লেখক : লেখক ও প্রাবন্ধিক।