প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত
পারিবারিক বন্ধনের মানসিক ও সামাজিক গুরুত্ব
২০২৫ মে ১৪ ১৭:৫২:২৬
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
পরিবার একটি সমাজের মৌলিক একক। মানব সভ্যতার ইতিহাসে পরিবারই প্রথম সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। মানুষের জন্ম, বিকাশ, শিক্ষা ও মূল্যবোধের শেকড় এ পরিবারেই প্রোথিত। প্রতি বছর ১৫ মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস পালিত হয় জাতিসংঘের আহ্বানে। এই দিনটি পালনের উদ্দেশ্য হলো পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্ব তুলে ধরা, পারিবারিক জীবনে উদ্ভূত সমস্যাগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং পরিবারে ইতিবাচক পরিবেশ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো।
আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসের ইতিহাস ও পটভূমি
১৯৯৩ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এক প্রস্তাবনার মাধ্যমে ১৫ মে তারিখটিকে "আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস" হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯৪ সাল থেকে এই দিনটি বিশ্বব্যাপী পালন শুরু হয়। এর পেছনে উদ্দেশ্য ছিল আধুনিক সমাজব্যবস্থায় পরিবার নামক গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটটি যেসব সামাজিক, অর্থনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করা।
জাতিসংঘ মনে করে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনের ক্ষেত্রে পরিবার একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখে। পরিবারে শিক্ষার প্রসার, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, শিশুর নিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষা—এই সবকিছুর ভিত্তি গড়ে ওঠে পারিবারিক কাঠামোর ওপর।
পরিবারের রূপান্তর ও আধুনিক পরিবর্তন
আধুনিক যুগে বৈশ্বিকীকরণ, নগরায়ন, অর্থনৈতিক পরিবর্তন, অভিবাসন, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ইত্যাদি কারণে পরিবার কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আগে যেখানে যৌথ পরিবার ছিল প্রচলিত, এখন তার স্থান নিচ্ছে একক পরিবার। কর্মজীবী নারী ও পুরুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সন্তান প্রতিপালনেও পরিবর্তন এসেছে।
বহু দেশে এখন ‘সিঙ্গেল প্যারেন্ট’ পরিবার, ‘চাইল্ডলেস কাপল’, সমলিঙ্গ দম্পতি ইত্যাদি পরিবার কাঠামোর উদ্ভব ঘটেছে। এসব পরিবর্তন সমাজে পারিবারিক সংহতির নতুন সংজ্ঞা এনে দিয়েছে। পরিবার এখন শুধু রক্তের বন্ধন নয়, বরং ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও সহানুভূতির সম্পর্কেও পরিণত হয়েছে।
পারিবারিক বন্ধনের সামাজিক ও মানসিক গুরুত্ব
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। কিন্তু এই সমাজে তার প্রথম পরিচয়, প্রথম শিক্ষা ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের সূচনা ঘটে পরিবারে। একটি সুস্থ ও পরিপূর্ণ পরিবার একটি মানুষের জীবনে আত্মবিশ্বাস, নৈতিকতা, সহনশীলতা ও দায়িত্ববোধ গড়ে তোলে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে পরিবার এক অনস্বীকার্য উপাদান। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশু পরিবারের আন্তরিকতা ও ভালোবাসায় বড় হয়, তারা ভবিষ্যতে আত্মবিশ্বাসী ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠে। অপরদিকে, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও সহিংসতা একটি শিশুর মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পারিবারিক পরিস্থিতি
বাংলাদেশে পরিবারকে এখনো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয়। এখনো বেশিরভাগ মানুষ পরিবারকেন্দ্রিক জীবনযাপন করে। তবে শহরাঞ্চলে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মসংস্থান, শিক্ষার জন্য দূরে যাওয়ার প্রবণতা, পারিবারিক মতবিরোধ, জীবনধারার পরিবর্তন—এসব কারণ পরিবারকে নতুনভাবে গড়ে তোলার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
নারীর কর্মজীবন, অভিভাবকদের ব্যস্ততা, শিশুদের উপর পড়া একক চাপ ইত্যাদি বিষয়গুলো বাংলাদেশের সমাজে নতুন চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। শিশুর মানসিক বিকাশ, বয়স্ক অভিভাবকদের যত্ন, দাম্পত্য জীবনের স্থিতিশীলতা—এইসব ইস্যু এখন পরিবারে আলাদাভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও সংকট
বর্তমানে পারিবারিক জীবনে যেসব চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে তা শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্তরেও প্রভাব ফেলে। যেমন:
১. পারিবারিক সহিংসতা: ঘরে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা এখনো একটি উদ্বেগজনক সমস্যা।
২. বিচ্ছেদ ও সম্পর্ক ভাঙন: বিবাহবিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
৩. জেনারেশন গ্যাপ: বয়স্কদের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে।
৪. টেকনোলজির আসক্তি: মোবাইল, টিভি ও সোশ্যাল মিডিয়া অনেক সময় পারিবারিক সময় কাটানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
৫. অভিবাসন ও বিদেশযাত্রা: একজন সদস্য বিদেশে গেলে পরিবারে সংযোগ বিচ্ছিন্নতা বাড়ে।
সমাধানের পথ
পারিবারিক সমস্যা সমাধানে সরকার, সমাজ ও পরিবার—সব পক্ষকেই একযোগে কাজ করতে হবে। নিচে কিছু সম্ভাব্য করণীয় উল্লেখ করা হলো:
* পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষা: শিশুদের শৈশব থেকে পরিবার ও সম্পর্কের গুরুত্ব শেখাতে হবে।
* সচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যমের মাধ্যমে পারিবারিক সহিংসতা ও ভাঙনের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে হবে।
* কাউন্সেলিং ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা: দাম্পত্য দ্বন্দ্ব বা পারিবারিক বিষণ্ণতায় পেশাদার কাউন্সেলিং চালু করতে হবে।
* বয়স্কদের যত্ন: পরিবারের প্রবীণ সদস্যদের জন্য আলাদা যত্ন ও সম্মান নিশ্চিত করতে হবে।
* সমবয়সীদের সংলাপ: বাবা-মা ও সন্তানদের মাঝে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়াতে পারিবারিক আলোচনা ও সময় কাটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আন্তর্জাতিক পরিবার দিবসের তাৎপর্য
এই দিবসটি শুধু একটি প্রতীকী দিন নয়, বরং এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, আমরা সবাই পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটির অংশ। পরিবার শুধু একটি ইউনিট নয়, বরং ভালোবাসা, আশ্রয়, শিক্ষা ও জীবনের পথচলার শক্তি।
আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়, সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে হলে পরিবারের ভিতকে শক্তিশালী করতে হবে। এটি একটি গ্লোবাল মেসেজ—পরিবার যদি সুখী হয়, সমাজও সুখী হবে।
আর পরিবারিক কলহ দূর করে প্রশান্তি আনয়নে স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, সন্তান-সন্তুতি সকলেরই দায়িত্ব রয়েছে;
পরিবারে স্বামীর করণীয়: * স্ত্রীকে যুক্তিসঙ্গত মোহরানা প্রদান করা।* যথাযথ ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করা।* নিরাপদ বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। * পরিবারে কাজের চাপ বেশি থাকলে সামর্থ্যানুসারে গৃহস্থ কাজে সহযোগী নিয়োগ করা।* স্ত্রীর সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ করা। * একাধিক স্ত্রী থাকলে সমতা রক্ষা করা। * স্ত্রীর মা-বাবাকে যথাযথ সম্মান প্রদান করা। * স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা। * স্ত্রীর সঙ্গে ঘরোয়া খেলাধুলা, খুনসুটি করা।* ব্যস্ততার মধ্যেও সুযোগ খুঁজে আনন্দভ্রমণের ব্যবস্থা করা।
পরিবারে স্ত্রীর করণীয়: * স্বামীর গোপনীয়তা রক্ষা করা। * স্বামীর পরিবারের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করা। * স্বামীর অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে শখের জিনিসের আবদার করা। * স্বামীর অনুপস্থিতিতে অপরিচিত কারো সাথে অপ্রয়োজনীয় কথা না বলা। * পর্দাসংক্রান্ত বিষয়ে খেয়াল রাখা। * স্বামীর অর্থ-সম্পদ বিশ্বস্ততার সাথে সংরক্ষণ করা।* নিজের সতীত্বের হেফাজত করা।* নৈতিক বিষয়ে স্বামীর প্রতি আনুগত্যশীল থাকা।* শুশুর-শাশুড়ির যত্ন নেওয়া
পরিবারে মা-বাবার দায়িত্ব
* উত্তম পন্থায় সন্তান লালন-পালন করা।
* ইসলামি মূল্যবোধের শিক্ষা দান করা।
* আচার-ব্যবহারে সন্তানদের মাঝে সমতা বিধান করা।* সত্য-মিথ্যা, হক-বাতিল সম্পর্কে অবগত করা।
* সন্তানকে সচ্চরিত্রবানরূপে গড়ে তুলা।
* সন্তানের কল্যাণের জন্য দোয়া করা।
* সন্তানেরা বিয়ের উপযুক্ত হলে বিয়ে দেওয়া, সন্তানের জীবনসঙ্গীকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসা
পরিবারে সন্তানের করণীয়:-* পরিবারের নিয়ম-কানুন মেনে চলা।* পিতা-মাতার আনুগত্য করা।* পিতা-মাতা ও অন্যান্য সদস্যের সাথে সদ্ব্যবহার করা।* বড়দের শ্রদ্ধা করা। * ছোটদেরকে স্নেহ করা।* ভাই-বোনদের মধ্যে পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় করা।* অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে পরিবারের ওপর চাপ প্রয়োগ না করা। * পরিবারকে সমাজের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয় এমন কোনো কাজে যুক্ত না হওয়া।
পরিশেষে বলতে চাই, আধুনিক জীবনের জটিলতায় অনেক সময় পরিবারকে অবহেলা করা হয়। কিন্তু যতই প্রযুক্তি বা আর্থিক উন্নতি হোক না কেন, মানব জীবনের পরিপূর্ণতা আসে ভালোবাসার সম্পর্ক থেকে। সেই সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দু হলো পরিবার।আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস আমাদের সেই মূল্যবোধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আসুন, আমরা প্রত্যেকে নিজ নিজ পরিবারকে ভালোবাসি, যত্ন নিই, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি মানবিক, সহানুভূতিশীল ও নৈতিক পরিবার গড়ে তুলি।
লেখক: সংগঠক, কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।