প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
প্রবাহ বন্ধের প্রতিবাদ: ফারাক্কা দিবসে ফিরে দেখা আন্দোলনের ইতিহাস
২০২৫ মে ১৫ ১৮:৪৮:৩৬
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৬ মে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, যাকে “ফারাক্কা লংমার্চ দিবস” হিসেবে পালন করা হয়। এ দিনটি শুধুই একটি প্রতিবাদের দিন নয়, এটি একটি জাতীয় চেতনার বহিঃপ্রকাশ, পানির ন্যায্য হিস্যা অর্জনের সংগ্রামের ইতিহাস। ফারাক্কা ব্যারেজের মাধ্যমে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহার ও এর প্রভাব বাংলাদেশের জনগণের জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন মজলুম জননেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চে, যা আজও পানি অধিকার রক্ষার এক অনন্য প্রতীক।
ফারাক্কা ব্যারেজ: পটভূমি ও সমস্যা
ভারত সরকার ১৯৬০-এর দশকে গঙ্গা নদীর ওপর ফারাক্কা ব্যারেজ নির্মাণ করে, যার লক্ষ্য ছিল হুগলি নদীতে নাব্যতা বজায় রাখা। ব্যারেজটি ১৯৭৫ সালে চালু হওয়ার পর গঙ্গা নদীর পানি একতরফাভাবে ভারতে সরিয়ে নেওয়া শুরু হয়। ফলে পদ্মা নদী ও বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পানির প্রবাহ হ্রাস পায়, সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক সংকট।বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নদীর নাব্যতা হ্রাস, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়া, কৃষি উৎপাদনে বিপর্যয় এবং মাছ ও জীববৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটে। নদী নির্ভর জীবিকা যেমন জেলেদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে।
লংমার্চ: প্রতিবাদের প্রতীক
এই সংকটের প্রতিবাদে মাওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালে ‘ফারাক্কা লংমার্চ’-এর ডাক দেন। ১৬ মে হাজার হাজার মানুষ রাজশাহীর শীর্ষপুর থেকে ফারাক্কার দিকে পদযাত্রা শুরু করে।
এটি ছিল এক শান্তিপূর্ণ কিন্তু জোরালো প্রতিবাদ। এই লংমার্চে অংশগ্রহণ করেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও সাধারণ জনগণ।লংমার্চের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ভারতের এই একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিরুদ্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরে আওয়াজ তোলে। এটি বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের পানিস্বত্বের দাবি তুলে ধরেছিল।
মাওলানা ভাসানীর অবদান
মাওলানা ভাসানী ছিলেন একজন দুরদর্শী নেতা, যিনি সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। ফারাক্কা লংমার্চ ছিল তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার উজ্জ্বল নিদর্শন।তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, এই পানি সংকট শুধুমাত্র একটি অঞ্চল বা গোষ্ঠীর সমস্যা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, পরিবেশ ও অস্তিত্বের প্রশ্ন।ভাসানীর নেতৃত্বে আন্দোলনটি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে সরকার ও আন্তর্জাতিক মহল বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিতে বাধ্য হয়।
ফারাক্কার প্রভাব: পরিবেশ ও জীবনযাত্রা
ফারাক্কা ব্যারেজ চালুর ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ভয়াবহ খরার সম্মুখীন হয়।
নদী শুকিয়ে যায়, জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হতে থাকে।
চিংড়ি ও অন্যান্য মাছের উৎপাদন হ্রাস পায়।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গিয়ে সুপেয় পানির অভাব দেখা দেয়।
কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
নদীভাঙন বাড়ে, হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
ফারাক্কা ব্যারেজ শুধু পানির অভাব নয়, বরং একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রূপ নেয় যা আজও বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে।
আন্তর্জাতিক নদী আইন ও নদী কূটনীতি
ফারাক্কা সংকট আন্তর্জাতিক নদী বণ্টন ইস্যুর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। গঙ্গা একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় নদী হওয়ায় ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে একটি ৩০ বছরের গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তবে বাস্তবতায় বহুবার ভারত চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নদী কূটনীতি নিয়ে বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় হতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক ফোরামে পানি অধিকার, ন্যায্যতা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং মানবাধিকারের দিকগুলো তুলে ধরতে হয়েছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে ফারাক্কার সমস্যা অনেকাংশে বহাল রয়েছে। গ্রীষ্ম মৌসুমে পদ্মায় পানির প্রবাহ ভয়াবহভাবে হ্রাস পায়। নতুন করে ভারতের আরও নদীতে বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের পরিকল্পনা বাংলাদেশকে উদ্বেগে ফেলেছে। বাংলাদেশের একাধিক নদী যেমন তিস্তা, মহানন্দা, দুধকুমার, ধরলা, মনু— সবই ভারত থেকে আসা আন্তর্জাতিক নদী, যেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বিপক্ষীয় টানাপড়েন রয়েছে।
নদী শুকিয়ে যাওয়া, সেচব্যবস্থায় বিঘ্ন, পরিবেশগত বিপর্যয় এবং মানুষের জীবিকা হুমকির মুখে রয়েছে।
ফারাক্কা দিবসের তাৎপর্য ও শিক্ষা
প্রতি বছর ১৬ মে ফারাক্কা লংমার্চ দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের পানি অধিকার রক্ষার সংগ্রাম স্মরণ করি।
এই দিবসটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
প্রাকৃতিক সম্পদে ন্যায্য হিস্যার গুরুত্ব,
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্কের পাশাপাশি আত্মসম্মান বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা,
জনগণের ঐক্য ও আন্দোলন কিভাবে জাতীয় ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
এটি একটি রাজনৈতিক বা কূটনৈতিক বিষয় মাত্র নয়, এটি দেশের টিকে থাকার, পরিবেশ রক্ষার ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণের বিষয়।
সমাধানের পথ ও ভবিষ্যৎ করণীয়
১. দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান খোঁজা।
২. আন্তর্জাতিক নদী কমিশন গঠন ও সমন্বয়মূলক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
৩. গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক কূটনীতি শক্তিশালী করা।
৪. সুশীল সমাজ ও জনগণকে নদী রক্ষায় সম্পৃক্ত করা।
৫. আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশন অনুযায়ী নদী ব্যবস্থাপনায় ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ।
পরিশেষে বলতে চাই,ফারাক্কা লংমার্চ ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রতিবাদ— যা শুধুমাত্র একটি বাঁধের বিরুদ্ধে ছিল না, বরং একটি দেশের জীবনের প্রবাহকে রক্ষা করার জন্য ছিল।এটি দেখিয়েছে কিভাবে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হলে, একটি প্রতিবাদ ইতিহাস হয়ে উঠতে পারে।
আজ, ফারাক্কা দিবসে আমাদের নতুন করে শপথ নিতে হবে— নদী রক্ষায়, পানি অধিকারে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের দাবিতে আমরা পিছপা হব না।মাওলানা ভাসানীর সেই পদযাত্রা আজও আমাদের পথ দেখায়— প্রতিরোধের, অধিকার আদায়ের এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষার।
লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।