ঢাকা, রবিবার, ১ জুন ২০২৫, ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

জাদুঘর শুধু প্রদর্শনী নয় জীবন্ত ইতিহাসের পাঠশালা

২০২৫ মে ১৭ ১৭:৩৮:৫৪
জাদুঘর শুধু প্রদর্শনী নয় জীবন্ত ইতিহাসের পাঠশালা

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার বিকাশে জাদুঘর এক অনন্য মাধ্যম। ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনের ক্ষেত্রে জাদুঘরের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব স্মরণে প্রতি বছর ১৮ মে বিশ্বজুড়ে পালিত হয় আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস (International Museum Day)। আন্তর্জাতিক জাদুঘর কাউন্সিল (ICOM) ১৯৭৭ সালে এই দিবসটি উদযাপন শুরু করে। দিবসটির উদ্দেশ্য হলো সমাজে জাদুঘরের ভূমিকা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং সংস্কৃতি সংরক্ষণে মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

জাদুঘরের ধারণা ও বিবর্তন

প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যেও ‘জাদুঘরসদৃশ’ ধারণা ছিল। প্রাচীন মিশরের সমাধি চেম্বারে, মেসোপটেমিয়ার রাজকীয় সংগ্রহশালায়, এবং চীনের হান সাম্রাজ্যের নথিপত্রে বিভিন্ন সংগ্রহ সংরক্ষণের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তবে আধুনিক অর্থে জাদুঘরের জন্ম ইউরোপে। ১৬৮৩ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত ‘অ্যাশমোলিয়ান মিউজিয়াম’কে প্রথম আধুনিক জাদুঘর হিসেবে ধরা হয়। ১৮ ও ১৯ শতকে শিল্পবিপ্লবের পর, নানা জাতি তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক উপাদান সংগ্রহ শুরু করে। তখন থেকেই জাদুঘর হয়ে ওঠে জাতীয় গর্ব ও ঐতিহ্যের প্রতীক।

আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের তাৎপর্য

এই দিবসটি শুধুমাত্র জাদুঘর নিয়ে উদযাপন নয়, বরং এটি একটি বার্তা বহন করে—আমরা যেন অতীতকে ভুলে না যাই এবং ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করি।

দিবসটি উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী জাদুঘরগুলোতে বিনামূল্যে প্রবেশ, বিশেষ প্রদর্শনী, শিশুদের জন্য ওয়ার্কশপ, ঐতিহ্যভিত্তিক নাটক, লেকচার সিরিজ, চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এর ফলে সমাজে সাংস্কৃতিক চেতনা জাগে এবং তরুণ প্রজন্ম ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে।

জাদুঘর: শুধুই অতীত নয়, বর্তমান ও ভবিষ্যতেরও অংশ

অনেকে মনে করেন, জাদুঘর মানেই পুরনো জিনিসের সংগ্রহশালা। কিন্তু জাদুঘর এখন কেবল অতীত নয়, বরং বর্তমান সময়ের নানা সামাজিক, রাজনৈতিক, পরিবেশগত ও বৈজ্ঞানিক বিষয়কেও উপস্থাপন করছে।

আধুনিক জাদুঘর প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল আর্কাইভ, ভার্চুয়াল ট্যুর, ইন্টার‌্যাকটিভ ডিসপ্লে ও এআই-ভিত্তিক নির্দেশনা ব্যবস্থার মাধ্যমে দর্শনার্থীরা অধিকতর আনন্দদায়ক ও শিক্ষণীয় অভিজ্ঞতা লাভ করছে। এমনকি করোনা মহামারির সময় অনেক জাদুঘর অনলাইনে তাদের প্রদর্শনী উন্মুক্ত করে বিশ্বব্যাপী দর্শকদের কাছে পৌঁছে যায়।

বাংলাদেশে জাদুঘরের গুরুত্ব ও অবস্থা

বাংলাদেশে জাদুঘরের ইতিহাস অনেক পুরনো হলেও এর আধুনিকীকরণ এখনও চলমান। বর্তমানে দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে শতাধিক জাদুঘর রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো:

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর (ঢাকা): ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। এটি দেশের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধ জাদুঘর। ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, প্রত্নতত্ত্ব, প্রকৃতি ও প্রাণিবিজ্ঞান, নৃবিজ্ঞান, চারুকলা ইত্যাদি বিভিন্ন বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত।

মহাস্থানগড় ও পাহাড়পুর প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর: বাংলাদেশের প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন তুলে ধরে।

বীরশ্রেষ্ঠ জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলো সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

লোকজ ও কারুশিল্প জাদুঘর (সোনারগাঁও): দেশের লোকজ সংস্কৃতি, বাউল জীবন, তাঁত শিল্প ও গ্রামীণ ঐতিহ্যকে তুলে ধরে।

তবে বেশিরভাগ জেলা ও উপজেলায় জাদুঘরের অভাব রয়েছে। অনেক জাদুঘর প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, জনবল ও আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে।

জাদুঘর ও শিক্ষাক্ষেত্র

জাদুঘর শুধু ইতিহাসের গল্প শোনায় না; এটি একটি শিক্ষাকেন্দ্র। শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হ্যান্ডস-অন’ শেখার উপযুক্ত স্থান। অনেক দেশে জাদুঘর-ভিত্তিক শিক্ষা কর্মসূচি রয়েছে, যেখানে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুর সঙ্গে বাস্তব নিদর্শন মিলিয়ে দেখার সুযোগ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশেও জাদুঘরের সঙ্গে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন। স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে জাদুঘর ভ্রমণ অন্তর্ভুক্ত করলে ইতিহাস ও সংস্কৃতিচর্চা আরও উৎসাহব্যঞ্জক হবে।

জাদুঘর সংরক্ষণে চ্যালেঞ্জ

জাদুঘর পরিচালনা ও সংরক্ষণে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

অর্থসংকট: পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না থাকায় অনেক জাদুঘর সংস্কার ও আধুনিকীকরণে পিছিয়ে।

মানবসম্পদ: প্রশিক্ষিত কিউরেটর, গবেষক ও ডিজিটাল আর্কাইভ বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে।

প্রযুক্তির অভাব: ডিজিটালাইজেশন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও ইন্টার‌্যাকটিভ টেকনোলজির ব্যবহার সীমিত।

সচেতনতার অভাব: অনেক নাগরিক জাদুঘরের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন না। ফলে দর্শনার্থীর সংখ্যা কম থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাদুঘরের টিকে থাকার জন্য হুমকি।

ভবিষ্যতের জাদুঘর: কেমন হওয়া উচিত?

আগামী দিনে জাদুঘরের ভূমিকা আরও বিস্তৃত হবে। প্রযুক্তি, পরিবেশ ও মানবিক চেতনার সঙ্গে সমন্বয় করে জাদুঘর হতে পারে নতুন জ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু। ভবিষ্যতের জাদুঘরের কিছু বৈশিষ্ট্য হতে পারে:

ডিজিটালাইজড সংগ্রহ: ক্লাউডভিত্তিক সংগ্রহশালা, যা যেকোনো স্থান থেকে দেখা যাবে।

ইন্টার‌্যাকটিভ প্রদর্শনী: দর্শক নিজেই অংশগ্রহণ করে জানতে পারবে ইতিহাস।

নতুন ধরনের জাদুঘর: যেমন “ক্লাইমেট মিউজিয়াম,” “মাইগ্রেশন মিউজিয়াম,” “ফিউচার মিউজিয়াম” ইত্যাদি।

বাংলাদেশের করণীয়

বাংলাদেশে জাদুঘরের উন্নয়নে কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন:

বাজেট বৃদ্ধি: সরকারের উচিত জাদুঘর উন্নয়নে আলাদা বাজেট বরাদ্দ করা।

প্রশিক্ষণ ও জনবল নিয়োগ: কিউরেটর, সংগ্রাহক ও গবেষক প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

জেলার প্রতি গুরুত্ব: প্রতিটি জেলা শহরে অন্তত একটি আধুনিক জাদুঘর স্থাপন করা উচিত।

প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্ভাবন: ভিআর, এআর ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

সচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যম ও শিক্ষাক্রমে জাদুঘরের গুরুত্ব প্রচার করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি সামাজিক আহ্বান—আমরা যেন আমাদের অতীতকে সংরক্ষণ করি, বর্তমানকে শিক্ষায় রূপান্তরিত করি এবং ভবিষ্যতের প্রজন্মকে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার দিয়ে যেতে পারি। জাদুঘর মানে কেবল ধুলো ধরা পুরাতত্ত্ব নয়; এটি আমাদের সত্তার, সংগ্রামের এবং সৃষ্টির দলিল।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশ একটি সু-প্রাচীন সভ্যতার দেশ। আমাদের রয়েছে গৌরবদ্বীপ্ত ইতিহাস। আর কোনো দেশের জাতীয় জাদুঘর ঘুরলে সে দেশ ও জাতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। এ জন্য এটিকে জনসাধারণের বিশ্ববিদ্যালয়ও বলা হয়।তাই জাদুঘর এমন একটি জায়গা, যেখানে দর্শনার্থীদের ধর্ম, বর্ণ, পরিচয়ের শ্রেণিকরণ নেই। সব মানুষের জন্য নিরপেক্ষ জায়গা হচ্ছে জাদুঘর।আর ‘সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে জাদুঘরের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাস, ঐতিহ্য, শুদ্ধ সংস্কৃতি উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে জাদুঘর সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মনে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আনে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, ঝুঁকি নিয়েও মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরির ক্ষেত্রে জাদুঘরের ভূমিকা রয়েছে।তাই প্রতিটি নাগরিকের উচিত জাদুঘরের প্রতি দায়িত্বশীল মনোভাব গড়ে তোলা এবং এই মহান প্রতিষ্ঠানের বিকাশে নিজ নিজ অবস্থান থেকে অবদান রাখা।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।