ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের আহ্বান

তামাক নয়, জীবনের পক্ষে দাঁড়ান 

২০২৫ মে ৩১ ১৭:১০:৩৪
তামাক নয়, জীবনের পক্ষে দাঁড়ান 

ওয়াজেদুর রহমান কনক


তামাক এবং তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি জাতীয় অর্থনীতি, সমাজ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর দীর্ঘমেয়াদী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই কারণেই প্রতি বছর ৩১ মে ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’ পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই দিবসটির উদ্যোক্তা, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তামাক ছাড়তে উদ্বুদ্ধ করা এবং সরকারগুলোকে তামাক নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতিমালা প্রণয়নে চাপ দেওয়া।

বিশ্বজুড়ে তামাকজনিত রোগে প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে প্রায় ৭০ লাখ সরাসরি তামাক ব্যবহারকারী, এবং বাকিরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। ধূমপান ছাড়াও ই-সিগারেট, জর্দা, গুল, খৈনি এবং অন্যান্য ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করেও ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হতে হয়। তামাক ব্যবহারের ফলে ক্যান্সার, হৃদরোগ, ফুসফুসের রোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, বন্ধ্যাত্ব, এমনকি অকালমৃত্যুর ঝুঁকি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। তামাকের প্রভাবে শুধু ব্যবহারকারীই নয়, পরিবার, বিশেষ করে গর্ভবতী নারী এবং শিশুদেরও শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিত্রটি আরও উদ্বেগজনক। সরকারি ও আন্তর্জাতিক জরিপ অনুযায়ী, দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। ধূমপানের পাশাপাশি ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারে বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম শীর্ষে। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে জর্দা ও গুল ব্যবহারের হার উচ্চ, যা ক্যান্সার ও মুখগহ্বরজনিত রোগের কারণ। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ ২৬ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়, যা দিনে গড়ে প্রায় ৩৪৫ জনের মৃত্যু। এই সংখ্যা শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, বরং একটি বিপর্যয়ের ইঙ্গিত বহন করে।

বাংলাদেশ সরকার তামাক নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ২০০৫ সালের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন এবং ২০১৩ সালের সংশোধনীতে জনসমক্ষে ধূমপান নিষিদ্ধ, তামাকপণ্যের মোড়কে সচিত্র সতর্কবার্তা, তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। তবে আইনের বাস্তবায়ন এখনও দুর্বল এবং তামাক কোম্পানিগুলোর প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি উদ্যোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসকে কেবল একদিনের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে নয়, বরং একটি সার্বিক সচেতনতামূলক আন্দোলনের অংশ হিসেবে গ্রহণ করা জরুরি।

তামাক ব্যবহারের ফলে দেশের স্বাস্থ্যব্যয়ও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। প্রতিবছর তামাকজনিত রোগ চিকিৎসায় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার মতো ব্যয় হয়, যেখানে তামাক খাত থেকে সরকারের আয় এর চেয়ে কম। এর ফলে দেশের অর্থনীতিতেও একটি নেতিবাচক ভার পড়ে। অনেক দরিদ্র পরিবার আয় ব্যয়ের বড় অংশ ব্যয় করে তামাকে, যার ফলে খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে খরচ কমে যায়। এমন পরিস্থিতিতে তামাকবিরোধী প্রচারাভিযানকে জোরদার করতে হবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও ধর্মীয় সংগঠনসহ সমাজের প্রতিটি স্তরে তামাকের ভয়াবহতা নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে।

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে সরকার, বিভিন্ন এনজিও এবং সচেতন নাগরিক সমাজের উদ্যোগে প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়—যেমন র‍্যালি, সেমিনার, পোস্টার ক্যাম্পেইন, নাটক, প্রচারণামূলক ভিডিও ইত্যাদি। কিন্তু বছরের একদিন সচেতনতা বাড়িয়ে যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন প্রতিদিন তামাকমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে একটি দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন। সরকার ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার যে লক্ষ্য ঘোষণা করেছে, তা সফল করতে হলে তামাক কোম্পানির প্রভাব প্রতিহত করা, তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করা, এবং তামাক চাষের বিকল্প আয় নিশ্চিত করাও জরুরি।

সাম্প্রতিক সময়ে শহরের তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং-এর প্রবণতা নতুন একটি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে, যা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর আসক্তি হিসেবে সামনে আসছে। অনেকেই মনে করেন এটি সাধারণ ধূমপানের চেয়ে নিরাপদ, অথচ এটি নিকোটিনের আসক্তি আরও গভীর করে তোলে এবং ফুসফুসের জটিল রোগের ঝুঁকি বহন করে। তাই শুধু প্রচলিত তামাক নয়, নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া এসব আধুনিক বিকল্পের বিরুদ্ধেও সচেতনতা তৈরি করা জরুরি।

তামাকমুক্ত সমাজ গঠনে এখনই সময়, যখন আমরা স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, পরিবেশ এবং আগামী প্রজন্মের নিরাপত্তার স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে তামাকবিরোধী কার্যক্রমকে একটি সামাজিক আন্দোলনের রূপ দিতে পারি। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস সেই আন্দোলনের প্রেরণা ও অঙ্গীকারের দিন। বিশ্বজুড়ে তামাক ব্যবহারের যে চিত্র উঠে এসেছে, তা গভীরভাবে উদ্বেগজনক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং Lancet-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রতি বছর প্রায় ৮০ লাখ মানুষ তামাকজনিত কারণে মারা যায়। এই মৃত্যুর সিংহভাগ, প্রায় ৭০ লাখ, ঘটে সরাসরি তামাক ব্যবহারজনিত কারণে, আর বাকি প্রায় ১২ লাখ মানুষ মারা যায় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়ে। পরিসংখ্যান বলছে, বিশ্বে প্রতিদিন গড়ে তামাকের কারণে একজন করে মৃত্যুবরণ করছে প্রতি দশ জনের মধ্যে একজন। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি এখনই কার্যকর তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি বাস্তবায়ন না হয়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে বছরে এক কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।

তামাকের ভয়াবহতা শুধু মৃত্যুর পরিসংখ্যানেই নয়, রোগের কারণ হিসেবেও স্পষ্ট। ফুসফুসের ক্যান্সারের ৯০ শতাংশের বেশি, হৃদরোগের প্রায় ৩০ শতাংশ এবং দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুস রোগের প্রায় ৭৫ শতাংশই তামাকের ফলে ঘটে থাকে। অর্থাৎ, তামাক শুধু জীবন সংহার করছে না, কোটি কোটি মানুষকে দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল রোগে আক্রান্ত করে তাদের জীবনমানও বিপন্ন করে তুলছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিত্রটি আরও ভয়াবহ। ২০১৭ সালের GATS (Global Adult Tobacco Survey) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩৫.৩ শতাংশ, অর্থাৎ ১৫ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিরা তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে থাকেন। পুরুষদের মধ্যে এই হার প্রায় ৪৬ শতাংশ এবং নারীদের মধ্যে প্রায় ২৫ শতাংশ। তামাক ব্যবহারের এই উচ্চহার স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ৮৪ লাখ মানুষ তামাকের কোনো না কোনো রূপে আসক্ত।

এই আসক্তির ফল ভয়াবহ। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩৪৫ জন মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে এই নীরব ঘাতকের কারণে। শুধু মৃত্যুই নয়, এর ফলে দেশের স্বাস্থ্যখাতে যে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে, তার পরিমাণ বছরে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা মার্কিন ডলারে প্রায় ৩.৬ বিলিয়ন। অথচ সরকার তামাক খাত থেকে কর আদায় করে মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ স্বাস্থ্য খাতে যে ক্ষতি হচ্ছে, তা অর্থনৈতিক দিক থেকেও তামাককে একটি অপসায়ী খাত হিসেবে চিহ্নিত করছে।

বাংলাদেশে পরোক্ষ ধূমপানও একটি বড় সমস্যা। প্রায় ৩ কোটি মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছেন, যাদের মধ্যে শিশু এবং নারী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। শিশুদের ক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব মারাত্মক; শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, অ্যাজমাসহ নানা জটিল রোগের ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। ধোঁয়াবিহীন তামাক ব্যবহারে নারীদের অংশগ্রহণও আন্তর্জাতিকভাবে চোখে পড়ার মতো। বিশেষ করে জর্দা, গুল, খৈনি ইত্যাদির ব্যবহারে বাংলাদেশ নারীদের সংখ্যা বিশ্বে অন্যতম বেশি।

আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, দেশের তরুণ সমাজের মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রবণতা। GYTS (Global Youth Tobacco Survey) অনুসারে, ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে ৯.২ শতাংশ ইতিমধ্যে তামাক ব্যবহার শুরু করেছে। তাদের বড় একটি অংশের তামাকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ১৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই। শহরাঞ্চলের শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ই-সিগারেট বা ভ্যাপিং-এর মতো আধুনিক তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। অনেকেই এগুলোকে নিরাপদ বিকল্প মনে করলেও, এগুলোর মাধ্যমে শরীরে নিকোটিনের আসক্তি আরও গভীর হয়ে যায় এবং এটি দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।

তামাকের প্রভাব কেবল স্বাস্থ্য ও মৃত্যুর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবও মারাত্মক। তামাক ব্যবহারের ফলে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী অল্প বয়সেই অসুস্থ বা অকালমৃত্যুর শিকার হচ্ছে, যার ফলে জাতীয় উৎপাদনশীলতায় ধস নামে। দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের স্বল্প আয়ের বড় অংশ তামাকে ব্যয় করে ফেলছে, যার ফলে তারা খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। অনেক পরিবারেই শিশুদের পুষ্টি ও শিক্ষার চেয়ে পরিবারের কর্তার তামাক কেনাকাটায় বেশি অর্থ ব্যয় হয়, যা শিশুদের মধ্যে অপুষ্টি ও শিক্ষাবঞ্চনার স্থায়ী চক্র তৈরি করছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে তামাক নিয়ন্ত্রণ কেবল স্বাস্থ্যগত বিষয় নয়, এটি এখন সামাজিক ও উন্নয়ন নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, সরকার, এনজিও, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় সংগঠনকে একসঙ্গে কাজ করে তামাকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। শুধু আইন প্রণয়ন নয়, তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। তামাকের বিকল্প জীবিকার সুযোগ সৃষ্টি, তামাক চাষীদের জন্য পুনর্বাসন পরিকল্পনা এবং তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করতে দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম চালাতে হবে।

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস তাই কেবল একদিনের বার্তা নয়, বরং এটি একটি বৃহৎ সামাজিক আন্দোলনের সূচনা হতে পারে—যেখানে ব্যক্তিগত পরিবর্তন, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ একত্রিত হয়ে একটি স্বাস্থ্যবান, উৎপাদনশীল ও ভবিষ্যতমুখী সমাজ গড়তে ভূমিকা রাখবে।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।