ঢাকা, মঙ্গলবার, ১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

পুষ্টি অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়নের সমন্বিত প্রতিচ্ছবি

২০২৫ জুন ০১ ১৭:১৫:১৭
পুষ্টি অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়নের সমন্বিত প্রতিচ্ছবি

ওয়াজেদুর রহমান কনক


বিশ্ব দুগ্ধ দিবস, প্রতি বছর ১ জুন তারিখে পালিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক উপলক্ষ, যা খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (FAO) ২০০১ সালে শুরু করেছিল। এই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো দুগ্ধজাত পণ্যের পুষ্টিমান, স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং বিশ্বব্যাপী দুধ উৎপাদনের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। দুধকে "সম্পূর্ণ খাদ্য" হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এতে শরীরের প্রয়োজনীয় প্রায় সকল পুষ্টি উপাদান যেমন প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি, বি১২ ও ফসফরাস বিদ্যমান থাকে।

বিশ্বব্যাপী কৃষি নির্ভর অর্থনীতির জন্য দুগ্ধ শিল্প একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাত। এটি কেবল পুষ্টির যোগান দেয় না, বরং কোটি কোটি মানুষের জীবিকা ও কর্মসংস্থানেরও উৎস। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ছোট ও মাঝারি খামারিদের জন্য দুধ উৎপাদন একটি জীবিকাভিত্তিক কার্যক্রম, যা পরিবারভিত্তিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। এই শিল্পের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথও সুগম হয়।

তবে দুগ্ধ শিল্পের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জও রয়েছে। আধুনিক কৌশলের অভাব, পশুখাদ্যের সংকট, পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও পরিচর্যার সীমাবদ্ধতা, এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের অপ্রতুলতা অনেক দেশে দুধ উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বিশেষ করে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও খরা, গবাদি পশুর দুধ উৎপাদনে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করছে। তাছাড়া কিছু দেশে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক ও রাসায়নিক ব্যবহারের কারণে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে।

আধুনিক যুগে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সাহায্যে গবাদিপশুর উন্নত জাত উদ্ভাবন, গৃহপালনের মানোন্নয়ন, এবং দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ এই শিল্পে বিপ্লব ঘটাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া কেবল দুধের গুণগত মান উন্নয়নে সহায়ক নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার ক্ষেত্রেও তা জরুরি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, দুগ্ধ শিল্প এখনো সম্ভাবনাময় খাত হলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিকাশ ঘটেনি। গ্রামীণ এলাকায় দুধ উৎপাদনের হার তুলনামূলকভাবে ভালো হলেও সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা দুর্বল। দুধে ভেজালের প্রবণতা, পশুর চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতির কারণে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। সরকার ও বেসরকারি খাতে কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে এই খাতকে জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তিতে পরিণত করা সম্ভব।

বিশ্ব দুগ্ধ দিবস শুধু একটি পুষ্টি বিষয়ক বার্তা বহন করে না, এটি একটি খাদ্যনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন নীতির অংশ হিসেবেও বিবেচিত হয়। এই দিবসের মাধ্যমে মানুষ দুধকে শুধু শিশুর জন্য নয়, জীবনের প্রতিটি স্তরের মানুষের জন্য একটি অপরিহার্য খাদ্য উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করার গুরুত্ব অনুধাবন করে। আন্তর্জাগতিক সহযোগিতা, বিজ্ঞানভিত্তিক চর্চা এবং সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দুগ্ধ শিল্প ও এর উপকারিতা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া এই দিবসের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।

বিশ্ব দুগ্ধ দিবস নিয়ে আলোচনা তখনই পরিপূর্ণ হয়, যখন এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য প্রসঙ্গ যেমন—গবাদিপশু পালন, পুষ্টি নিরাপত্তা, দুধভিত্তিক পণ্য, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ, প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং নীতিনির্ধারণী দিকসমূহ যুক্ত হয়ে একটি বৃহৎ চিত্র তৈরি করে। এইসব বিষয় একত্রে বিবেচনা করলে বোঝা যায়, দুধ কেবল একটি খাদ্য উপাদান নয়, বরং একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক ও বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার অংশ, যা মানব জীবনের বহু স্তরের সাথে সম্পৃক্ত।

গবাদিপশু পালন এমন এক কৃষিশিল্প যা কেবল দুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে গোবর থেকে জৈব সার উৎপাদন, গবাদিপশুর চামড়া ও মাংস উৎপাদন, এবং কৃষি জমিতে লাঙলের ব্যবহারসহ নানাবিধ উপকারিতা জড়িত। বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতিতে গবাদিপশু অনেক সময় সঞ্চয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়। নারী সদস্যরা গরু বা ছাগল পালন করে পরিবারে অতিরিক্ত আয় যোগান দিতে পারেন। এতে নারীর আর্থিক স্বনির্ভরতা ও সামাজিক মর্যাদা বাড়ে, যা নারীর ক্ষমতায়নের একটি কার্যকর উপায়।

পুষ্টি নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকেও দুধের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে দুধ অনন্য ভূমিকা পালন করে। অথচ দুঃখজনকভাবে অনেক দরিদ্র পরিবার দুধের সঠিক প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত। ফলে অপুষ্টি, বিশেষত শিশুদের মধ্যে খর্বতা (stunting) ও কৃশতা (wasting) মারাত্মক আকার ধারণ করে। এই অবস্থার উত্তরণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য ভর্তুকিভিত্তিক দুধ সরবরাহ, স্কুলভিত্তিক ‘দুধ পান কর্মসূচি’ ও সচেতনতামূলক উদ্যোগ প্রয়োজন।

দুধভিত্তিক পণ্য যেমন—দই, ঘি, মাখন, পনির, কনডেন্সড মিল্ক ইত্যাদি কেবল স্বাদের জন্য নয়, বরং স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এই পণ্যগুলো প্রক্রিয়াজাত করে বাজারজাতকরণ করলে তা একদিকে যেমন আয় বাড়ায়, তেমনি গ্রামীণ শিল্পের প্রসার ঘটায়। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা পর্যায়ে দুধপ্রক্রিয়াজাত পণ্যের উৎপাদন একটি বড় সম্ভাবনার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। এতে কর্মসংস্থানও বাড়ে।

স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ক আলোচনায় দুধের বিশুদ্ধতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক ক্ষেত্রেই অতিরিক্ত পানি মেশানো, রাসায়নিক সংরক্ষণকারী ব্যবহার বা পশুকে ইনজেকশনের মাধ্যমে কৃত্রিম উপায়ে দুধ উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। দীর্ঘমেয়াদে এর ফলে ক্যান্সার, হরমোনজনিত সমস্যা ও অ্যালার্জির আশঙ্কা বাড়ে। এ অবস্থায় সরকার-নির্ধারিত মান নিয়ন্ত্রণ, নজরদারি এবং জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।

দুধ উৎপাদন ও বিতরণে পরিবেশগত প্রভাবও আলোচনার দাবিদার। গবাদিপশুর নির্গত মিথেন গ্যাস জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। আবার খামারে অতিরিক্ত পানি ও খাদ্যের ব্যবহার পরিবেশের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এই প্রেক্ষাপটে টেকসই খামার ব্যবস্থাপনা, পরিবেশবান্ধব খাদ্য, এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নতুন পদ্ধতির প্রয়োগ প্রয়োজন। অনেক দেশে ইতোমধ্যে কার্বন-নিরপেক্ষ দুগ্ধ খামার চালু হয়েছে, যা উদাহরণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য।

এছাড়াও প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন আজকের দুগ্ধশিল্পকে এক নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে। অটোমেটেড মিল্কিং সিস্টেম, দুধের গুণগত মান যাচাইয়ের মোবাইল অ্যাপ, ডিজিটাল ট্রেসিং সিস্টেম—এসবই কৃষক ও ভোক্তার মধ্যে বিশ্বাস ও স্বচ্ছতা গড়ে তুলছে। বাংলাদেশেও প্রযুক্তির এই ব্যবহার ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করছে, যা ভবিষ্যতে দুধশিল্পের বিকাশে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

সবশেষে বলা যায়, বিশ্ব দুগ্ধ দিবসের তাৎপর্য তখনই পূর্ণতা পায়, যখন এটি পুষ্টি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, প্রযুক্তি এবং ন্যায়ভিত্তিক কৃষি নীতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এই দিবস নতুন করে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, দুধ কেবল একটি খাদ্য নয়, বরং মানব উন্নয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ মাধ্যম। তাই এই খাতকে উপেক্ষা না করে, বরং সার্বিকভাবে উন্নত ও টেকসই করে তোলার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সুস্থ, সচেতন এবং খাদ্যনিরাপদ সমাজ গঠনের সম্ভাবনা।

লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।