প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
কোরবানির পশুর সঠিক যত্নে ঈদের আনন্দ নিশ্চিত করুন
২০২৫ জুন ০১ ১৮:৪৬:১৯ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত হল কোরবানি, যা পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে পালন করা হয়। এই ইবাদতের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পশু কোরবানি দেন। তবে কোরবানি শুধু পশু জবাই করার মাধ্যম নয়; এটি একটি বিস্তৃত ধর্মীয় ও সামাজিক প্রক্রিয়া যার অন্যতম অংশ হল পশুর সঠিক যত্ন ও পরিচর্যা। পশুর প্রতি যত্নশীল হওয়া ইসলামি আদর্শের অন্তর্গত, এবং কোরবানির পশু যেহেতু ইবাদতের উদ্দেশ্যে নির্ধারিত, সেহেতু তার প্রতি আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি।
এই প্রবন্ধে আমি আলোচনা করব কোরবানির পশুর যত্নের বিভিন্ন দিক—খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, চিকিৎসা, মানসিক সুস্থতা ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক যত্ন কেমন হওয়া উচিত।
১. কোরবানির পশু নির্বাচনের গুরুত্ব: কোরবানির পশুর যত্ন শুরু হয় সঠিক পশু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। হাদীস অনুযায়ী, কোরবানির পশু হতে হবে সুস্থ, অঙ্গহানিহীন এবং নির্দিষ্ট বয়সের। গরু ও মহিষ হলে কমপক্ষে দুই বছর, ছাগল হলে এক বছর এবং উট হলে পাঁচ বছর বয়স হওয়া আবশ্যক। পশু নির্বাচনের সময় তার হাঁটাচলা, চোখ, কান, শিং, দাঁত ইত্যাদি ভালোভাবে পরীক্ষা করে নিতে হয়। দুর্বল, পঙ্গু বা অসুস্থ পশু কোরবানি করা অনুচিত।
২. আবাসস্থলের পরিচ্ছন্নতা: পশুকে সঠিকভাবে পালন করার জন্য তার থাকার জায়গাটির পরিচ্ছন্নতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পশুর জন্য খোলা জায়গা, যথেষ্ট আলো-বাতাস চলাচলের সুযোগ এবং শুকনা ও মল-মূত্রমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা উচিত। নিয়মিত খড়, মাটি বা বালু পরিবর্তন করে জায়গা শুকনো রাখা দরকার। ভিজে ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে পশু অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। খামারে বা বাড়ির আঙিনায় রাখা পশুর আশেপাশে কীটনাশক ছিটিয়ে রাখতে হবে যেন মাছি, মশা বা অন্যান্য পোকা-মাকড় সংক্রমণ ঘটাতে না পারে।
৩. খাদ্য ও পুষ্টির সঠিক ব্যবস্থা: পশুর সুস্থতা নির্ভর করে তার খাদ্যাভ্যাসের ওপর। কোরবানির পশুর খাদ্যে পর্যাপ্ত পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। তাদের প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে খড়, ঘাস, খৈল, ভুষি, চালের কুড়া, গুঁড়, ভুট্টা ইত্যাদি খাওয়ানো যেতে পারে। এছাড়াও বিশুদ্ধ পানি সর্বদা সহজলভ্য করে রাখা প্রয়োজন। পানির পাত্র প্রতিদিন পরিষ্কার করতে হবে। বেশি খাবার দিয়ে পশুকে মোটা করে তোলার চেষ্টা না করে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক নিয়মে খাওয়ানোই শ্রেয়। অতিরিক্ত খাবার থেকে অ্যাসিডিটি, ডায়রিয়া বা হজমের সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারে।
৪. স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও চিকিৎসা: পশুর স্বাস্থ্য ভালো রাখা কোরবানির গুরুত্ব পূর্ণ করতে সাহায্য করে। পশুর নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে হবে স্থানীয় পশু চিকিৎসকের কাছ থেকে। প্রয়োজন অনুযায়ী টিকা প্রদান, কীটনাশক প্রয়োগ, ডিওয়ার্মিং (পেটের কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়ানো) ইত্যাদি করতে হবে। পশুর গায়ে ঘা, ফোঁড়া বা অন্য কোনো রোগ দেখা দিলে অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা করানো প্রয়োজন। কোনো রোগের লক্ষণ যেমন: খাওয়া-দাওয়ায় অনীহা, শ্বাসকষ্ট, পায়খানায় পরিবর্তন ইত্যাদি দেখলে পশুচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৫. ব্যায়াম ও চলাফেরা: কোরবানির পশুকে শুধু খাওয়ালেই চলবে না; তাকে যথেষ্ট পরিমাণে হাঁটাচলার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পশুকে খোলা জায়গায় হাঁটানো উচিত। এতে তার হজম ভালো হয়, পেশি সক্রিয় থাকে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে গরু ও মহিষের মতো বড় পশুর জন্য হাঁটাচলা অত্যন্ত জরুরি। হাঁটাচলার সময় পশুর পা, খুর ও গতি লক্ষ্য রাখা উচিত যাতে কোনো ধরনের পঙ্গুতা বা অস্বাভাবিকতা দেখা না যায়।
৬. মনোযোগ ও মানসিক যত্ন: পশুরা অনুভূতিপ্রবণ প্রাণী। তারা আমাদের ব্যবহারে সাড়া দেয়, ভালোবাসা অনুভব করে। কোরবানির জন্য পশু কেনার পর তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা জরুরি। তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেওয়া, শান্তভাবে ডাকা, তার সঙ্গে সময় কাটানো—এসব পশুর মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পশুকে যন্ত্রের মতো না দেখে জীবন্ত সৃষ্টি হিসেবে দেখার মানসিকতা গড়ে তোলাই কোরবানির চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
৭. ঈদের আগ মুহূর্তে প্রস্তুতি: ঈদের দিন ঘনিয়ে এলে পশুর যত্ন আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই সময় পশুর স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। ঈদের আগের দিন পশুর গোসল করিয়ে পরিষ্কার করা উচিত। গা থেকে ময়লা পরিষ্কার করা, খুর কাটানো, শিং পরিষ্কার করা—এসব করলে পশু আরও স্বাস্থ্যবান ও উপযুক্ত দেখায়। ঈদের দিন সকালে তাকে খাওয়ানো ও পানি পান করিয়ে রাখা উত্তম, যাতে জবাইয়ের সময় পশু দুর্বল না থাকে।
৮. ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যত্ন: ইসলাম ধর্মে প্রতিটি প্রাণীর প্রতি দয়া ও করুণার আচরণ করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। হাদীসে রয়েছে, “তোমরা যদি কোনো পশু জবাই করো, তবে তা ভালোভাবে করো। ছুরি ধারালো করো এবং পশুকে কষ্ট দিও না।” (সহীহ মুসলিম)। এই নির্দেশনা কেবল জবাইয়ের সময় নয়, কোরবানির আগে যত্নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ধর্মীয়ভাবে পশুর যত্ন করা শুধু মানবিক দায়িত্ব নয়, বরং একটি সওয়াবের কাজ। পশুর প্রতি নিষ্ঠুরতা ও অবহেলা করা হলে কোরবানির মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়।
৯. শিশু-কিশোরদের শিক্ষা: কোরবানির সময় শিশু-কিশোরদের পশুর যত্ন ও সহানুভূতির শিক্ষা দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারা যেন পশুকে খেলনার মতো না দেখে, বরং জীবন্ত সৃষ্টির প্রতি দায়িত্ব ও মমতা শেখে—এটাই হওয়া উচিত আমাদের শিক্ষাদান। শিশুদের পশুকে খাওয়ানো, পানি দেওয়া ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। এতে তারা কোরবানির অন্তর্নিহিত ত্যাগ ও সহমর্মিতার মূল্যবোধ অর্জন করবে।
১০. সামাজিক দায়িত্ব: শহরে বা গ্রামে, যেখানেই কোরবানির পশু রাখা হোক না কেন, আশপাশের পরিবেশ ও প্রতিবেশীদের অসুবিধা যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি। পশুর শব্দ, মল-মূত্র, গন্ধ—এসব যাতে প্রতিবেশীর জন্য বিরক্তির কারণ না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। পশুর যত্নের পাশাপাশি আমাদের এই সামাজিক দিকগুলোতেও যত্নবান হওয়া দরকার।
পরিশেষে বলতে চাই, কোরবানির পশুর প্রতি যত্ন নেওয়া কেবল ধর্মীয় নির্দেশনা পালন নয়, এটি একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্বও বটে। এই পশুগুলো আল্লাহর নামে উৎসর্গ করার পূর্বে আমরা যে যত্ন, ভালোবাসা ও মানবিকতা তাদের প্রতি প্রদর্শন করি, সেটাই প্রকৃত ত্যাগ ও কোরবানির চেতনার প্রতিফলন। তাই কোরবানির পশুকে একবার কিনে রেখে দিলেই দায়িত্ব শেষ হয় না; বরং যতদিন সে আমাদের সঙ্গে থাকে, ততদিন সে যেন সম্মান, ভালোবাসা ও সুস্থতায় থাকতে পারে—এটা নিশ্চিত করাই আমাদের সবার কর্তব্য।
লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।