প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত
সুচিত্রা সেন স্বৈরাচারের দোসর?
২০২৫ জুন ০২ ১৭:৩৫:৪৬
চৌধুরী আবদুল হান্নান
জুলাই বিপ্লব পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এবং শেখ পরিবারের সদস্যদের ঘরবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং বিভিন্ন স্থাপনার নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। এখনও স্বৈরাচারের দোসর খুঁজে খুঁজে বের করার কাজ শেষ হয়নি।
আমাদের মনে হচ্ছে সুযোগ বুঝে প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি এবং গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধারে একটি মহল উঠেপড়ে লেগেছে।
সম্প্রতি পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের “সুচিত্রা সেন ছাত্রীনিবাস” এর নাম পরিবর্তন করে “জুলাই -৩৬” নামকরণ করা হয়েছে।
পাবনাসহ সারাদেশের সচেতন ও সাংস্কৃতিমনা মানুষের মনে বড় প্রশ্ন, অবশেষে দুই বাংলার সিনেমার জনপ্রিয় কিংবদন্তী নায়িকা সুচিত্রা সেনের ওপর আক্রমণ কেন?
বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়িকা বা তাঁর বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত কি কোনো রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন? আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের আগেই দেশ ভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার শিকার হয়ে তাঁরা সপরিবারে কলকাতা পাড়ি জমান।
তারা তো কোনো রাজনৈতিক সুবিধাও নেননি। তাহলে কেন এবং কারা অভিনেত্রীর পিছনে লাগলো?তাঁর নাম মুছে ফেলতে চায় কারা?
বুঝতে বাকি থাকে না, সুচিত্রা সেন একজন নারী আবার হিন্দু, সে কারণ তিনি একটি অন্ধ বিশ্বাসী ধর্মীয় গোষ্ঠীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
নারী বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক চিন্তা ভাবনা আমাদের সমাজের একটি পুরাতন রোগ। দেশের দু-একটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে কিছু ধর্মান্ধ লোক বিদ্যমান, তারা মাঝে মাঝে প্রয়োজনে ধর্মকে রাজনৈতিক পূঁজি হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।
সুচিত্রা সেন ছাত্রী নিবাসের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত যারা গ্রহণ করেছেন, তারা কী ব্যাখ্যা দেবেন? বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের নির্দেশে কি এটা করেছেন? জুলাই বিপ্লবের তরুণ নেতৃত্বের মূল আকাঙ্খা ছিল, স্বৈরাচার উৎখাত আর দেশ গড়ার স্বপ্ন; সাম্প্রদায়িকতা উসকে দেওয়া নয়।
সুচিত্রা সেন স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন- “সুচিত্রা সেন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নন। তিনি রাজনৈতিক কোনো ফায়দা নেওয়ারও প্রশ্ন আসেনি। তিনি আমাদের আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসার মানুষ। তাঁর নাম মুছে দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।”
অ্যাডভোকেট আমিনউদ্দিন মুক্তিযুদ্ধে দেশের প্রথম শহীদ সংসদ সদস্য এবং বিএনপি নেতা রফিকুল ইসলাম বকুল ছিলেন পাবনার মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, তিনিই পাবনায় প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পাবনার এই দুই বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে দুইটি স্থাপনা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং সেই দুইটির নামও পরিবর্তন করে দেওয়া হয়েছে।
বিষয়টি স্পষ্ট যে, সাম্প্রদায়িক শক্তি আর স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির একই সাথে আত্মপ্রকাশ ঘটেছে।
বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে ধারণ করে কিন্ত স্বাধীনতা অর্জনের এতদিন পরও ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রাদায়ের ঘরবাড়ি, স্থাপনা আক্রান্ত হচ্ছে।
সকল ধর্মের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে দেশটা স্বাধীন করেছে, তাই সকল ধর্মের মানুষ এখানে সমান ধর্মীয় অধিকার নিয়ে বসবাস করবে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ মুসলমান এবং সে কারণে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা করার মূল দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে।
ইসলাম ধর্ম সমাজে ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গেও সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে এবং হিতাকাঙ্খী হিসেবে চলার নির্দেশনা দেয়। এই ধর্ম কখনই সংকীর্ণতা বা সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ শেখায় না, এর আবেদন মানবতা ও সমগ্র মানব সভ্যতার জন্য প্রযোজ্য।
নারী বিদ্বেষ আর সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার বশবর্তী হয়ে সুচিত্রা সেনের নাম মুছে ফেলার উদ্যোগ দেশের স্বাধীনচেতা মানুষ ও সাংস্কৃতিমনা জনগোষ্ঠী মেনে নেয়নি এবং তাদের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাধছে।জনমানুষের ক্ষোভের তীব্রতার মুখে এক সময় আজ অথবা কাল পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের “সুচিত্রা সেন ছাত্রী নিবাস” এর নাম পূনর্বাহাল হতে হবে—- এমন প্রত্যাশা আমাদের।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।