প্রচ্ছদ » আইন আদালত » বিস্তারিত
অভয়নগরে তরিকুল হত্যা ও মতুয়া সম্প্রদায়ের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ
হত্যা মামলায় ৩ জন ও ঘর জ্বালানো মামলায় ৪ জনের তিনদিনের রিমাণ্ড
২০২৫ জুন ০২ ১৮:৪৩:০৮
রঘুনাথ খাঁ, সাতক্ষীরা : গত ২২ মে যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের ডহর মশিয়াহাটির গ্রামের বাড়েদাপাড়ায় কৃষকদল নেতা তরিকুল ইসলাম জিবলু খুনের মামলায় গ্রেপ্তারকৃত তিন আসামি ও মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৮টি বাড়িতে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃত সাত জনের প্রত্যেককে তিনদিন করে রিমাণ্ড মঞ্জুর করেছে আদালত।
আজ সোমবার যশোরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম গৌতম মৃধা মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঞ্জুরুল কবীর ভুঁইয়া ও অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল আলিমের আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পৃথক দুটি আবেদনের শুনানী শেষে প্রত্যেক আসামীর সাত দিন করে রিমাণ্ড মঞ্জুর করেন।
হত্যা মামলায় রিমাণ্ড মঞ্জুর হওয়া আসামিরা হলেন- যশোর সদর উপজেলার রামনগর গ্রামের(পিকনিক কর্ণার) ছিদ্দিক খানের ছেলে ফিরোজ আলম ওরফে ফিরোজ খান, একই জেলার অভয়নগর থানার চলিশিয়া (পশ্চিমপাড়া) গ্রামের হারুন মোল্লার ছেলে অহিদুজ্জামান সুমন ওরফে সুটার সুমন ও ডহর মশিয়ারহাটি গ্রামের বাড়েদাপাড়ার দিল্লিশ্বর বিশ্বাসের ছেলে মুদি ব্যবসায়ি দীনেশ বিশ্বাস।
ঘর জ্বালানো মামলায় রিমা- মঞ্জুর হওয়া আসামীরা হলেন, অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া পৌরসভার ধোপদী এলাকার সাজ্জাত হোসেন, ইমন হোসেন, এবাদুল ইসলাম ও রিফাতুল ইসলাম।
মামলার তদন্তকারি কর্মকর্তা যশোর গোপয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মঞ্জুরুল কবীর ভুঁইয়া জানান, গত ২২ মে সন্ধ্যায় নওয়াপাড়া পৌর কৃষকদলের আহবায়ক তরিকুল ইসলাম জিবলু ডহর মশিয়ারহাটি গ্রামের বাড়েদাপাড়ার সনতান ধর্মাবলম্বী মতুয়া সম্প্রদায়ের পিল্টু বিশ্বাসের বাড়িতে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। এ ঘটনায় তার ভাই রফিকুল ইসলাম টুলু বাদি হয়ে গত ২৬ মে ১১ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ২৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলা (১৬) দায়ের করেন। এ মামলার এজাহারভুক্ত ফিরোজ খান ও দীনেশ বিশ্বাসসহ সন্ধিগ্ধ অহিদুজ্জামান সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে সাত দিন করে রিমাণ্ড আবেদন জানানো হয়।এ ছাড়া জনগনের কাছ থেকে উদ্ধার করা বাড়েদাপাড়ার সুজিত বিশ্বাসের ছেলে সাগর বিশ্বাসকে ২৪ মে ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে জেল হাজতে পাঠানো হয়।
তদন্তকারি কর্মকর্তা আরো জানান, সোমবার যশোর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম গৌতম মৃধা তিন জনের রিমাণ্ড আবেদন শুনানী শেষে প্রত্যেককে তিন দিন করে রিমাণ্ড মঞ্জুর করেন। আদেশ হাতে পাওয়ার পর তাদেরকে আজ অথবা মঙ্গলবার পুলিশ হেফাজতের বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে। তবে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তারকৃত সাগর বিশ্বাসকে আজ তরিকুল হত্যা মামলায় আদালতের মাধ্যমে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। আজ তার আইনজীবী অ্যাড. সুমন কুমার দে আদালতে জামিন আবেদন করলে তা না’মঞ্জুর করেন বিচারক গৌতম কুমার মৃধা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আগামিকাল মঙ্গলবার আদালতে সাত দিনের রিমাণ্ড আবেদন জানানো হবে।
অভয়নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল আলীম জানান, বাড়েদাপাড়ায় কৃষকদল নেতা তরিকুল ইসলাম জিবলু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষুব্ধ জনতা মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৮টি বাড়িতে ভাঙচুর, লুটপাট, মারপিট শেষে প্রেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ ঘটনায় সুশান্ত বিশ্বাসের স্ত্রী কল্পনা বিশ্বাস বাদি হয়ে ২৬ মে কারো নাম উল্লেখ না করে থানায় (১৭) নং মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় সন্দিগ্ধ আসামী হিসেবে ধ্রোপদী এলঅকার সাজ্জাত, এবাদুল, ইমন ও রিফাতুলকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রত্যেককের সাত দিন করে রিমা- আবেদন করেন।
সোমবার শুনানি শেষে যশোরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম গৌতম মৃধা তাদর তিন দিন করে রিমাণ্ড মঞ্জুর করেন। আদেশ হাতে পাওয়ার পর আজ অথবা মঙ্গলবার তাদেরকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হবে। এ ছাড়া সুন্দলী বাজারের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে কয়েকটিতে অহ্নিসংযোগের ঘটনায় ব্যবসায়িদের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
সুন্দলী ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য পবিত্র বিশ্বাস জানান, সনাতনী মতুয়া সম্প্রদায়ের ১৮টি পরিবারের সদস্যদের মারপিট, ঘরবাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের পর পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনায় সরকারিভাবে প্রতিটি পরিবার পিছু ছয় বান করে টিন ও নগদ ছয় হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। এ সাহায্য ঘরবাড়ি সংস্কারে পর্যাপ্ত নয় বিধায় উপজেলা প্রশাসন আরো কিছু সহায়তা দিয়ে ঘরবাড়ি সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর অভয়নগর ক্যাম্প রবিবার বাড়েদাপাড়া পরিদর্শণ করেছেন। তারা আগুনে পুড়ে দেয়াল ফেটে যাওয়ায় তা নতুন করে নির্মাণের জন্য সহযোগিতার কথা বলেছেন। তবে সে জন্য দুই মাস সময় চেয়েছেন তারা। তবে বর্ষা শুরু হওয়ায় সোমবার থেকে পোড়া ঘরবাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজ শুরু করা হয়েছে। এরপরপরই সেনা বাহিনীর সাথে উপজেলা প্রশাসন কথা বলে সব কিছু ঠিক করবেন।
অভয়নগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়দেব কুমার চক্রবর্তী জানান, বর্ষা এসে যাওয়ায় আশ্রয়হীন পরিবারগুলোর ঘর সংস্কারের জন্য উদ্যাগে নেওয়া হয়েছে। তবে তাদের বসবাসের সুবিধার্থে স্থানীয় সেনা ক্যাম্পের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলা হবে।
প্রসঙ্গত, অভয়নগর উপজেলার সুন্দলী ইউনিয়নের বিল বোকড় বিলে ডহর মশিয়ারহাটি গ্রামের বাড়েদাপাড়ায় সনাতনী মতুয়া সম্প্রদায়েরসহ পাশর্^বর্তা কয়েকটি গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের ২৪০ বিঘা জমি রয়েছে। মালিকদের টাকা না দিয়ে ওই জমিতে ঘের করা নিয়ে প্রতিযোগিতার জের ধরে গত ২২ মে সন্ধ্যায় যশোরের ফিরোজ খানের বাহিনীর সদস্যদের হাতে কৃষকদল নেতা তরিকুল ইসলাম জিবলু খান হন বলে প্রচার রয়েছে। এরই জের ধরে তরিকুল সমর্থকরা ১৮টি মতুয়া সম্প্রদায়ের বাড়িতে কোটি টাকারও বেশি লুটপাট ও ভাঙচুর শেষে প্রেট্রোল ঢেলে আগুণ লাগিয়ে দেয়।
আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ে যায় বিভিন্ন গাছের ডাল ও পাতা। কমপক্ষে ৩১ জন শিক্ষার্থীর বই, খাতাসহ শিক্সা সামগ্রী ও শিক্ষাগত সনদ পুড়ে যায়। হত্যা মামলায় নিহতের ভাই রফিকুল ইসলাম টুলু বাদি হয়ে ২৬ মে ক্ষতিগ্রস্ত ৮জন হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যসহ প্রতিপক্ষ তিন জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা ২৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। হত্যা মামলায় দীনেশ, সাগর, ফিরোজ খান ও সুটার সুমনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ডহর মশিয়ারহাটি গ্রামের অনিমেষ মণ্ডল ও নিমাই বিশ্বাসকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকেই ঘরে ফিরতে পারছন না। ২২ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে হামলাকারিরা তরিকুলের লাশ নিয়ে চলে যাওয়ার সময় সুন্দলী বাজারের ১৫টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠাণে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট শেষে কয়েকটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।
(আরকে/এসপি/জুন ০২, ২০২৫)