ঢাকা, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

প্রশান্তিময় বিশ্রাম ও আরামদায়ক ঘুমের অন্তরায় যখন লোডশেডিং

২০২৫ জুন ০৩ ১৯:৪৭:৪৯
প্রশান্তিময় বিশ্রাম ও আরামদায়ক ঘুমের অন্তরায় যখন লোডশেডিং

রিয়াজুল রিয়াজ


একটু হালকা বাতাস তো- বিদ্যুৎ নেই, একটু মেঘ করেছে- বিদ্যুৎ নেই, বৃষ্টি আসবে আসবে ভাব- বিদ্যুৎ নেই, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি তো- বিদ্যুৎ নেই, তীব্র রোদ বা ভ্যাবসা গরম পড়েছে- বিদ্যুৎ নেই ; নেই তো নেই। বিদ্যুৎ যেনো যেতে হবেই যেকোনো উপায়ে, এটাই অলিখিত নিয়ম। আবার বেশ কিছুক্ষণ বিদ্যুৎ না থাকার পর রাতে আসলো, আপনি একটু আরাম করে ঘুমিয়েছেন বিদ্যুৎ মাইন্ড করে বলে বসবে, 'আপনি ঘুমাচ্ছেন কেনো? তাই রাগ করে চলে গেলাম। এবার ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে উঠে বসুন অথবা একটু হাটাহাটি করুন। আর বিদ্যুৎ আসার জন্য অপেক্ষা করুন। আসলে তারপর ঘুমাতে যান। তবে প্রস্তুত থাকুন, বিদ্যুৎ কিন্তু যেকোনো সময় চলে যেতে পারে।' এমনিভাবে বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে জীবন কাটে ফরিদপুর সদরের শিল্পাঞ্চল খ্যাত কানাইপুর বাজারের খাসকান্দি রোডের বাসিন্দা ও এই অঞ্চলে অবস্থিত শিল্প কলকারখানার কর্মকর্তা কর্মচারীর। এটি ওই এলাকার বাসিন্দাদের বিদ্যুৎ ভাগ্যের সাম্প্রতিক চিত্র বটে। কোনভাবেই যেনো এর থেকে পরিত্রানের উপায় খুঁজে পাচ্ছে না এলাকাবাসী। এইতো কিছুদিন আগেও এক-দুই ঘন্টা টানা বিদ্যুৎ না থাকলে মাইকিং করে পুর্বেই তা গ্রাহকদের জানিয়ে দেওয়া হতো। আর এখন বিদ্যুৎ এর বেহাল দশায় অনেকেই তামাশার ছলে বিদ্যুৎ অফিসের লোকদের বলেন, "ভাই দিনে ও রাতে কখন কখন বিদ্যুৎ থাকবে, সেই খবরটা মাইকিং করে আগেভাগে জানানো যাবে কি? কিন্তু বলতে বাধা নেই ৫ আগস্টের আগে এই এলাকার বিদ্যুৎ সার্বিসের অবস্থা এতোটা বাজে কখোনোই ছিলোনা। তখনও বিদ্যুৎ হয়তো দু'একবার যেতো কিন্তু দুই চার মিনিট পর আবার চলে আসতো। উন্নয়নের কাজে আধা ঘন্টার বেশি বিদ্যুৎ বন্ধ থাকবে এমন পরিস্থিতিতে করা হতো মাইকিং। তবে বর্তমানে বিদ্যুৎ এর এমন পরিস্তিতে হয়তো বিদ্যুৎ অফিসের মাইকিং খরচটা বেঁচে গেছে।

এদিক দিয়ে শুধু নয়, আগে বাসাবাড়ির বিদ্যুৎ বিল চার পাঁচ মাস বকেয়া থাকলেও প্রিন্টেড বিল আসতো। এখন এক মাসের বেশি বকেয়া থাকলে তৃতীয় মাস থেকে বিল দেওয়া বন্ধ, বিদ্যুৎ লাইন কর্তন। আর শিল্প কারখানায় কোনো মাসেই বিল বকেয়া রাখার কোনো সুযোগ নাই। বিলিং ডেট মাসের ২৪ তারিখে থাকলে হয়তো ৩০ তারিখ পর্যন্ত কয়েকটি নির্দিষ্ট ব্যাংকের মাধ্যমে বিল পরিশোধের সুযোগ থাকে বটে। তবে দিতেই হয়। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যে একেবারেই হয় না, তা নয়। যার সাথে একটু ভাব বা লাভ থাকে লাইনম্যান সহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সুদৃষ্টিতে তারা এসব ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন। তবে তা নির্দিষ্ট ও বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য। এটি হতেই পারে, স্বাভাবিক! একটি উচ্চতর বৈষম্যমূলক পুরোনো সিস্টেম!

যাহোক, এতোক্ষণ যে মহামান্য বিদ্যুৎ সাহেবের কথা আলোচনা করলাম তা কিন্তু আন্দোলন করা পল্লী বিদ্যুৎ নয়, এটি বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বাবিউবো) এর একটি প্রতিষ্ঠান- 'ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড' এর আওতাধীন বিদ্যুৎ। সুতরাং এটির কোনো জবাবদিহিতা নেই। তাই এই কোম্পানির বিদ্যুৎ মাঝা মাঝে আসবে, অনেক বার এই সাম্প্রতিক গল্পের বাইরেও কোম্পানিটির বিদ্যুৎ গ্রাহকদের আরো কিছু এক্সটা ঝামেলা পোহাতে হয়; প্রিপেইড গ্রাহকদের কার্ড রিচার্সের ক্ষেত্রে। কোনো স্পেস ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিশাল অংকের নির্ভুল সংখ্যা লিখতে তাই ভুল করেন অনেক গ্রাহক। একাধিক চেষ্টায় কোনোভাবে রিচার্সে সফল হলেও টাকা কাটার পরিমান দেখে অনেকেই প্রশ্ন তোলে বলেন যে, নিজের টাকা দিয়ে মিটার কিনে নিজের ঘরে লাগানো মিটারের মাসিক ভাড়া কেনো এই কোম্পানি দেবো? ভ্যাট না হয় নিলেন বুঝলাম, কিন্তু 'সেই সাথে কেনো এই চার্জ, সেই চার্জ, চিপায় আটকা ফাটা বাঁশ' অবস্থা করবে গ্রাহকদের এই বিদ্যুৎ কোম্পানিটি। কি ভাবছেন পাঠক, যারা এই কোম্পানির পোস্ট পেইড গ্রাহক তাদের এসব ঝামেলা কম? এমনটি ভাবার কোনো কারণ নাই।

আমি আমার নিজের কথাটাই বলি। নতুন বিল্ডিং এ নতুন একটি ফ্লাট, কোনো এক সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে বসবাস শুরু। প্রথম মাসে বিল ৭৫ টাকা, দ্বিতীয় মাসে চারশত এরপর কয়েক মাস আটশত থেকে এক হাজার। ডিসেম্বরে দুই হাজার থেকে তিন হাজারের মধ্যের কোনো সংখ্যা। কারণ জিজ্ঞেস করলে বলেন যারা মিটার রিডার তারা একটু কম ইউনিট লিখে বিল করেছিলেন, এখন এয়ার ক্লোজিং এই জন্য এতো সব ইউনিটের বিল একসাথে আসছে। ছলিম বুঝ পছন্দ হলো না তাই ওই মাসে বিল দিলাম না, চেষ্টা করলাম এসবের কারণ খোঁজার, কিন্তু লাভ হলোনা। তাঁদের কথায় অমতকার ভেবে প্রস্তান করিলাম। এদিকে এসব ঝুট ঝামেলা ও হিসেব বুঝতে তিন মাসের বিল জমালাম। ব্যক্তিগত ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নের নোটিশ পাঠালেন ওই অফিসের এক কর্তা! ভাবলাম ছাইড়া দে মা কাঁইন্দা বাঁচি। তিন মাসের বিল প্রায় ৭ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হলো লাইন নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পেতে। সেই থেকে আর আমার বিল কমেনি, হাজার থেকে বারো শো টাকার মধ্যে গুনতে হয় প্রায় প্রতি মাসে। কোনো মাসে ব্যবহার কম হলে ব্যতিক্রমও হয়তো হয়।

তবে এতোকিছুর মধ্যে তাদের মিটারের একটি জটিল হিসেব শিখে নিয়েছি আমি, আর তা হলো: মিটার রিডিং যারা লেখেন তারা কিছু কিছু ইউনিট হাতে রেখে বিল করতে থাকেন এবং ইউনিট জমিয়ে রাখেন। বেশকিছু ইউনিট জমালে ওদের আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রাথমিক একটি সংখ্যক ইউনিটের জন্য বিদ্যুৎ বিলের ইউনিট প্রতি রেট একটু কম ধরা হয়। এবং তার উপরের অংক সংখ্যার রেট আবার ইউনিট প্রতি একটু বেশি করে নির্ধারণ থাকে। উদাহারণ স্বরুপ: ধরুন আপনি ১০ ইউনিট ব্যবহার করেছেন, এটি ইনিশিয়াল স্টেজ তাই এটি ইউনিট প্রতি রেট ধরলাম ১টাকা। তাহলে আপনার বিল আসবে ১০ টা। কিন্তু আপনি ১১ ইউনিট হলে আবার ইউনিট প্রতি গুনতে হবে ধরুন ২ টাকা। তাহলে ১১ ইউনিটের বিল হবে ২২ টাকা!

এইরকম কোনো হিসাব ওরা আপনাকে মিলিয়ে দিবে, যাতে আপনার বিল সব সময় কমপক্ষে দ্বিতীয় ধাপে পৌছায়। তাই তারা পোস্ট পেইড গ্রাহকদের জন্য প্রতি মাসে ইউনিট জমিয়ে কনফার্ম করেন যেনো ইউনিট প্রতি কম ডিজিটের সংখ্যাটি বেশিরভাগ আবাসিক গ্রাহকেরাই অতিক্রম করতে সক্ষম হয়! এক ইউনিট বেশি হলেও যেনো মিনিমাম দ্বিতীয় ধাপের সংখ্যার হিসেবে কাস্টমারের বিলটি নিশ্চিত করা হয়। তাতে ইনিশিয়াল ইউনিট প্রতি বিলের তুলনার তার বিল প্রতি ইউনিটে বাড়বে। যার ফলে বিলের টাকার পরিমান বাড়বে। যাতে লাভবান হবে কোম্পানি। সিম্পল হিসাব, গ্রাহকের চিন্তা করে লাভ কি? পাবলিক তো সরল অংকই ঠিকঠাক বুঝতে চান না, একটু কম-বেশির হিসেব কষবে কখন? বাঙালি তাদের ঐতিহ্য বহনকারী তাল পাখা ও কুপি-হারিকেন ফেলে কলের পাখা ও নিয়ন আলো জ্বালাতে পারছে সেটাই বা কম কিসের? সুতরাং বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে আসবে নাকি মাঝে মাঝে যাবে, সেটার হিসেব মিলিয়ে লাভের থেকে সময়ের ক্ষতিই বেশি হবে। যাপিত জীবন, যখন-তখন, যেখানে যেমন, যাচ্ছে কেটে; যাক না রে ভাই!

উল্লেখ করতেই চাই, মঙ্গলবার রাত ১১ টায় বাসায় ঢোকার কিছুক্ষণ পর বিদ্যুৎ গিয়ে রাত আড়াইটার সময়ও যখন বিদ্যুৎ আসছে না, গরমে ঘুমাতেও পারছিনা। তখন অনিচ্ছাকৃত স্বত্বেও স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসের এক সুহৃদ প্রকৌশলীকে ফোন দিয়ে ঘুম থেকে উঠিয়ে বললাম, 'কেউ ঘুমাবে, কেউ ঘুমাবে না! তা হবে না, তা হবে না।' তিনি বললেন কতক্ষণ নাই? আমি সময় জানিয়ে ফোন রেখে দিলাম। এরপর ১০ মিনিট পরপর আসে ৩ থেকে ৫ সেকেন্ট থাকে আবার চলে যায়। এভাবে রাত সাড়ে তিনটা বেজে গেলো। বাচ্চা গরমে ঘুম থেকে উঠে আমার পাশে বসে ওর মোবাইল নিয়ে গেম খেলতে লাগলো আর আমি নির্ঘুম রাগে দুঃখে ওই ভদ্রলোককে আর বিরক্ত না করে লিখতে বসলাম। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার এসেছে দশ-পনেরো মিনিট থেকে আবার চলে গেছে। এভাবে আসা যাওয়া করতে করতে ভোর সাড়ে চারটা দিকে যখন বিদ্যুৎ এসে একটু দাঁড়ালো, তখন সময় প্রায় পাঁচটা ছুঁই ছুঁই। আজ রাতে আমি বাসায় আসার পর এটাই এক নাগারে দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎ এর অবস্থান টের পেলাম। লেখাটি শেষ করে ঘুমাবো ভেবে জানালার পর্দা টেনে ঘুমাতে আসলাম অবশেষে। ঘুমের আগে কামনা করছি যেনো ঘুমটা আরামদায়ক হয়, আর ঘুম পূর্ণ হয়ে ভাঙ্গার আগে যেনো বিদ্যুৎ চলে না যায়!

লেখক: কলামিস্ট, ছড়াকার।