প্রচ্ছদ » দেশের খবর » বিস্তারিত
দিনাজপুরে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের প্রস্তুতি
২০২৫ জুন ০৪ ১৮:৩৪:০১
শাহ্ আলম শাহী, দিনাজপুর : গোর-এ-শহীদ বড় ময়দান। দিনাজপুরে অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ঈদগাহ ময়দান। প্রতি ঈদে এখানে লাখ লাখ মানুষ ঈদের নামাজ আদায় করেন। দূরদূরান্ত থেকে আসা মুসল্লিদের জন্য প্রতিবছর করা হয় বিশেষ ট্রেন সার্ভিসের ব্যবস্থা। ঈদের আগে কয়েক দিন ধরে সংস্কার ও ধোয়ামোছার কাজ করেন কয়েক'শ শ্রমিক। বিশেষ আলোকসজ্জা করা হয় ঈদের নামাজকে কেন্দ্র করে। ২০টির মতো প্রবেশপথ এবং কয়েকটি ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়। মুসল্লিদের জন্য গাড়ি পার্কিং, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার ব্যবস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর নিশ্চিদ্র নিরাপত্তাব্যবস্থায় থাকেন।
২০২২ সালে অনুষ্ঠিত ঈদুল ফিতরের জামাতে এখানে প্রায় ৬ লাখ মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করেছেন। এ জামাতে ইমামতি করেন দিনাজপুর জেনারেল হাসপাতাল মসজিদের খতীব, দারুল উলুম আহমদাবাদ সরকার দিঘীর মোহতামীম মাও: শামসুল হক কাসেমী।
গোর–এ–শহীদ মাঠ নিয়ে দু'টি জনশ্রুতি চালু আছে। একটিতে বলা হয়েছে, পারস্য থেকে এই অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে এসে মারা যান শাহ আমিরউদ্দিন ঘুরি (রহ.)। মাঠের পাশেই তাকে সমাহিত করা হয়। সেই থেকে এই মাঠের নাম গোর-এ-শহীদ মাঠ। অন্য একটি জনশ্রুতিতে জানা যায়, সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহর আমলে ৪০ জন সুফিযোদ্ধার সঙ্গে তৎকালীন রাজার যুদ্ধ হয়েছিল। সুফিদেরই একজন বর্তমান বড় মাঠে শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। সেখানেই তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। ফারসিতে ‘গোর’ অর্থ কবর। মাঠটিও তাই পরিচিতি পায় গোর-এ-শহীদ মাঠ।
বিভিন্ন ইতিহাসগ্রন্থ থেকে জানা যায়, ঐতিহাসিক গোর-এ-শহীদ মাঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর উত্তর ফ্রন্টের সমাবেশ হয়েছিল। পরেও মাঠটি সেনাবাহিনীর নামেই রেকর্ড হয়। সবুজ ঘাসে মোড়া মাঠটির আয়তন ২২ একর। খেলাধুলা থেকে শুরু করে আড্ডা, বিভিন্ন মেলা, জাতীয় দিবস, এমনকি গণসংবর্ধনার আয়োজনও করা হয় এই মাঠে। স্থানীয় লোকজনের কাছে মাঠটি ‘ আশির্বাদ।'
স্থানীয় প্রবীণ শিক্ষাবিদ প্রফেসর এম এ জব্বার, শিক্ষাবিদ কবীর মাস্টার, সমাজ সেবক আবুল কালাম আজাদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই এই মাঠে ঈদের জামাত হয়ে আসছে। তবে মাঠটিতে তখন বড় কোনো মিম্বর ছিল না। ২০১৫ সালে বড় পরিসরে এখানে একটি ঈদগাহ মিনার তৈরির উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সংসদ সদস্য ও জেলা পরিষদ। দুই বছর পর ২০১৭ সালে শেষ হয় নির্মাণকাজ। মিনারটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৪ কোটি টাকা। আয়োজকদের দাবি, সেই বছর এই মাঠে ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় করেন ৬ লাখের বেশি মুসল্লি। ইমামতি করেন মাওলানা শামসুল হক কাসেমী। এর পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে দেশের অন্যতম বৃহত্তম ঈদগাহ মাঠ হিসেবে পরিচিতি পায় গোর-এ-শহীদ মাঠ। দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা এবং রাজধানী ঢাকা,চট্রগ্রাম থেকেও এখানে ঈদের নামাজ আদায় করতে আসেন মুসল্লিরা।
মিনার তৈরির পর থেকেই গোর-এ-শহীদ মাঠের গুরুত্ব ও মর্যাদা বেড়েছে কয়েক গুণ। মাঠের পশ্চিম প্রান্তে লাল–খয়েরি আর সাদা রঙের ৫১৬ ফুট দীর্ঘ ঈদগাহ মিনারটি নজর কাড়ে। ৫২ গম্বুজবিশিষ্ট ঈদগাহ মিনারটি মোগল স্থাপত্যরীতিতে নির্মাণ করা হয়েছে। দুই প্রান্তে দুটি মিনারের উচ্চতা ৬০ ফুট। মাঝের দুটির উচ্চতা ৫০ ফুট আর টাইলস করা মিহরাবের উচ্চতা ৫৫ ফুট। এতে খিলান আছে ৩২টি। প্রতিটি গম্বুজে আছে বৈদ্যুতিক বাতি। সন্ধ্যার পরপরই মিনারে জ্বলে ওঠে আলো।
স্থানীয় লোকজনের পাশাপাশি মিনারের সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন পর্যটকেরাও। মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাবন্দী করেন সুন্দর সব মুহূর্ত।
ঈদের নামাজে আসা মুসল্লিদের সংখ্যা গণনার বিশেষ কোনো ব্যবস্থা এবার রাখা যায় কি না, সেটা নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ব্যবস্থা করা গেলেই কেবল নিশ্চিত হওয়া যাবে, গোর–এ–শহীদ মাঠের ঈদের জামাতে কত মানুষ অংশ নেন এমন্টাই জানানো হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
দিনাজপুর জেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছেন, গোর-এ শহীদ বড় ময়দানের আয়তন প্রায় ২২ একর। ২০১৭ সালে নির্মিত ৫২ গম্বুজের ঈদগাহ মিনার তৈরিতে খরচ হয়েছে ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ঈদগাহ মাঠটি নান্দনিক হিসেবে নির্মাণ করা হয়। এই ৫০ গম্বুজের দুই ধারে ৬০ ফুট করে দুটি মিনার, মাঝের দুটি মিনার ৫০ ফুট করে। ঈদগাহ মাঠের মিনারের প্রথম গম্বুজ অর্থাৎ মিহরাব (যেখানে ইমাম দাঁড়াবেন) তার উচ্চতা ৪৭ ফুট। এর সঙ্গে রয়েছে আরও ৪৯টি গম্বুজ। এ ছাড়া ৫১৬ ফুট লম্বায় ৩২টি আর্চ নির্মাণ করা হয়েছে। উপমহাদেশে এত বড় ঈদগাহ মাঠ দ্বিতীয়টি নেই। পুরো মিনার সিরামিক্স দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি গম্বুজ ও মিনারে রয়েছে বৈদ্যুতিক লাইটিং। রাত হলে ঈদগাহ মিনার আলোকিত হয়ে ওঠে।
প্রতি বছর ওযু, যানবাহন রাখার ব্যবস্থা, মেডিকেল টিম, খাবার পানিসহ ১৫০টি মাইক রাখা হয়। থাকে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। প্রতিটি গম্বুজ ও মিনারে বৈদ্যুতিক লাইটিং করা হয়। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে এ ঈদ জামাতে ঈমান পরিবর্তন হয়েছেন। আননুজুস মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা মো. মাহফুজুর রহমানকে ঈদের নামাজের ইমামতির জন্য গত রমজানে নিয়োগ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। গেল ঈদ-উল-ফিতরের নামাজে প্রথম তিনি ইমামতি করিয়েছেন।
এ জামাতের ইমাম মো. মাহফুজুর রহমান জানিয়েছেন, 'দেশ ও জাতি-মুসলিম উম্মার সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয় এ জামাত থেকে। লাখো লাখো সুসল্লি শান্তি-শৃংখলার সঙ্গে এ জামাতে অংশ নেয়। আল্লাহ্ তাঁর কোন বান্দার দো'আ কবুল করবেন, একমাত্র তিনিই জানেন।'
দিনাজপুর জেলা প্রশাসক মো. রফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘ময়দানটি এখন সবুজ বেষ্টনীতে সাজানো হয়েছে। ময়দানের চতুর দিকে দেওয়া হয়েছে, নিরাপত্তা বেষ্টনী। ঈদের জামাতকে সুষ্ঠুভাবে ও নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করতে ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সিসিটিভি ক্যামেরার পাশাপাশি চলছে কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি। জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, পৌরসভা, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, সাংবাদিকসহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশের বৃহৎ এই ঈদের জামাত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়। সকলের সহযোগিতায় বাংলাদেশের বৃহৎ এই মাঠকে জান্নাতে পরিণত করার প্রচেষ্টা চলছে।'
দিনাজপুর পুলিশ সুপার মারুফাত হুসাইন মারুফ জানান, ঈদের জামাতের জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতি ঠেকাতে পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থাকে সদা তৎপর। মানুষ যেন হাসিমুখে বাসা থেকে এসে ঈদের নামাজ পড়ে হাসিমুখে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারে সেজন্য পুলিশের পক্ষ থেকে এবারো নেওয়া হয়েছে সব ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তিন স্তরে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য পর্যবেক্ষণ টাওয়ার, পুলিশ কন্ট্রোল রুম, পোশাকে ও সাদা পোশাকে পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা ও ডিবি পুলিশের সদস্যরা উপস্থিত থাকবে। ঈদগাহ মাঠে প্রবেশের জন্য তোরণ বা প্রবেশ গেট থাকবে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে তল্লাশির ব্যবস্থা।মুসল্লিদের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা। সব ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে এবারের ঈদ জামাতে। নামাজ শেষে মুসল্লিরা যাতে নিরাপদে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেন,সেজন্য আমরা প্রস্তুত রয়েছি।
এদিকে দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো.তোফাজ্জল হোসেন জানিয়েছেন, ঈদের দিনে বৃষ্টি আশংকা রয়েছে রংপুর বিভাগ সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। তবে, কোন জেলা অঞ্চলে কি পরিমান বৃষ্টি হতে পারে তা বলা যাচ্ছেনা এখনো। এটা নির্ভর করবে আবহাওয়ার উপরে।
(এসএস/এসপি/জুন ০৪, ২০২৫)