প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত
সেই সময় এই সময়
২০২৫ জুন ১৩ ১৬:৩৬:৪৯
আবু মকসুদ
আমি যুক্তরাজ্য প্রবাসী একজন। আমার নাড়ি পোঁতা আছে বাংলাদেশের মাটিতে। সেকারণে বাংলাদেশ নিয়ে হামেশাই নাক গলাই। এই লেখাটিও সেই নাক গলানোই।
১. সেই সময়ে শেখ হাসিনা লন্ডনে এলে বিরোধীদল জড়ো হয়ে গর্জে উঠতো—“অবৈধ! অবৈধ!” আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তখন সেই স্লোগানকে ব্যঙ্গ করে হাসাহাসি করত, বিরোধীদের ফকির-টোকাই বলে তাচ্ছিল্য করত। অথচ আমি তখনই বলেছিলাম—এই অবজ্ঞা, এই উপহাস একদিন প্রবলভাবে ফিরে আসবে। কর্ম কখনো নির্বাক থাকে না; জীবিতকালেই তার প্রতিফলন ঘটে, ফিরে আসে দ্বিগুণ তীব্রতায়।
আজ দৃশ্যপট বদলে গেছে। ড. ইউনুস ইংল্যান্ড সফরে এসেছেন রাজপরিবারের আমন্ত্রণে। আর তাঁকে অপমান করতে জড়ো হচ্ছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। তারা জ্বালাময়ী স্লোগান দিচ্ছে, হাতে জুতা, পকেটে ডিম—উন্মত্ত ভঙ্গিতে ছুটছে অপমানে নিমজ্জিত কোনো হারের প্রতিশোধ নিতে।
ড. ইউনুসের পাশে থাকা মানুষগুলো এখন হাসছে, যেমন একদিন হাসত আওয়ামী লীগ। ইতিহাসের এই চক্রবৃত্তি আমাকে মনে করিয়ে দেয়—"এই দিন দিন নয়", যখন আমি সতর্ক করেছিলাম—তখন আমাকেও রাজাকার বলা হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ যে অন্যায় করেছে, যে গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে, প্রতিপক্ষকে দমন করার যে কৌশল রপ্ত করেছিল—তার প্রতিটি পদক্ষেপই তাদের দিকে ফিরে আসবে। প্রকৃতি কোনো ঋণ রাখে না; বিধাতা কোনো শূন্যস্থান অপূর্ণ রাখেন না। কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেন। ফিরে আসে—ভোরের প্রথম আলো যেমন অবধারিত।
কিন্তু একসময়ের দুর্দণ্ড প্রতাপশালী আওয়ামী লীগের এই ফকিরি অবস্থা দেখে সত্যিই কষ্ট হয়। কারণ, এ দল তো বাংলাদেশের শুদ্ধতম পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দল। তিনি যে দল গড়েছিলেন—সাহস, ত্যাগ আর বাঙালির আত্মমর্যাদার প্রতীক হিসেবে, সেই দল আজ ভিখারির চেয়েও দুর্বল, দিশেহারা ও সম্মানহীন হয়ে পড়েছে। শুধু এক নেত্রীর মূর্খতা, অন্ধ উন্মাদনা ও পরমত সহিষ্ণুতার অভাবেই এ অবস্থা। একা ক্ষমতা আঁকড়ে ধরার এই রোগ আজ গোটা সংগঠনের শিরায় শিরায় দারিদ্র্য, দেউলিয়াত্ব আর আত্মসম্মানহীনতার ছাপ ফেলে গেছে।
বঙ্গবন্ধুর আত্মা যদি কোথাও জেগে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই তিনি কাঁদেন এই দুর্দশা দেখে—যে দলে তাঁর স্বপ্ন ছিল, আজ সে দল হাস্যকর, অসহায় আর প্রবল অপমানের প্রতীক।
২. এই সময়ে ড. ইউনুস বিলেতে আসছেন। তাঁকে ঘিরে এই নগরীর বাংলাদেশি কমিউনিটিতে এক অদ্ভুত বিভাজন দৃশ্যমান—একদল মানুষ আছেন যারা জুতা দেখাতে চায়, ডিম ছুঁড়ে মারতে চায়; আরেকদল আছেন যারা তাঁকে দেখে আঁচল বিছিয়ে লাল গালিচার স্বপ্ন দেখছেন। এ যেন বাংলাদেশই দুই খণ্ড হয়ে এসেছে ইংল্যান্ডের বুকে। আফসোস এখানেই—যে আমরা বৃটেনের মাটিতেও বাংলাদেশ নামক দ্বিধা, বিদ্বেষ ও বুদ্ধিহীন চাটুকারিতার চর্চা থেকে বের হতে পারিনি।
আওয়ামী লীগের কিছু অর্বাচীন কর্মী তাঁর আগমনে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন, যেন তাঁকে লাঞ্ছিত করলেই দলের সেবায় ব্রত হওয়া যাবে। বিপরীতে, বাংলাদেশের কমিউনিটিতে 'রবিউল' বা 'হাসমত' নামে যাদের আমরা চিনি—তাঁরা ড. ইউনুসকে অভ্যর্থনার আয়োজন করছেন এমনভাবে, যেন লাল গালিচার প্রকৃত তাৎপর্য নিজেরাও বোঝেন না, বুঝতে চেষ্টাও করেন না।
বাংলাদেশের একটি বড় অংশ ড. ইউনুসকে ফেরেশতার মতো ভাবেন—তাঁর নোবেলপ্রাপ্তিকে জাতীয় অহংকার মনে করেন এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তাঁর অবস্থানকে নিজেদের আত্মপ্রত্যয়ের উৎস বানিয়ে ফেলেন। অপরপক্ষে, অনেকেই মনে করেন তিনি দেশবিরোধী শক্তির একজন কুশীলব—একজন ছলনাময় মানুষ, যিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দেশে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন।
এই অবস্থানে দাঁড়িয়ে যদি কেউ জানতে চায়, আমি তাঁকে কী মনে করি—তবে স্পষ্ট করে বলি, আমি তাঁকে ফেরেশতা ভাবি না, আবার শয়তান বলতেও দ্বিধাবোধ করি। আমি তাঁকে দেখি একজন অত্যন্ত সন্দেহজনক ব্যক্তি হিসেবে—যার উদ্দেশ্য আজও অস্পষ্ট, যাঁর অবস্থান একাধিকবার দেশের ও জাতির স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে।
যদি তিনি সত্যিই নৈতিকতাবান হতেন, তাহলে ক্ষমতায় থেকে নিজের বিরুদ্ধে থাকা মামলাগুলো বাতিল করতেন না। গ্রামীণ ব্যাংকের ট্যাক্স মওকুফ করাতেন না রাষ্ট্রের সংবিধানবিরোধী পন্থায়। যাচাই-বাছাই ছাড়াই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন নিতেন না। তাঁর কর্মকাণ্ড যদি জাতির মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে হতো, তাহলে বঙ্গবন্ধুবিরোধী অবস্থানে দাঁড়াতেন না, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী মহলের উত্থানে ভূমিকা রাখতেন না।
এমনকি তাঁর কিছু বক্তব্য মিথ্যা বলার মাধ্যমে বিতর্কিত হয়েছে। "মানবিক করিডোর" কিংবা "চট্টগ্রাম বন্দর ইস্যু" নিয়ে তাঁর বক্তব্য পরবর্তীতে বিভ্রান্তিকর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। যে ব্যক্তি সত্যকে ছেঁটে দিয়ে নিজস্ব প্রচারণা তৈরি করেন, তাঁকে ফেরেশতা বলা যায় না। আবার তাঁকে পুরোপুরি 'ইবলিশ' বলা কড়া হলেও—মানুষ হিসেবে তাঁর অবস্থানকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় না।
মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা—সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে নিয়ে ড. ইউনুস-ঘনিষ্ঠ মহল এবং তাঁদের বুদ্ধিবিবর্জিত সরকারপন্থী চক্র এমন ভাষায় প্রচার চালিয়েছিল, যেন তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে পালিয়ে গেছেন। একজন বয়োবৃদ্ধ, নির্দোষ, জীবদ্দশায় সম্মানিত রাষ্ট্রপ্রধানকে এভাবে পালিয়ে যাওয়া প্রেসিডেন্ট তকমা দেওয়া শুধু নির্মম অপমান নয়, এটা ছিল ন্যূনতম রাজনৈতিক সৌজন্যবোধের চরম অবক্ষয়। অথচ তিনি কোনো নাটক বা নিরাপত্তাবেষ্টিত আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই গতকাল দেশে ফিরে এসেছেন—নীরবে, স্বাভাবিকভাবে। এই ফিরে আসা যেন ড. ইউনুসের পুরো ব্যবস্থাকে চপেটাঘাত করে বলে দিয়েছে: "তোমরা মিথ্যা বলেছো, এবং এখন সেই মিথ্যার মুখে নিজেরাই চুনকালি মেখেছো।" কিন্তু ড. ইউনুস এতটুকুও লজ্জিত নন। একজন সম্মানীয় মানুষের সম্মানহানির জন্য যে প্রকাশ্য দুঃখপ্রকাশ করা উচিত, তার বিন্দুমাত্রও তিনি করেননি। এ কারণেই তাঁকে পুরোপুরি মানুষের কাতারে ফেলা যায় না—কারণ মানুষ মাত্রেই কোনো এক মুহূর্তে অনুতপ্ত হয়, আর তিনি সেই সাধুবোধ থেকেও অনেক দূরে।
ড. ইউনুস একজন বিরল প্রতিভার মানুষ, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর পথ ও প্রণোদনা—এই দুটি বিষয় ঘিরেই যথেষ্ট প্রশ্ন, যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। এই অনিশ্চয়তা থেকেই আমার মত—তিনি ফেরেশতা নন, শয়তানও নন, বরং একজন সন্দেহভাজন, যাঁর প্রতি অতিরিক্ত উচ্ছ্বাস বা ঘৃণা, উভয়ই অতি সরলীকরণ।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ 'শব্দপাঠ' সম্পাদক।