ঢাকা, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

ফিরে দেখা, ঘুরে দেখা: ছিটমহলের এইদিন সেইদিন

২০২৫ জুন ১৩ ১৮:১৭:৩৬
ফিরে দেখা, ঘুরে দেখা: ছিটমহলের এইদিন সেইদিন

রহিম আব্দুর রহিম


সালটা ২০১০। দিন তারিখ মনে পড়ছে না।সম্ভবত সেপ্টেম্বরে শেষ অথবা অক্টোবরের শুরুর সময়। খেয়াল হচ্ছে, দুর্গোপূজো কাছাকাছি। পঞ্চগড় জেলার সদর উপজেলায় অবস্থিত তৎকালীন গারতী ছিটমহলের ১১৭টি বাড়িতে ভূমিদস্যু সন্ত্রাসীরা আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি Daily NewAge পত্রিকার পঞ্চগড় প্রতিনিধি। একই সাথে চাকরি করি গলেহাহাট ফাযিল মাদ্রাসায়, ওই মাদ্রাসার বাংলা বিষয়ের প্রভাষক। তৎকালীন প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মোঃ ইয়াছিন আলীর এক আত্মীয় ছিটমহলের বাসিন্দা। তাঁর ওই আত্মীয় ছিটমহলে আগুন দেবার খবরটি তাঁকে জানিয়েছেন। আমি সাংবাদিক, সংবাদ সংগ্রহে ঘটনাস্থলে যাওয়া অনিবার্য। জায়গাটা চিনি না, অধ্যক্ষ মহোদয় নিজেই আমাকে তাঁর বাইকে উঠিয়ে ঘটনাস্থলে রওনা হলেন।

ছিটমহলের অদূরে বাংলাদেশের একটি গ্রামে বাইক রেখে গ্রামের কাঁচারাস্তা ছেড়ে দিয়ে কখনও আইল পথ, আবার কখন আবাদী জমির মাঝ বরাবর হেঁটে পৌঁছে গেলাম ঘটনাস্থলে। দেখলাম লুটপাট হচ্ছে ধান- চাল, গরু-ছাগল। দাঁউ দাঁউ করে জ্বলছে ১১৭টি বাড়ি। ভুক্তভোগীদের আকাশ বিদীর্ণ চিৎকার-কান্নায় এলাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। সবার চোখে মুখে ভয় আতংক।ওই সময়ের পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক, পুলিশ সুপার শাহরিয়ার রহমান আরও আগেই পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য নিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে গেছেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে দুর্বৃত্তরা সটকে পড়েছে। বাংলাদেশের ভেতর ভারতের একখন্ড জমিতে যাদের বসবাস, তাদের নেই রাষ্ট্রীয় অধিকার, না আছে আইনের শাসন।ভয়াবহ এক অন্ধকার জগৎ। সেইদিনই প্রথম যাওয়া।সন্ধা রাতে বিবিসি বাংলার এক সাক্ষাৎকারে ঘটনার বর্ণনা দিলাম। সেই থেকেই ভারত-বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকরা ছিটমহলের নানা কাহিনী, জানা ও শোনার জন্য নিয়মিত যোগাযোগ শুরু করেন। সঙ্গত কারণেই ছিটবাসীদের সাথে যোগাযোগ, তথ্য আদান প্রদান হচ্ছে নিয়মিত।

আমার প্রতিষ্ঠিত পঞ্চগড় বিদ্রোহী শিশু-কিশোর থিয়েটার নাট্যকর্মীদের সাথে ছিটমহলের নানাকাহিনী শেয়ার করায় তারা একটি নাটক নির্মাণের অনুপ্রেরণা জোগায়। যেই কথা, সেই কাজ। নাটক লেখলাম 'আজব জগৎ ছিটমহল।' এই নাটক প্রথম মঞ্চস্থ হলো দিনাজপুর অনুষ্ঠিত বিভাগীয় নাট্যেৎসবে।এরপর ঢাকার শিল্পকলা একাডেমির নাট্যশালায় অনুষ্ঠিত জাতীয় নাট্যোৎসবে মঞ্চস্থ হলো। ২০১২ সালে নিপা (National Center of International Amateur Theatre Association) আয়োজিত ভারতের বারানাসীতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নাট্যোসবে যাবার আমন্ত্রণ পেলাম। আজব জগৎ ছিটমহল নাটকটির নাম পরিবর্তন করে 'চুক্তিরমুক্তি' নামকরণ করা হলো। এবার শিল্পী সংগ্রহের পালা, আমার জন্মস্থান জামালপুরে, চাকরি সুবাদে পঞ্চগড়ে আসা।শিশুদের নাটক, শিশুশিল্পী মিলছে না। এক পর্যায় আমার কর্মরত প্রতিষ্ঠানের তিন শিক্ষার্থী সপ্তম শ্রেণির মনির হোসাইন, আলমগীর হোসেন ও আবিদুল ইসলাম।পঞ্চগড় বিষ্ণু প্রসাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের তৎকালীন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানভীর ইবনে আজিজ জীম, আরিফ হোসেন, মোঃ মাসুদ রানা, মুহাম্মদ ফরিদুজ্জামান রকি, সপ্তম শ্রেণির ছাত্র নুরুজ্জামান নিষাত, ইমামীম মুবিন মুক্ত, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও তানভীর হাসানকে নিয়ে দল গঠন হলো।

আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে নাটক মঞ্চস্থ হবার পর ভারতে কূটনৈতিক মহলে তোলপাড় শুরু হয়। নাটক শেষে দেশে ফিরলাম। নাটকের সকল ব্যয়ভার শেষে ১লক্ষ ৪০ হাজার টাকা আমাদের কাছে থেকে যায়, যে টাকা দিয়ে দেশে ফেয়ার পরের দিনই নাট্যকর্মীদের সাথে নিয়ে একটা বাইক কিনে ফেললাম। ২০১৪ সালে পুনরায় তৎকালীন ভারত -বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় কমিটির সাধারণ সম্পাদক দীপ্তিমান সেনগুপ্তের আমন্ত্রণে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিটমহলগুলোতে একই নাটক পরিবেশন করার ডাক পড়ে। ২০১৫ সালের ৩১জুলাই দীর্ঘ ৬৮ বছরের সীমান্ত জটিলতার নিরসন হয়।উভয় দেশের মোট ৫৫ হাজার জন-মানুষ এরমধ্যে বাংলাদেশের মধ্যে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের ৪১ হাজার এবং ভারতের মধ্যে থাকা ৫১টি ছিটের ১৪ হাজার মানুষ ফিরে পাই রাষ্ট্রীয় অধিকার। বিনিময় ঘটে ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ৭ হাজার ১১০ একর এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহলের ১৭ হাজার ১৬০ একর জমি।

উল্লেখ্য, ওই সময় ১১১টি ছিটমহলের ৯৭৯ জন ভারতের নাগরিক হবার আবেদন করায় তারা এখন ভারতে বসবাস করছেন। তবে ভারতে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের একজন লোকও বাংলাদেশের নাগরিক হবার আগ্রহ প্রকাশ করেনি। উভয়দেশের ছিটমহল বিনিময় হবার আগেই অর্থাৎ ২০১৫ সালের ১৬ মে কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি আমার লেখা স্বাধীন ছিটমহল গ্রন্থটি প্রকাশ করে।ওই সময়ে আমার সাথে আনুষ্ঠানিক পরিচয় ঘটে তৎকালীন ভারতের ঢাকাস্থ হাই কমিশনার পঙ্কজ শরন, রাজশাহীস্থ সহকারি হাই কমিশনার সন্দীপ মিত্রসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কর্মরত সাংবাদিকদের সাথে। ছিটমহলে বিনিময়কালে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ছিলেন মোহাম্মদ সালাহ্ উদ্দিন, পুলিশ সুপার ছিলেন আবুল কালাম আজাদ, বিজিবি ১৮ ব্যাটলিয়নের অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহাম্মদ আরিফুল হক। ২০১৫ এর ১ আগস্ট- সকালে আনুষ্ঠানিক জাতীয় পতাকা উত্তোলন হয়, বিকালে সদ্য বাংলাদেশের (সাবেক ছিটমহলের) শিশু কিশোরদের নিয়ে পঞ্চগড় বিদ্রোহী শিশু কিশোর থিয়েটার গ্রন্থিত এবং আমার নির্দেশিত কোরিওগ্রাফি 'বাংলা আমার মা', পরিবেশিত হয় সদ্য বাংলার বাগানবাড়ির মাটিতে। ওইদিনই কথা দিয়েছিলাম প্রতিবছর একবার করে সদ্যবাংলার শিশুদের নিয়ে অনুষ্ঠান করবো, তা আর হয় নি, সেইদিনের পরে আমার আর আনুষ্ঠানিকভাবে ছিটমহলেও যাওয়া হয় নি। দীর্ঘ ১০ বছর পর, ২০২৫ এর ১২ জুন বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী শিশু আনন্দ উৎসব করার জন্যই সাবেক ছিটমহল গারাতি যাওয়া, এবারের আয়োজনে ষড়ঋতু-জগদল পঞ্চগড়ের পরিচালনা পরিষদের মোঃনিয়াজ মোর্শেদ মুগ্ধ, মোঃ আবু তারেক, আবু সাঈদ, আব্দুল্লাহ আল-আসিফ, মোঃ অনিক ইসলাম মোঃ জাহাঙ্গীর আলম, মোঃ নাছিবুর রহমান নাবিল মোঃ নাহিন মুনকার মাহিন, সোহেল রানা, পারভেজসহ সম্মানী ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মফিজার রহমান ডিগ্রী কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ নূর উল্লাহ, রাজমহল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবু হানিফাসহ এলাকার নবীন-প্রবীন শতাধিক মানুষ।

সাবেক ছিটমহল বর্তমান মূলধারার অধিবাসীরা এক সময়কার বঞ্চিত, অবহেলিত জনগোষ্ঠী হিসেবে চিহৃিত ছিল। এখন সব ধরণের রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। গড়ে উঠেছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চিকিৎসা কেন্দ্র। গ্রামের রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটেছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। তবে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন সেই পুরোনো তিমিরেই পড়ে আছে। খাদ্যের অভাবে মানুষের মৃত্যু হবার ইতিহাস খুবই কম, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক বিনোদনের অভাবে মানুষের আত্মার নীরব মৃত্যুর কাহিনী শত সহস্র, জাগো মানুষ, জাগাও সংস্কৃতি, জেগে উঠুক সভ্যতা।

লেখক : নাট্যকার ও গবেষক।