ঢাকা, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

বেকারত্বের সুযোগে বাড়ছে প্রতারক

ভুয়া পেশায় বৈধ আয়ের ফাঁদ: সমাজে নতুন মহামারি!

২০২৫ জুন ১৭ ১৯:১৭:৫৯
ভুয়া পেশায় বৈধ আয়ের ফাঁদ: সমাজে নতুন মহামারি!

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বর্তমান বিশ্বে প্রতারণার রূপ ও ধরন দিন দিন পরিবর্তিত হচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগতি এবং মানুষের চাহিদার বিস্তার প্রতারকদের জন্য এক নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। একসময় সাধারণভাবে আর্থিক লেনদেনে প্রতারণার ঘটনা ঘটলেও, এখন তা ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও সম্মানজনক পেশার ভেতরেও। চিকিৎসক, সাংবাদিক, সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ, প্রকৌশলী, ব্যাংকার, আইনি পেশাজীবীসহ অনেক সম্মানজনক পেশার নাম ব্যবহার করে প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। এতে একদিকে যেমন মানুষ প্রতারিত হচ্ছে, অন্যদিকে সমাজে সেই পেশার প্রতি মানুষের আস্থা দুর্বল হচ্ছে।

গুরুত্বপূর্ণ পেশার ছদ্মবেশে প্রতারণার ধরন

১. ডাক্তার সেজে প্রতারণা : অনেক প্রতারক নিজেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে অবৈধভাবে ক্লিনিক পরিচালনা করছে, বা অনলাইনে ফেসবুক পেজে চিকিৎসা পরামর্শ দিয়ে রোগীদের বিভ্রান্ত করছে। এতে রোগীর জীবন হুমকির মুখে পড়ছে। অনেক সময় ভুয়া ডিগ্রি দেখিয়ে বিদেশে পড়াশোনার নাম করে প্রতারণাও করে।

২. আইনজীবী বা বিচারক সেজে প্রতারণা: বিচার বিভাগ বা আইন পেশার মর্যাদা কাজে লাগিয়ে অনেকে নিজেকে “হাইকোর্টের উকিল” বা “জজ সাহেব” পরিচয় দিয়ে মামলা নিষ্পত্তির নাম করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অনেকেই আবার নকল বার কাউন্সিল কার্ড ব্যবহার করছে।

৩. সেনা-পুলিশ পরিচয়ে প্রতারণা: “আমি সেনাবাহিনীতে কর্মরত”, “পুলিশ সুপার ভাই” – এই জাতীয় পরিচয়ে মেয়েদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা আদায় বা অন্য প্রতারণা এখন ঘন ঘন ঘটছে। আবার কিছু প্রতারক সেনা পোশাক পরে ভুয়া চেকপোস্ট বসিয়ে জনগণের কাছ থেকে অর্থ আদায় করছে।

৪. ব্যাংক কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণা: ভুয়া কল সেন্টার বা মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে প্রতারকরা “আপনার একাউন্ট ব্লক হয়ে গেছে”, “ওটিপি দিন”, “ভ্যাট ফেরত পেতে হলে তথ্য দিতে হবে” ইত্যাদি বলে গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

৫. সাংবাদিক পরিচয়ে ভয়ভীতি: কিছু প্রতারক ভুয়া আইডি কার্ড ও ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে দোকানদার বা প্রভাবশালীদের কাছ থেকে হুমকি দিয়ে টাকা আদায় করছে। ‘সংবাদ ছাপিয়ে দেবে’ এমন ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজির মতো অপরাধ করছে।

৬. ইঞ্জিনিয়ার-আর্কিটেক্ট সেজে জমি বা ফ্ল্যাট বিক্রির নামে প্রতারণা: ভুয়া ডিজাইন, অনুমোদন ছাড়া নকশা বা নির্মাণ কাজের অনুমতি দেওয়ার কথা বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হচ্ছে। অনেকে আবার নামী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুয়া সনদ দেখিয়ে কাজের সুযোগ নেয়।

প্রতারণার সামাজিক প্রভাব

১. আস্থা বিনষ্ট: সমাজের সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ও সম্মানজনক পেশার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে। একজন প্রকৃত ডাক্তার, প্রকৃত পুলিশ কর্মকর্তা বা প্রকৃত সাংবাদিকের কর্মকেও মানুষ সন্দেহের চোখে দেখছে।

২. আইনের প্রতি অনাস্থা বৃদ্ধি: বিচার বিভাগ, প্রশাসন বা ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা যখন ক্ষুণ্ন হয়, তখন আইনের শাসন দুর্বল হয়ে পড়ে। মানুষ আইনের বাইরে সমাধান খোঁজে, যা সমাজের জন্য ভয়াবহ বিপদ।

৩. মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির আর্থিক ক্ষতি: প্রতারণার শিকার হয় মূলত সাধারণ মানুষ। তারা সঞ্চিত অর্থ বা স্বপ্নের বিনিময়ে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে সর্বস্ব হারায়। কখনো চিকিৎসার নামে, কখনো চাকরির নামে, কখনো ভিসা প্রসেসিংয়ের নামে প্রতারণা চলে।

প্রতারণায় প্রযুক্তির ব্যবহার

প্রযুক্তির প্রসার যেমন মানুষের জীবন সহজ করেছে, তেমনি প্রতারকদের হাতেও নতুন হাতিয়ার তুলে দিয়েছে। যেমন:

ভুয়া ওয়েবসাইট তৈরি করে অনলাইন কেনাকাটার নামে টাকা নেওয়া

ভুয়া অ্যাপ তৈরি করে ব্যাঙ্কিং তথ্য হাতিয়ে নেওয়া

অনলাইনে ভিডিও কনফারেন্সে নিজেকে বিদেশী ডাক্তার বা চাকরিদাতা হিসেবে পরিচয় দেওয়া

হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, টেলিগ্রামের মাধ্যমে ছদ্মবেশী যোগাযোগ

কিছু আলোচিত প্রতারণার ঘটনা

২০২৪ সালে ঢাকায় এক ভুয়া “আর্মি মেজর” পরিচয়ে এক ব্যক্তি একাধিক নারীর সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা ও স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেয়।

২০২৫ সালে এক নারী নিজেকে “বিশেষজ্ঞ গাইনোকোলজিস্ট” পরিচয়ে রাজধানীর একটি বেসরকারি ক্লিনিকে রোগী দেখে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করেন, পরে ধরা পড়েন তিনি ভুয়া ডাক্তার।

২০২৪ সালে চট্টগ্রামে এক ব্যক্তি নিজেকে “সিনিয়র ব্যাংক কর্মকর্তা” পরিচয়ে লোকজনকে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার নাম করে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করেন।

প্রতারণা প্রতিরোধে করণীয়

১. সচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সাধারণ জনগণকে সচেতন করা প্রয়োজন। কীভাবে প্রতারণা হয়, কোন ধরণের তথ্য গোপন রাখতে হবে, সন্দেহজনক কিছু হলে কাকে জানাতে হবে — এসব নিয়ে প্রচার চালাতে হবে।

২. আইন প্রয়োগ জোরদার: প্রতারণার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। সাইবার অপরাধ তদন্ত ইউনিট, পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ও র‍্যাবকে আরও সক্রিয় হতে হবে।

৩. পেশাগত সনদ যাচাইয়ের পদ্ধতি: ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিক — যেকোনো পেশায় কাজ করার পূর্বে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সনদ ও রেজিস্ট্রেশন যাচাইয়ের পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করতে হবে। হাসপাতাল, পত্রিকা অফিস, মিডিয়া হাউজ কিংবা প্রকল্পে নিয়োগের আগে যাচাই-বাছাই নিশ্চিত করতে হবে।

৪. অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: ব্যক্তিগত তথ্য যেমন এনআইডি নম্বর, ওটিপি, ব্যাঙ্ক একাউন্ট ডিটেইলস কাউকে না দেওয়া, সন্দেহজনক লিংকে ক্লিক না করা, ফিশিং প্রতারককে রিপোর্ট করা ইত্যাদি বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

প্রযুক্তিগত সমাধান

কিউআর কোডভিত্তিক প্রফেশনাল ভেরিফিকেশন সিস্টেম যেমন — একজন ডাক্তার বা আইনজীবীর সনদ কিউআর কোড দিয়ে স্ক্যান করলেই তার নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর ও কাজের স্থান দেখা যাবে।

ভুয়া সনদের তথ্য শনাক্তে কেন্দ্রীয় ডাটাবেজ

যাতে প্রতিটি পেশার ডিগ্রি ও রেজিস্ট্রেশন এক জায়গায় সংরক্ষিত থাকবে, এবং যেকোনো নিয়োগকারী বা সেবাগ্রহীতা সহজেই যাচাই করতে পারবে।

পরিশেষে বলতে চাই, সম্মানজনক পেশার নাম ব্যবহার করে প্রতারণা শুধু ব্যক্তি নয়, গোটা সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। এটি শুধু আর্থিক ক্ষতিই ডেকে আনে না, বরং নৈতিক অবক্ষয় ও পেশাগত সম্মান নষ্ট করে দেয়। সমাজে ন্যায়বিচার ও আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। জনসচেতনতা, প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, সুশাসন এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ — এই চারটি স্তম্ভে ভর করেই আমরা একটি নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।