প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত
ভদ্রতার দুর্ভিক্ষে ডুবে যাচ্ছে আমাদের সমাজ
২০২৫ জুন ১৯ ১৯:৪৬:০৮
মীর আব্দুল আলীম
আমরা এমন এক সময় পার করছি, যেখানে ভদ্রতার মূল্য দেওয়া হয় না, বরং তাকে ‘বোকা’ ভাবা হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে-ভদ্রতারই শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়। একজন রূঢ় মানুষ হয়তো দ্রুত কিছু পেয়ে যায়, কিন্তু একজন ভদ্র মানুষ জীবনের শেষে সকলের হৃদয়ে স্থান করে নেয়। আমরা যদি আবার ভদ্রতা চর্চা শুরু করি-সন্তানকে শেখাই, সহকর্মীর সঙ্গে ব্যবহার শুদ্ধ করি, রাস্তায় একজন অচেনাকে সাহায্য করি-তাহলেই সমাজ বদলাবে। এটা একদিনে হবে না, কিন্তু শুরু না করলে কখনোই হবে না। এখনই সময়-ভদ্রতার পুনর্জাগরণে আমাদের এগিয়ে আসার।
আমরা ধীরে ধীরে যে সমাজে প্রবেশ করছি, সেখানে ‘ধন্যবাদ’, ‘দুঃখিত’, ‘অনুগ্রহ করে’, ‘ক্ষমা করবেন’-এ সব শব্দ যেন অচল মুদ্রায় পরিণত হচ্ছে। আমরা মোবাইলে ব্যস্ত, চোখে চোখ রেখে কথা বলি না, ট্রাফিক সিগন্যালে এক বৃদ্ধকে রাস্তা পার করিয়ে দেওয়াটাও যেন সময়ের অপচয়। অথচ এই ছোট ছোট আচরণগুলোই সমাজকে করে তুলত সহনশীল, সংবেদনশীল। সামাজিক শালীনতা এক সময় মানুষের দৈনন্দিন চর্চার অংশ ছিল। এখন এ সব ‘বোকাদের কাজ’ হিসেবে দেখা হয়। এই কলামে আমরা খুঁজব-কেন আমরা এতটা অভদ্র হচ্ছি, কীভাবে সামাজিক সৌজন্য হারিয়ে যাচ্ছে এবং এর ফলাফল সমাজে কী রকম ছাপ ফেলছে।
ঘরের ভেতরেই শুরু হচ্ছে ভদ্রতার অবসান: ভদ্রতা একটি পারিবারিক গুণ। বাবা-মা সন্তানদের যা শেখান, তা-ই তারা বাইরে ব্যবহার করে। কিন্তু এখন অনেক মা-বাবাই সন্তানের সঙ্গে আদর্শ আচরণ করতে পারেন না। ব্যস্ততা, হতাশা, রাগ-এসব ছড়িয়ে পড়ে কথায় ও ব্যবহারে। ঘরে যখন মা-বাবা নিজেদের মধ্যে হুমকিমূলক বা অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করেন, তখন সন্তান কী শিখবে? একটা শিশু যখন দেখে তার বাবা রিকশাওয়ালাকে গালি দিচ্ছে, কিংবা মায়ের ফোনে রূঢ় ব্যবহার, তখন তার ভদ্রতার পাঠটি কখনোই সঠিকভাবে হয় না। এতে শিশুর ভিতরে তৈরি হয় এক ধরনের অসহনশীলতা ও শ্রদ্ধাহীনতা। পরে এই শিশুই স্কুলে সহপাঠীকে অপমান করে, রাস্তায় জ্যামে চিৎকার করে, অফিসে সহকর্মীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। এই অবক্ষয়ের শুরু কিন্তু পরিবারের ভেতরেই। আমরা যদি চাই শিশু বড় হয়ে ভদ্র মানুষ হোক, তবে আগে আমাদের নিজেদের আচরণ শোধরাতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শালীনতার সংকট: এক সময় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা। এখন সেই সম্পর্ক ক্রমেই পরিণত হচ্ছে ‘কনট্রাকচুয়াল অ্যারেঞ্জমেন্ট’-এ। শিক্ষক ক্লাসে ঢুকেন, পড়ান, বেরিয়ে যান। শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার আগমুহূর্তে গাইডবই মুখস্থ করে পাশ করে যায়। মাঝখানে যেটা হারিয়ে যাচ্ছে, তা হলো মানবিক সম্পর্ক। একজন শিক্ষককে এখন ছাত্ররা ভয় পায় না, শ্রদ্ধা তো দূরের কথা! অন্যদিকে শিক্ষকও ছাত্রদের সঙ্গে রূঢ় ব্যবহার করেন, মমতা কমে যাচ্ছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায়, শিক্ষার্থীরা একে অপরকে গালাগালি করে, শিক্ষককেও হেয় করতে দ্বিধা করে না। যে জায়গাটি ভদ্রতা ও মানবিকতার চর্চা শেখাবার কথা ছিল, সেখানে এখন ঠুনকো ফলাফল আর প্রতিযোগিতা ছাড়া কিছুই নেই। শিক্ষা যদি মানুষকে মানুষ হতে না শেখায়, তবে সে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কোথায়?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- সভ্যতার মুখোশ না আসল চেহারা?: একসময় আমরা হাতে লেখা চিঠিতে ‘আশা করি ভালো আছো’ দিয়ে শুরু করতাম। এখন ফেসবুক বা টুইটারে মন্তব্য শুরু হয় ‘তুই তো একটা গাধা’ দিয়ে! কেউ একটু ভিন্নমত দিলে তার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন উঠে। শুধু মতের পার্থক্য হলেই গালি দেওয়া, ট্রল বানানো—এসব যেন সাধারণ হয়ে গেছে। ভদ্রতা এখন মিমে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক মন্তব্যে গালাগালি যেন ‘কুলনেস’-এর একটা রূপ। অথচ এই ভার্চুয়াল আচরণ বাস্তব জীবনেও ছাপ ফেলছে। যুবকরা এখন আর সম্মান দিতে জানে না, বিরোধ মানে গালি—এই ধারণা নিয়েই তারা বড় হচ্ছে। ডিজিটাল সভ্যতার এই চেহারাটি আসলে এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের আলামত। এখানে নিজের ইমেজ বড় করতেই অন্যকে ছোট করতে হয়। অথচ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো হতে পারত সৌজন্য শেখার এক মহৎ প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু আমরা সেটা হতে দিইনি।
ভদ্রতা মানে দুর্বলতা নয়: বাংলাদেশে একধরনের ধারণা তৈরি হয়েছে যে, ভদ্র মানুষ মানেই ‘সোজা-সিধা’, আর ‘চালাক’ মানেই ‘চিটে’। ফলে, রূঢ় আচরণ, বেপরোয়া মনোভাব এবং অহংকারকে আমরা ‘যোগ্যতা’ হিসেবে গ্রহণ করি। আমরা সেই মানুষদের অনুসরণ করি যারা চিৎকার করে কথা বলে, অন্যকে অপমান করে, অথচ বড়লোক বা নামি ব্যক্তি। এই ভাবনাটি মারাত্মক। এতে সমাজে আদর্শ মানুষ নয়, ভয়ংকর মানুষরা অনুসরণীয় হয়ে ওঠে। আমরা শিখি, “কাউরে ছাড় দিলে গায়ে উঠে বসে।” অথচ প্রকৃত ভদ্রতা কখনো দুর্বলতা নয়—এটা একটা শক্তিশালী মননের প্রকাশ। একজন ভদ্র মানুষ সাহসের সঙ্গে কথা বলে, কিন্তু সংযতভাবে। সে কারও অনুভূতিকে আঘাত না করেও নিজের অবস্থান জানাতে পারে। ভদ্রতা মানেই মাথা নিচু করা নয়, বরং মাথা উঁচু রেখে শালীনভাবে পথ চলা।
কর্মস্থলে সৌজন্যহীন সংস্কৃতি: একজন কর্মচারী যখন অফিসে ঢোকে, তার মন মানসিকতা নির্ভর করে অফিস পরিবেশের উপর। এখনকার কর্পোরেট পরিবেশে অনেক জায়গাতেই দেখা যায়-বসরা অধীনস্থদের ‘মেশিন’ মনে করেন। “এই কাজটা না করলে তোকে বের করে দেব” ধরনের কথা এখন নৈমিত্তিক। অন্যদিকে, সহকর্মীদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা এতটাই চরমে পৌঁছেছে যে, সহানুভূতির জায়গা উধাও। কেউ একটু অসুস্থ হলে, কেউ ব্যক্তিগত সমস্যায় থাকলে—তাকে সহযোগিতা করা হয় না, বরং সুযোগ হিসেবে দেখা হয়। যদি এক অফিসেই কেউ কাউকে শ্রদ্ধা না করে, ভালো ব্যবহার না করে, তাহলে সেই প্রতিষ্ঠান কখনোই টেকসই হবে না। কর্মক্ষেত্রে সৌজন্য মানে শুধু ভদ্রতা নয়, এটা টিমওয়ার্ক, প্রোডাকটিভিটি ও দীর্ঘমেয়াদি সফলতার চাবিকাঠি।
রাজনীতির মাঠে সৌজন্য এখন স্লোগানে রূপ নিয়েছে: রাজনীতি এক সময় ছিল আদর্শের, যুক্তির ও সভ্য বিতর্কের ক্ষেত্র। বিপক্ষের মতকে সম্মান করেই পথচলা ছিল রাজনীতির সৌন্দর্য। এখন? মঞ্চে উঠে রাজনৈতিক নেতারা প্রতিপক্ষকে ‘চোর’, ‘ডাকাত’, ‘গুন্ডা’ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কর্মীরা তো গালিগালাজে পারদর্শী হয়ে উঠছে দিনে দিনে। টকশোতে দেখা যায়, বক্তারা এতটা উত্তেজিত হয়ে যান যে, শিষ্টাচার ভুলে যান। একজন আরেকজনকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কথা কেটে কেটে যান। যুক্তি নেই, তথ্য নেই—শুধু চিৎকার আর কুতর্ক। জনগণও সেই উত্তেজনায় মুগ্ধ হয়ে ফেসবুকে ক্লিপ শেয়ার করে। রাজনীতির এই অবক্ষয়ে তরুণ প্রজন্ম শেখে, ‘শ্রদ্ধা নয়, শক্তিই প্রধান’। অথচ দেশের ভবিষ্যত নেতৃত্ব যখন ভদ্রতার ভাষা ভুলে যাবে, তখন গণতন্ত্রের ভিত্তিই দুর্বল হয়ে পড়বে। ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা না থাকলে, সমাজ শুধু বিভক্ত হবে-একতা নয়।
ধর্মীয় ভদ্রতা ও সহনশীলতা আজ কোথায়?: সব ধর্মই ভদ্রতা, ক্ষমাশীলতা এবং সহানুভূতির শিক্ষা দেয়। ইসলাম বলে-”তুমি যদি ক্ষমা করতে পারো, সেটাই বড় গুণ।” হিন্দুধর্মে রয়েছে ‘অহিংসা পরম ধর্ম’। খ্রিস্টধর্মেও রয়েছে-”প্রতিপক্ষ তোমার গালে চড় মারলে, অন্য গাল এগিয়ে দাও।” কিন্তু আমরা ধর্ম মানি শুধু বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানে। একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি লোক রাস্তায় রিকশাওয়ালাকে গালি দিচ্ছেন-এটা কেমন দ্বিচারিতা? ধর্ম পালনের চেয়েও বড় হলো, ধর্মের মূল দর্শন ধারণ করা। ধর্মীয় গোঁড়ামি আমাদের ভদ্রতা কেড়ে নিচ্ছে। এখন কেউ অন্য ধর্মের অনুসারীকে সম্মান করলে অনেকেই বলে ‘তুই নাস্তিক হইছিস!’ অথচ প্রকৃত ধর্মপ্রাণ মানুষ জানে, মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও ভদ্র ব্যবহারই আসল ইবাদত।
গণপরিবহনে ভদ্রতার চরম দুর্ভিক্ষ: বাসে উঠলেই দেখা যায়, হট্টগোল, ধাক্কাধাক্কি আর চিৎকার। কেউ কারও জায়গা ছাড়ে না, বৃদ্ধা মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলেও কেউ সিট ছেড়ে দেয় না। গাড়ির কন্ডাক্টর চেঁচিয়ে যাত্রীদের গালি দিচ্ছে, যাত্রী তার জবাবে কটু কথা ছুড়ছে। আমরা ভুলে গেছি, গণপরিবহন মানে সবাই মিলে ভাগ করে নেওয়া জায়গা। সেখানে একে অপরের প্রতি সম্মান, সহনশীলতা ও সহানুভূতি থাকা উচিত। একজন ভদ্র যাত্রীই পারে অন্যদের উৎসাহিত করতে ভদ্র হতে। যদি গণপরিবহনে একটু ভদ্রতা প্রবেশ করে, তাহলে সারাদিনের মানসিক চাপ অনেকটাই কমে আসবে। কিন্তু তা হতে হলে চাই সামাজিক সচেতনতা ও নিজেদের ভেতর থেকে পরিবর্তন।
প্রেমের সম্পর্কেও হারিয়ে যাচ্ছে সৌজন্য: আজকাল প্রেম মানেই দ্রুত কিছু পাওয়ার তাড়না। সম্পর্ক শুরু হয় ইনবক্সে, ভেঙে যায় এক ‘সিন’ না দেওয়ার জন্য। ভালোবাসার জায়গায় এখন আগ্রাসন, দাবি, সন্দেহ আর ইগোর স্থান হয়েছে। একটা সময় ছিল, প্রেমিক-প্রেমিকা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকত, তর্ক হলেও গালি আসত না, ব্যক্তিত্বকে মূল্য দেওয়া হতো। এখন প্রেমের সম্পর্ক ভেঙে গেলে ছেলেটি মেয়েটিকে অপমান করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়, বা মেয়েটি ছেলেটিকে ব্ল্যাকমেইল করে। এই সম্পর্কগুলোতে ভদ্রতার অভাবের কারণ হলো আত্মকেন্দ্রিকতা ও সহানুভূতির ঘাটতি। সম্পর্ক মানে শুধু ভালোবাসা নয়, বরং শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও সৌজন্য—-সবও অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শিশুদের আচরণে ভদ্রতা থাকছে না কেন?: এক সময় শিশুরা বড়দের দেখলে সালাম দিত, মুরুব্বিদের পা ছুঁয়ে সালাম করা হতো। এখন? তারা মোবাইল স্ক্রিন থেকে চোখই তো তোলে না! সালাম তো দূরের কথা, চোখে চোখ রেখে কথা বলাও শেখে না। অনেক শিশু রাস্তায় গালি দেয়, অথচ বাবা-মা সেটা ‘কিউট’ বলে হাসেন! শিশুদের এই আচরণ তৈরি হচ্ছে পরিবার, মিডিয়া, আর সমাজের সম্মিলিত উদাসীনতায়। তারা যা দেখে, তাই শেখে। টিভিতে যদি রূঢ় ভাষার নাটক চলে, ইউটিউবে যদি কনটেন্ট হয় কটাক্ষপূর্ণ, তাহলে শিশু শিখবে কী করে সৌজন্য? ভদ্রতা শিশুদের মধ্যে তৈরি করতে হলে পরিবারকে হতে হবে প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র। শিশুদের শেখাতে হবে—ভালো আচরণ, সহানুভূতি আর শ্রদ্ধাই একজন মানুষকে বড় করে তোলে।
ভদ্রতা একটি ‘সোশ্যাল কারেন্সি’: আমরা টাকা পয়সা দিয়ে সব কিছু কিনতে পারি, কিন্তু সম্মান অর্জনের জন্য দরকার ভদ্রতা। কেউ যদি রাস্তায় পড়ে যায়, তাকে তুলে দিলে সে আপনার নাম ভুলে যাবে, কিন্তু ব্যবহার মনে রাখবে। আজকের সমাজে আমরা ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ গড়তে চাই-কিন্তু ভুলে যাই, তার ভিত্তি হলো ভদ্রতা। আপনি যদি কর্তার মতো আচরণ না করে মানুষের পাশে থাকেন, সবাই আপনার জন্য জায়গা করে রাখবে। ভদ্রতা আসলে বিনিয়োগ। আপনি আজ একজনকে সম্মান দিলে, কাল সে আপনাকে সম্মান ফিরিয়ে দেবে। আপনি যদি দয়াশীল হন, আপনি একদিন তা বহুগুণে ফিরে পাবেন।
ভদ্রতা মানে নিরবতা নয়, সচেতন প্রতিবাদও ভদ্রতা: অনেকে মনে করেন ভদ্রতা মানেই সব কিছুতে চুপচাপ থাকা। এটি ভুল ধারণা। ভদ্রতা মানে হলো, অন্যায়ের প্রতিবাদও করতে হবে—শালীনভাবে, যুক্তি দিয়ে। একজন ভদ্র মানুষ কখনোই অন্যায় দেখলে নীরব থাকে না। বাজারে এক মা যদি তার বাচ্চাকে মারধর করেন, একজন ভদ্র মানুষ গিয়ে শান্তভাবে বলেন, “আপনার সন্তান ভয় পেয়ে যাচ্ছে, একটু ধৈর্য ধরুন।” এই কথার মধ্যেই রয়েছে প্রতিবাদ এবং সহানুভূতি-দুই-ই। ভদ্রতা কেবল মাথা নিচু করে চলা নয়। এটা মাথা উঁচু করে, অন্যের অধিকার রক্ষা করে, সম্মানজনকভাবে জীবন কাটানোর নাম।
আন্তর্জাতিক সমাজে ভদ্রতা আমাদের পরিচয়: আপনি যখন বিদেশে যান, তখন আপনার দেশের পরিচয় আসে আপনার আচরণ দিয়ে। একজন বাংলাদেশি যখন ট্রেনে একজন বৃদ্ধকে সিট দেন, অন্যরা তখন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা পায়। বিদেশে অনেক বাংলাদেশিকে দেখা যায়-গার্বেজ ছুড়ে ফেলা, উচ্চস্বরে কথা বলা, ট্রেনে পা তুলে বসা—এসব অভ্যাস শুধু নিজেকে নয়, দেশকেও ছোট করে। একটি জাতি কতটা সভ্য—তা বোঝা যায় তাদের সাধারণ মানুষের আচরণ দেখেই। আমাদের আচরণেই যেন বাংলাদেশের ভদ্র ও সম্মানজনক পরিচয় ছড়িয়ে পড়ে, সে চেষ্টা করতে হবে প্রতিটা মানুষের।
ভদ্রতা ফিরে পেতে চাই সংস্কৃতির জাগরণ: ভদ্রতা শুধুমাত্র একটা আচরণ নয়, এটা একটা সাংস্কৃতিক চর্চা। সমাজ যখন শিল্প, সাহিত্য, সংগীত ও নাটকের মাধ্যমে সৌজন্য শেখায়, তখনই তা মানুষের আচরণে প্রতিফলিত হয়। এই জন্য চাই—ভদ্রতা নিয়ে নাটক হোক, গান হোক, শিশুদের বই লেখা হোক। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে সৌজন্যকে গুরুত্ব দিলে সমাজে ধীরে ধীরে তার চর্চা বাড়বে। একটি জাতিকে সভ্য করতে হলে আগে ভদ্র করতে হবে। সংস্কৃতির মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধ ছড়িয়ে দিলে, ভদ্রতা আবার ফিরবে—পথে, ঘরে, অফিসে ও হৃদয়ে।
ভদ্রতা একসময় আমাদের সমাজের স্বাভাবিক আচরণ ছিল, কিন্তু এখন যেন তা বিলুপ্ত প্রায়। পরিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, কর্মস্থল থেকে রাজনীতির মঞ্চে—সব জায়গায়ই শালীনতা ও সৌজন্যের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। সন্তানরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিখছে রূঢ়তা, শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করতে পারছেন না। অফিসের পরিবেশে সহযোগিতার বদলে হুমকি-ধমকি আর প্রতিযোগিতার বিষক্রিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিন্নমত মানেই এখন ট্রল, গালি আর চরিত্রহনন। ধর্মের মর্মবাণীও হারিয়ে গেছে লোক দেখানো আচারের ভিড়ে। প্রেমের সম্পর্ক থেকে শুরু করে গণপরিবহনে পর্যন্ত সৌজন্যের ঘাটতি চোখে পড়ছে। শিশুরাও বড়দের কাছ থেকে শিখছে অসৌজন্য আচরণ, যা তাদের ভবিষ্যতকে আরও বিপজ্জনক করে তুলছে।
ভদ্রতা কখনোই দুর্বলতা নয়; বরং তা এক ধরনের শক্তি ও আত্মমর্যাদার প্রকাশ। ভদ্রতা একটি সামাজিক পুঁজি, যা বিনিয়োগ করলে বহুগুণে ফেরত পাওয়া যায়। প্রতিবাদও হতে পারে ভদ্র, যুক্তিবদ্ধ এবং শালীন। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আমাদের ব্যক্তিগত আচরণে দেশের সম্মান জড়িয়ে থাকে। তাই ভদ্রতা ফিরিয়ে আনতে চাই পরিবার থেকে শুরু করে সংস্কৃতির জাগরণ। নাটক, সাহিত্য, সংগীতের মাধ্যমে শালীনতার বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারলে আমরা আবারও গড়ে তুলতে পারব সৌজন্যপূর্ণ এক মানবিক সমাজ।
লেখক: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।