ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » মুক্তচিন্তা » বিস্তারিত

বিশ্ব শরনার্থী দিবস: মানবতার পরীক্ষায় পৃথিবী

২০২৫ জুন ১৯ ১৯:৫৬:১৭
বিশ্ব শরনার্থী দিবস: মানবতার পরীক্ষায় পৃথিবী

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বিশ্বে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ, নিপীড়ন, ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সংঘাত এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে জীবন বাঁচানোর তাগিদে আশ্রয় খোঁজে অন্যত্র। এই মানুষদের বলা হয় ‘শরণার্থী’। প্রতি বছর ২০ জুন পালিত হয় বিশ্ব শরণার্থী দিবস (World Refugee Day), যেটি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (UNHCR) এর উদ্যোগে ২০০১ সাল থেকে উদযাপন হয়ে আসছে। এই দিবসটি মূলত শরণার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা জানানো এবং তাদের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানাতে উদযাপন করা হয়।

শরণার্থীর সংজ্ঞা ও বাস্তবতা

জাতিসংঘের সংজ্ঞা অনুযায়ী, শরণার্থী হলেন এমন ব্যক্তি যিনি "যুদ্ধ, সহিংসতা, নিপীড়ন বা মানবাধিকারের লঙ্ঘনের কারণে নিজ দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন এবং সেখানে নিরাপত্তার আশায় বসবাস করছেন।"

আজকের বিশ্বে প্রায় ১২ কোটি মানুষ বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় ৪ কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে অন্য দেশে অবস্থান করছেন। আফগানিস্তান, সিরিয়া, সুদান, মিয়ানমার, ভেনেজুয়েলা ও ইউক্রেন থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ শরণার্থী হয়েছে।

শরণার্থীদের দুর্ভোগ: এক মানবিক সংকট

শরণার্থীদের জীবন শুরু হয় বেদনাদায়কভাবে। তারা জন্মভূমি, ঘরবাড়ি, পরিবার ও বন্ধুদের ছেড়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিরাপদ আশ্রয়ের প্রতিশ্রুত দেশগুলোতে প্রবেশ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন—অনেক সময় সীমান্তে আটক, হেনস্তা, অনাহার কিংবা শোষণের শিকার হন।

খাদ্য ও চিকিৎসা সংকট

অধিকাংশ শরণার্থী ক্যাম্পে ন্যূনতম খাদ্য, পানীয় জল এবং স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা থাকে না। বিশেষ করে নারী ও শিশুরা যৌন সহিংসতা এবং মানব পাচারের ঝুঁকিতে থাকে।

শিক্ষা থেকে বঞ্চিত প্রজন্ম

শরণার্থী শিশুদের প্রায় ৪৮% স্কুলে যেতে পারে না। একটি সমীক্ষা বলছে, শরণার্থী কিশোরীদের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রাপ্তির হার মাত্র ২৭%। এইভাবে একটি প্রজন্ম ধ্বংসের মুখে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট

বাংলাদেশ শরণার্থীদের সহায়তার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম কক্সবাজারে পালিয়ে আসে। বাংলাদেশের সীমিত সম্পদের মাঝেও তাদের আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

তবে দীর্ঘমেয়াদি শরণার্থী সমস্যা একটি জাতির আর্থ-সামাজিক ভারসাম্যে চাপ সৃষ্টি করে। বর্তমানে কক্সবাজার ও ভাসানচর এলাকায় অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তা, পরিবেশ এবং অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ ও রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা

শরণার্থী সমস্যা শুধু একটি রাষ্ট্রের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক মানবিক সংকট। কিন্তু অনেক দেশই আজকাল শরণার্থী গ্রহণে অনাগ্রহী—তারা সীমান্ত বন্ধ করে দিচ্ছে, অভিবাসন আইন কঠোর করছে। অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে শরণার্থীদের ব্যবহারও লক্ষ্য করা যায়।

জাতিসংঘের মতে, শরণার্থীদের গ্রহণ করার পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ দেওয়া প্রতিটি রাষ্ট্রের মানবিক দায়িত্ব।

আইনি কাঠামো ও শরণার্থীর অধিকার

১৯৫১ সালের জাতিসংঘের শরণার্থী সনদ ও ১৯৬৭ সালের প্রটোকল অনুযায়ী, প্রত্যেক শরণার্থীর আন্তর্জাতিক সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাদের বিনা বিচারে ফেরত পাঠানো যাবে না (non-refoulement principle)। কিন্তু এই সনদের প্রয়োগে অনেক রাষ্ট্র গড়িমসি করে থাকে।

বাংলাদেশ এই সনদে স্বাক্ষর না করলেও মানবিক বিবেচনায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছে। এখন সময় এসেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসে শরণার্থীদের জন্য স্থায়ী ও মানবিক সমাধান খুঁজে বের করার।

আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকা

UNHCR (United Nations High Commissioner for Refugees)

এই সংস্থাটি শরণার্থীদের পুনর্বাসন, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসার দায়িত্ব পালন করে থাকে। বিভিন্ন ক্যাম্পে রেশন বিতরণ, নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং আইনি সহায়তা প্রদান করে UNHCR।

IOM (International Organization for Migration)

বিশ্বজুড়ে অভিবাসন ব্যবস্থাপনায় IOM গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষত শরণার্থীদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনে এই সংস্থার ভূমিকা প্রশংসনীয়।

বিশ্ব শরনার্থী দিবসের তাৎপর্য

বিশ্ব শরণার্থী দিবস কেবলমাত্র শরণার্থীদের দুঃখগাঁথা তুলে ধরার একটি দিন নয়, এটি একটি প্রতিজ্ঞার দিন—যেখানে বিশ্ববাসী প্রতিশ্রুতি দেয়, তারা নিপীড়িত, বাস্তুচ্যুত ও নিরাশ্রয় মানুষদের পাশে থাকবে। এই দিবসটির মাধ্যমে শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতি ও সমর্থন জানানো হয় এবং তাদের মানবিক অধিকার আদায়ের আহ্বান জানানো হয়।

করণীয় ও ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা

১. রাজনৈতিক সমাধানে জোর দেওয়া: শরণার্থী সমস্যার মূল শিকড় হলো যুদ্ধ ও নিপীড়ন। তাই কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজা জরুরি।

২. আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানো: শরণার্থী-গ্রহণকারী দেশগুলোকে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা দেওয়া উচিত। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ওপর বোঝা কমাতে উন্নত বিশ্বের আরও সহযোগিতা প্রয়োজন।

৩. শিক্ষার সুযোগ: শরণার্থী শিশুদের জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করলে তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে এবং অপরাধ ও উগ্রবাদের ঝুঁকি কমবে।

৪. জনসচেতনতা বৃদ্ধি: শরণার্থীদের বিষয়ে সমাজে ভুল ধারণা দূর করতে মিডিয়া, এনজিও ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি

পরিশেষে বলতে চাই, বিশ্ব শরণার্থী দিবস আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয়, আমাদের চারপাশেই আছে হাজারো মানুষ, যারা ভয়, নির্যাতন এবং নিরাপত্তাহীনতার মাঝে জীবন পার করছে। তাদের কোনো অপরাধ নেই—তারা কেবল একটি নিরাপদ জীবনের স্বপ্ন দেখে। আমরা যদি এই দুর্ভাগা মানুষদের পাশে দাঁড়াতে না পারি, তবে মানবতা শব্দটির কোনো মানে থাকবে না।

এই দিবসে আমাদের সকলের অঙ্গীকার হোক—শরণার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর, তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার এবং মানবিকতার ভিত্তিতে একটি বিশ্ব গড়ার। বিশ্ব তখনই সত্যিকারের সভ্য হবে, যখন প্রতিটি মানুষ—সে যেই ধর্ম, জাতি, কিংবা দেশের হোক—নিজেকে নিরাপদ ও সম্মানিত মনে করতে পারবে।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক, প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।