ঢাকা, সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫, ১৬ আষাঢ় ১৪৩২

প্রচ্ছদ » পাঠকের লেখা » বিস্তারিত

"গেম ওভার" নয়, "গেম ডিসমিসড": ৩০ তরুণের বিদেশযাত্রার ভুয়া স্বপ্নভঙ্গের গল্প

২০২৫ জুন ২২ ১৪:৩২:৩৩

দিলীপ চন্দ, ফরিদপুর :ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১১ জুন গভীর রাত। হুড়োহুড়ি, চেনা টানাপোড়েন, মৃদু উত্তেজনার মাঝেও আলাদা করে চোখে পড়েনি ৩০ তরুণের দলটি। তাদের মুখে ছিল বিদেশযাত্রার স্বপ্ন, বুকে লুকানো ছিল মিশর, লিবিয়া হয়ে ইতালির সুদূর স্বপ্নের হাতছানি।

তারা জানতেন না— এ যাত্রা হবে জীবনের ভয়ঙ্করতম অভিজ্ঞতা, যার শেষ কোথায় তা তারা কল্পনাও করতে পারেননি।

দালালের ফাঁদে আটকে যাওয়া এক গ্রামবাংলার গল্প :
এই ৩০ জনের বেশিরভাগই এসেছেন নড়াইল, সিলেট, ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুরের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। কারও পেশা গার্মেন্টস কর্মী, কেউ দিনমজুর, কেউ ছোট দোকানি। কেউ কেউ জীবনে প্রথম ঢাকায় এসেছেন। দালালরা তাদের আশ্বাস দিয়েছিল— খুব সহজে ইউরোপ পৌঁছানো যাবে।

পল্টনের ছোট্ট হোটেল কক্ষে জমা হয়েছিল ৩০টি পাসপোর্ট, ৩০টি স্বপ্ন। সেখানে রাসেল নামের দালাল তাদের নির্দেশ দেন— মিশর ও লিবিয়ার ভিসা ঢাকায় ইমিগ্রেশনে দেখানো যাবে না; শুধু তুরস্কের ৫ দিনের ট্যুর ভিসা।

"A-31 স্যার"-এর রহস্য :
তবে আশ্চর্যের বিষয়— শাহজালালের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে কারও ভিসা যাচাই হয়নি। বোর্ডিং পাসে লেখা ছিল: "OK from prosecution, concerned A-31 sir"। কর্মকর্তারা জানালেন, উপর মহলের এমন ‘নোট’ থাকলে আর প্রশ্ন তোলা চলে না।

কে এই ‘A-31 স্যার’? অনুসন্ধানে জানা গেছে— এটি ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) ওয়্যারলেস কল সাইন। সেদিন দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিমতানুর রহমানের নির্দেশেই এসব লেখা হয়।

তুর্কি বন্দিশিবিরের বিভীষিকা :
তুরস্কের বিমানবন্দরে নামার পর গল্পের মোড় ঘুরে যায়। একজন বলে ওঠেন, "আমাদের দুইজন নেই, কোথায় গেল?" খোঁজাখুঁজির মাঝেই তুর্কি পুলিশের হাতে ধরা পড়েন তারা। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ।

তুর্কি পুলিশ দেখতে পায়— সবার ই-ভিসা ভুয়া। সঙ্গে মিশরের বোর্ডিং পাস, যা তুরস্কের ট্রানজিট নিয়ম ভঙ্গের স্পষ্ট প্রমাণ। আটক হন সবাই।

মুন্সিগঞ্জের শ্রীনাথ চন্দ্র বর্মণ জানালেন, "সেখানে আমাদের ভয়ানক সময় কেটেছে। তুর্কি পুলিশ চিৎকার করছিল, বুঝতেই পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল দেশে আর ফেরা হবে না।"

শরীয়তপুরের জুয়েল আকন বললেন, "জীবনের সবচেয়ে লম্বা রাত ছিল সেটা। ঘুমাতে পারিনি। শুধু মনে হচ্ছিল, বউ-বাচ্চা আর দেখবো না।"

স্বপ্নভঙ্গের প্রত্যাবর্তন :
২৪ ঘণ্টারও বেশি আটক রাখার পর ১৩ জুন ভোরে TK-712 ফ্লাইটে ফেরত পাঠানো হয় তাদের। বিমানবন্দরে পা রেখেই নরসিংদীর রাবিকুল ইসলাম শিপন বিমানবন্দর থানায় প্রতারণা মামলা করেন দালাল, ট্রাভেল এজেন্সি ও এয়ারলাইন্স কর্মীদের বিরুদ্ধে।

তবে মামলা হলেও ধরা পড়েনি সেই গডফাদাররা। দালালদের ফোন বন্ধ, নাম ঠিকানা অস্পষ্ট। তদন্ত কর্মকর্তা জানালেন, ভুক্তভোগীরাও অনেক তথ্য গোপন করছেন।

কীভাবে পেরোলেন ইমিগ্রেশন?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- শাহজালালের ইমিগ্রেশন পার হলো কীভাবে? যেখানে ভুয়া ভিসার যাত্রীদের ছাড় দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না!

ডিআইজি ইমিগ্রেশন মঈনউদ্দিন হোসেন বলছেন, "আমরা তদন্ত করছি। এখনই কিছু বলার সময় নয়। তবে ভিসা যাচাই করার সিস্টেম আমাদের নেই।"

কিন্তু অনেক ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা অভিযোগ করছেন— উপর মহলের ‘OK’ সঙ্কেতের কারণেই তারা বাধ্য হয়েছেন ছাড় দিতে।

মানবপাচারের নতুন গেম?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবপাচার এখন নতুন "গেম"। সফল হলে "গেম ওভার", ধরা পড়লে "গেম ডিসমিসড"। এবার হয়তো গেম ভেস্তে গেছে, তবে ঈদের আগেও আরও ৫০ জন এমন ই-ভিসায় দেশ ছেড়েছে— যারা ফিরেননি। তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, কেউ জানে না।

শেষকথা :
গ্রামের সহজ মানুষগুলো দালালের মিষ্টি কথায় উঠে পড়ে বিদেশযাত্রার বিমানে। কিন্তু দালাল-এজেন্সি-প্রশাসনের অসাধু যোগসাজশে তাদের স্বপ্ন হয় ভঙ্গুর, ভয়ংকর। এই ৩০ জন ফিরে এলেন, কিন্তু কতজন আজও তুরস্ক, লিবিয়া বা সমুদ্রের কোথাও অজানা মৃত্যুর পথে?
(ডিসি/এএস/জুন ২২, ২০২৫)